ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজপথে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ঘরে আর জামায়াত অস্তিত্বের সঙ্কটে উত্তম চক্রবর্তী

রাজনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১ জানুয়ারি ২০১৭

রাজনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

গোটা পৃথিবী থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন ও জঙ্গীবাদী তকমা লাগাতে ভয়াল-বিভীষিকাময় জঙ্গী হামলা দিয়ে শুরু, পরে কঠোরহস্তে জঙ্গী দমন, উন্নয়ন দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল আর কলঙ্ক মোচনে শেষ। বিদায়ী বছর ২০১৬ কেমন গেল? এ প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পুরো বছরের রাজনীতিকে এমনিভাবে এক কথায় তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াত জোটকে বছরজুড়ে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বছরজুড়েই কার্যত অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের। নির্বাচিত সরকার উৎখাতে জঙ্গী হামলা দেশে কিছুটা সময় আতঙ্ক ছড়াতে সক্ষম হলেও সরকারের জঙ্গীবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি শুধু দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। শত ষড়যন্ত্রের কুহেলিকা ছিন্ন করে জঙ্গী দমন করে উৎকণ্ঠিত মানুষকে স্বস্তি এবং বাংলাদেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিলটি আর বৃহৎ করতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। পুরো বছরই রাজনীতির মাঠ শান্ত থাকলেও দফায় দফায় জঙ্গী তৎপরতা, রিজার্ভ চুরি আর বছরের শেষে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় সরকারকে কিছুটা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। বাকি সময়ে মোটামুটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ রেখেই বিদায় নিল আলোচিত একটি বছর, ২০১৬ সাল। কঠোর দমননীতির পরিবর্তে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিলে শামিল করে, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও পুরস্কার অর্জন এবং দেশের অর্থনীতিকে অতীতের সকল সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াতসহ দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াত জোটকে বছরজুড়ে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে কার্যত অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। আর বছরের শেষ সময়ে নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করেছেন। সব দলই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, নতুন বছরে রাষ্ট্রপতি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। যার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক অঙ্গনে কেমন গেল এই একটি বছর। এ নিয়ে এখন হিসাব মেলাতে ব্যস্ত সবগুলো রাজনৈতিক দল। লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাচ্ছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। স্বস্তি-উন্নয়ন দিলেও সুখে ছিল না আওয়ামী লীগ বছর ধরেই রাজনীতির লাটিমের সুতো শেখ হাসিনার হাতে থাকলেও মাঝে মধ্যে বেশকিছু ঘটনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। শক্তহাতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অশুভ তৎপরতা ও জঙ্গী হামলা মোকাবেলা করে দেশের মানুষকে স্বস্তি এনে দিলেও সারাদেশে অব্যাহত অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিবাদ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। বিদায়ী বছরে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি ছিল আওয়ামী লীগই। দল মনোনীত প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থিতার ছড়াছড়িতে অনেকস্থানেই দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ ক’জন কর্মী-সমর্থককে জীবন দিতে হয়েছে। বছরের শেষ হওয়ার এক দিন আগেও অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে বিদায়ী বছরজুড়েই আওয়ামী লীগ তৃণমূল সম্মেলন শেখ করে গত ২২-২৩ অক্টোবর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমকালো সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী তিন বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব গঠন করে আওয়ামী লীগ। তাক লাগানো সম্মেলনে প্রায় ত্রিশটি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সম্মেলনে যোগ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন রাজনৈতিক দলের অগ্রগতি ও সফলতা কামনা করেন। আর সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা অষ্টমবারের মতো সভাপতি পুনর্নির্বাচিত হন। আর নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রথম নির্বাচিত হন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। টানা দুইবারের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালনকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেই সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করে নতুন চমক দেন। শুধু নতুন সাধারণ সম্পাদক পদেই নয়, ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে একঝাঁক নতুন মুখ এনে চমক দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েকজনের কপাল পুড়লেও বেশ ক’জন নেতাও পদোন্নতি পেয়েছেন। তবে কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য পদের অধিকাংশই সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের স্থান দিয়ে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে ঘুরে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতেই সৈয়দ আশরাফুলের পরিবর্তে ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নেন তিনি। তবে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে ওয়ান ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী বলে অভিহিত কাউকেই স্থান দেননি শেখ হাসিনা। শুধু কেন্দ্রীয় কাউন্সিলই নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার বলে পরিচিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকেও ঢেলে সাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দু’ভাবে বিভক্ত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে এনেছেন নতুন নেতৃত্ব। একইসঙ্গে প্রায় একশ’টি থানা ও ওয়ার্ডেও সাংগঠনিকভাবে অভিজ্ঞ ও ত্যাগী নেতাদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে মূল্যায়ন করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন পরে হলেও মহানগর কমিটি গঠন করায় রাজধানী ঢাকায় সাংগঠনিকভাবে এখন বিগত সময়ের তুলনায় এখন অনেক শক্তিধর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তবে বিদায়ী বছরে শাসক দল আওয়ামী লীগের বড় সাফল্যে হচ্ছে দেশী-বিদেশী সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিশাল সম্পদের ভা-ার যার হাতে ছিল, দেশে-বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা খরচ করে যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন, সেই যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের বিচারের রায় ফাঁসির দ- কার্যকর করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা। আর এই দ- কার্যকরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার শীর্ষ ৬ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করে দীর্ঘ ৪৪ বছর জাতির ললাটে থাকা কলঙ্কের তিলক মুছে দিতে সক্ষম হন। নানা বাগাড়ম্বর ও হুমকি-ধমকি দিলেও রাজপথে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থানের কারণে বিএনপি কিংবা জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পর রাজপথে সামান্যতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি। বিদায়ী বছরে সরকারের সাফল্যে বা অর্জনের কমতি ছিল না। একের পর এক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজয়, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশীয় অর্থনীতি মজবুত, উপচে পড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। গুলশানের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় এবং শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতি ছাড়া পুরো বছরেই রাজপথে ছিল না সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক সঙ্কটে ফেলার কৃতিত্বও সরকারের ঝুলিতে। এত কিছুর পরও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদায়ী বছরে খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না আওয়ামী লীগ। শুধুমাত্র দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাত আর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতাদের লাগামহীন বেঁফাস মন্তব্যের কারণে বিদায়ী বছরের বিভিন্ন সময় চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে দলটিকে। ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকান্ড আর দলীয় কোন্দল সামাল দিতে না পারার ব্যর্থতায় সরকারের বিপুল অনেক অর্জনই যেন ম্লান করে দিয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তে জেলা পরিষদ নির্বাচনেও শুধুমাত্র দলীয় শৃঙ্খলার অভাবে অর্ধ শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দল যেন আরও বেশি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিদায়ী বছরের দলীয় কর্মকা- প্রসঙ্গে দলের নেত্রীমূল নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বছরজুড়েই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যা ঘটেছে তাতে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। অবিলম্বে অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব নিরসন করতে না পারলে সরকারের জনপ্রিয়তা ও সাফল্যে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আসলে নিজ দলের নেতাকর্মীরাই যখন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় তখন অন্য কারোর মধ্যে বিষফোঁড়া খোঁজার মানে হয় না। তাই প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শক্তহাতে দলের নেতাকর্মীদের মুখের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামীতেও আওয়ামী লীগকে বড় মাশুল দিতে হতে পারে। রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি বিএনপি ॥ বিদায়ী বছরের শুরুতে জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। তবে বছরের শেষ দিকে এসে সে আশা হতাশায় রূপ নিয়েছে। রাজপথে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। একের পর এক ‘ইস্যু’ হাতছাড়া করে রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন থেকে এক প্রকার ছিটকেই পড়েছে তারা। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজেদের মনোনীত প্রার্থী এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল বিএনপি। তিনি জিতলে হয়ত দলটিতে ‘নতুন প্রাণের’ সঞ্চার হতো, তবে তা হয়নি। দলীয় প্রার্থীর ব্যাপক ভরাডুবি নেতাকর্মীদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর বিএনপির হতাশা বাড়িয়ে এ বছরই পূর্ণ হয়েছে দলের ক্ষমতার বাইরে থাকার এক দশক (১০ বছর)। এর আগে কখনোই এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ড নেই দলটির। সারাদেশে দলটির সাংগঠনিক যে ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হয়েছে, আগামী নির্বাচনে জয় নিয়েও চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে। বিএনপির অনুসারীদের দাবি, সরকারের নানামুখী চাপেও বিএনপি একটি সফল কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে। কিন্তু সেই সফলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ সম্মেলনের সাড়ে চার মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসে। তাও আবার দলের ইতিহাসে সবচেয়ে ঢাউস কমিটি। স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদসহ ৫৯২ জনের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই ঢাউস কমিটিও দলকে কোন আশার আলো দেখাতে পারেনি। এ ছাড়া চলতি বছরে পৌর ও ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির দাবি করলেও এ ইস্যুতে শক্ত প্রতিবাদ গড়তে পারেনি বিএনপি। উল্টো ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এরও কোনো সুরাহা করতে পারেনি দলটি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতার পক্ষের সকল মানুষ এমনকি বিএনপির অনেক প্রভাবশালী নেতাও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য আহ্বান জানালেও দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তা গ্রহণ করেননি। অস্তিত্বের সঙ্কটে থাকা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই তিনি আগামী দিনের রাজনীতির পথে হাঁটতে মরিয়া। বিদায়ী বছরে একটি আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে রাজপথে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। দু’তিনটি সমাবেশ, আর প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে দলটির কয়েক নেতার সরকারবিরোধী বক্তব্যে ছাড়া আর কোন অর্জনই নেই দলটির। তবে বছরের শেষভাবে এসে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন কিছুটা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ইসি গঠন নিয়ে তাঁর প্রস্তাবনায় কৌশলে জামায়াত-ফ্রিডম পার্টি, মুসলিম লীগসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আহ্বান নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় উঠে। সবশেষ সংলাপের শুরুর দিন বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে ওই প্রস্তাবগুলোই নতুন করে তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতারা রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ফলপ্রসূ দাবি করলেও নানা সূত্রই নিশ্চিত করেছে যে, নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের কোনই সম্ভাবনা নেই। মোর্দা কথায়, যে এক বুক হতাশা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা বছরটি শুরু করেছিল, বছরের শেষভাবে সেই হতাশা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি ছাড়া দলটির হাইকমান্ড তাদের আর কিছুই দিতে পারেনি। ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ অবস্থা জাতীয় পার্টির দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টির অবস্থা হয়েছে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ প্রবাদের মতোই। বিদায়ী বছরটিতে এই দলটির নেতারা ক্ষণে ক্ষণে ভোল-পাল্টানোর রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। নির্বাচন বর্জনের বিএনপির ভুলের মাশুল জাতীয় পার্টিকে সরকার ও বিরোধী দলে একসঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ এনে দিলেও তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। জাতীয় পার্টির কা-ারী কে- রওশন নাকি এরশাদ? এমন প্রশ্নে বছরজুড়েই বিভক্ত থেকেছেন জাতীয় পার্টির নেতারা। আর স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের কারণেই বিদায়ী বছরেও বিরোধী দলের উপনেতা নির্বাচন করতে পারেনি দলটি। সংসদের ভেতরে-বাইরে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সরকারের ভাল কাজগুলোর প্রশংসা করলেও দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তাঁর দ্বৈত রাজনীতির চরিত্র বদলাতে পারেননি বিদায়ী বছরেও। আর এসব কারণেই দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছে দলটি। লাঙ্গনের দুর্গ বলে খ্যাত বৃহত্তর রংপুরেও এরশাদের জনপ্রিয়তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু করেছিল বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল খোদ এইচ এম এরশাদকে। রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘোষণা দিয়ে দলের মহাসচিবের পদ হারাতে হয়েছে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফের দলের মহাসচিব ঘোষণা করেন সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ। এদিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হন জাপার এমপি এম এ হান্নান। যদিও তাকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছে। এ বছর দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয় রওশন এরশাদকে এবং জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে পার্টিতে ক্ষমতার লড়াই আপাতত অবসান করেন এরশাদ। আহসানউল্যাহ মাস্টার হত্যা মামলার দ-প্রাপ্ত আসামি নূরুল ইসলাম দিপুকে দলের যুগ্ম মহাসচিব করার সমালোচনার মুখে পড়তে হয় জাতীয় পার্টিকে। বিরোধী দলের প্রধানের সঙ্গে বিদেশী অতিথিরা সাক্ষাত না করায় ক্ষোভ জানান এরশাদ। এক্ষেত্রে অতিথিদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে বিএনপি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে কোন প্রার্থী দিতে না পারায় নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। তবে আগামীকে একক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলপ্রধান এরশাদ। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের প্রথম দিনে জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে মহাসমাবেশ করবে বিরোধী দল। খাদের কিনারে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত ২০১৫ সালে জামায়াত-শিবিরের ভয়াল তা-ব-সহিংসতা ও জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পৈশাচিকতা দেশবাসীর মনে এখনও দাগ কেটে রয়েছে। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে একাত্তরের ঘাতক দলটির উল্লাস নৃত্যও দেখেছে বিশ্ববাসী। সেই বীভৎস আন্দোলনে পরাজিত হওয়ার পর বিদায়ী একটি বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশের কোথাও সামান্যতম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। একদিকে জামায়াতের বাঘা বাঘা নেতাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে, অন্যদিকে শত শত মামলায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকেই বছরটি পার করতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর একথায় গভীর খাদের কিনারে অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এই সংগঠনটি। বিদায়ী বছরে আন্দোলন করা তো দূরের কথা, প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়াতে পারেনি দলটির নেতাকর্মীরা। বছর ধরেই আত্মগোপনে থেকে দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র করলেও সরকারের কঠোরতার সামনে টিকে থাকতে পারেনি দলটি। বরং বছরজুড়েই দেশব্যাপী জামায়াত নিষিদ্ধের দাবির মুখে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মহাতঙ্কে ভুগছে আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা। সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, কাদের মোল্লা ও সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর রাজপথে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়েছে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তরা। জামায়াতের সকল শীর্ষ নেতার অধিকাংশই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, ছয়জনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। অনেকেই আমৃত্যু কারাভোগের সাজা খাটছেন। দেশের অনেকস্থানেই ভয়াল সহিংসতা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের জনগণ ঘেরাও করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক জঙ্গী শিবির ক্যাডার প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অনেক সিনিয়র জামায়াত নেতা অসুস্থতার নাম করে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। আর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় নেতৃত্ব ও অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যেই একটি বছর পার করেছে যুদ্ধাপরাধী এই দলটি। সভা-সেমিনার ও বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ বামদলগুলো বিদায়ী বছরেও রাজপথে তেমন কোন তৎপরতা ছিল না বহুধাবিভক্ত দেশের বামপন্থী দলগুলোর। তেল-গ্যাস ইস্যুতে সিপিবি ও বাসদ ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু কর্মসূচী পালন করলেও বাকি দলগুলোর তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি বিদায়ী বছরে। সভা-সেমিনার আর বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল বেশিরভাগ বাম দলের কর্মকা-। এছাড়া বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা বছরের বিভিন্ন সময়ে নেয়া হলেও তা সফল হয়নি। আবার জনসমর্থন হারিয়ে অনেক বামপন্থী দল এখন কার্যত নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। একমাত্র সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ছাড়া রাজপথে অন্য বাম দলগুলোর অস্তিত্ব খুব একটা দেখা যায়নি।
×