ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাকিদ হায়দার

বক্র

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

বক্র

জেলের তালা ভাঙবো বলে যাদের সঙ্গে চকবাজারে যাবার কথা ছিল, তারা আমাকে ফেলে রেখে কখন যে চলে গিয়েছে, ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি, অথচ আরমানিটোলার আবদুর রহমান ছাত্রাবাসে ৯ নম্বর রুমে গাজী আজিজুর রহমান, আর দেলোয়ার মোরশেদ থাকলেও আমি আর হরিপদ থাকি ২৫ নম্বর রুমে, রুমটা অন্ধকার তাই আমরা দু’জন ইচ্ছাকৃতভাবেই ওই রুমটিকে বেছে নিয়েছিলেম, গাজী আর দেলোয়ারকে না জানিয়ে। আমাদের রুমটার প্রধান সুবিধে, ওই দিকটায় কোন ছাত্রই যায় না, রুমটার পাশ দিয়ে আরমানিটোলার বাসিন্দাদের যাবতীয় নোংরা, নিয়মিত ভেসে না যাবার কারণে, যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি, সেই দুর্গন্ধের কারণেই আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ আসে মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ আসলেও, মাস দেড়েক এদিকে আর না আসায়, ভালই হয়েছে, তাতে হয়েছে আমাদের সুবিধে। হরিপদ খুব ভাল বোমা বানাতে পারে, আর ৯ নম্বর রুমের গাজী খুব ভাল লিখতে পারে, পোস্টার, ব্যানার, দেলোয়ার শুধু সাদা কাগজে লিখে দেয় পোস্টারের শরীরে কোন্ কথা লেখা হবে। ব্যানারের ডানদিকে থাকবে শেখ মুজিবের ছবি, রাত বারোটা একটার দিকে আমরা চার বন্ধু বেশ কিছুদিন মেতে আছি, পোস্টার আর ব্যানার লেখায়। ৯ নম্বর রুমে। আমাদের আরেক বন্ধু আশরাফ নোমান নামে বন্ধু হলেও প্রকাশ্যে কিছু না বললেও আমাদের চার বন্ধুর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্যরকম। তার চলাফেরার প্রকৃতিটাও আমাদের কাছে কেমন যেন সন্দেহজনক। নোমানীর পিতা অনেক আগে, একদিন ঝিনাইদহ থেকে এসেছিলেন এই ছাত্রাবাসে যেবার নোমানীকে আমরা ভর্তি করেছিলেম হাসপাতালে, অসুস্থ বন্ধু, বলেছিলেন, আমরা যেন তার পিতাকে ঝিনাইদহে খবর দেই। খবর পেয়েই বন্ধুর পিতা এসেছিলেন নোমানীর বোনকে সঙ্গে নিয়ে। পরে জেনেছিলেম। নোমানীর মা-মারা গেছেন। বলেন, তবে পিতার সংসারে তিনি অনুপস্থিত। পিতা ব্যবসা বাণিজ্য ফেলে রেখে, আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের বড় নেতা হয়েছেন, প্রায় সারাদিন কাটিয়ে দেন, বিভিন্ন বক্তৃতায়, মঞ্চে। সেই মঞ্চেই দাঁড়িয়ে কিছুদিন আগে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, আইয়ুব আর মোনেমকে বলেছি, কিছুতেই শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া যাবে না, দিলেই সোনার পাকিস্তানকে তিন টুকুরো করে ছেড়ে দেবে, ভারতের দলিলে হিসেবে তাকে যেন জেলেই পচে মরতে হয়। প্রয়োজনে ফাঁসির দড়িতে ...পরের কথা না বললেও শুধু বলেছিল পিতার কথা অমৃত সমান। সোনার পাকিস্তান কিছুতেই ভাঙতে দেয়া যাবে না। আমরা চারবন্ধু সেইদিন থেকে এড়িয়ে গেলেও নোমানী ঠিকই খবর রাখত আমাদের গতিবিধির দিকে দৃষ্টি ছিল তার। একদিন হরিপদ জানালো তার স্কুল জীবনে নরসিংদীর গোপেশ মালাকারের নিকট থেকে হাতবোমা বানানো শিখেছে, কালীপূজার রাতে তারই বানানো ‘তুবড়ি’ ‘ছুঁচো,’ ‘হাউই’ এমনকি ‘তারাবাতি’ দিয়ে সে বছর কালীপূজার রাতে তার বানানো বোমায় আমাদের শিবপুর গ্রামের লোকজন নাকি ভীষণ ভয় পেয়ে কেউ কেউ বলেছিলেন গোপেশ মালাকারের বোমার চাইতেও শক্তিশালী বোমা কে বানিয়েছে, সে খবর দুই একদিনের ভেতরেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল শিবপুরবাসীর নিকট। নরসিংদী ইস্টেশনে এসে দাঁড়াতেই হরিপদকে একজন অচেনা লোক, তাকে অনুরোধ করেছিলেন, সেই অচেনাকে কয়েকটি বোমা বানিয়ে দিতে হবে, হরিপদ সরাসরি বলেছিল আমি বোমাটোমা বানাতে পারিনে, পারে চরমনোহরিদীর সুরেশ মালাকার। অচেনার মতো অনুরোধেও, সেদিন রাজি না হলেও, আজকে নিজের মনের তাগিদেই দেলোয়ারকে বলল চল চকবাজারেÑ কেন দরকার আছে সে যাত্রায় দেলোয়ার না গেলেও আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, চকবাজারের একটি দোকানে, হরির এবং দোকানির কথাবার্তায় আমি বুঝতে পারলেম দুজনাই দু’জনার পূর্ব পরিচিত, তারপরে ও খুবই নিচু স্বরে, হরিপদ দোকান মালিককে কি যেন বলায়, দোকানি বললেন, এক ঘণ্টা পরে আসেন, তবে আপনার বন্ধুটিকে সঙ্গে না আনলেও চলবে। মালমসলা আমি ঠিক প্যাক করে রাখব। ঘণ্টা খানেক পরে। হরি ফিরে এলো, তবে ওর হাতে তেমন কোন বড় প্যাকেট না দেখায় জিজ্ঞাসা করলাম। তোকে তো দোকানি প্যাকেট দেয়ার কথা বলেছিল- আমাকে থামিয়ে দিয়ে হরি জানালো, আমি দোকানে যাইনি, গিয়েছিলেম চকবাজারের সেন্ট্রাল জেলের সামনের বাড়ির দোতলায়। ওই দোতলায় আমাদের শিবপুরের অসিতদা থাকেন, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জাঁদরেল সদস্য। মণি সিংয়ের খুব কাছের মানুষ, সেন্ট্রাল জেলের সামনে যেহেতু অসিতদার সঙ্গে দেখা, তিনিই জোর করে নিয়ে গেলেন তার ডেরায়। গিয়ে দেখি অনেক অনেক পোস্টার। লেখা দেখলাম, শেখ মুজিবকে আনবো জেলের তালা ভাঙবো পদ্মা-যমুনা হরিকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, তুই কী একদিন আমাকে তোর অসিতদার নিকট নিয়ে যেতে পারবি? হরিপদ কিছু না ভেবেই জানালো, ঠিক আছে কালকেই নিয়ে যাব তোকে, তবে অসিতদা ভীষণ ব্যস্ত মানুষ, তাকে নাকি পুলিশ খুঁজছে জানালো আমাকে, তুই যদি কখনও সেন্ট্রাল জেলের ঠিক বিপরীতের বাড়িটির দিকে একবার তাবাস, দেখবি সব জানালাগুলো বন্ধ। ওই বন্ধ জানালার খবরাখবর, শুধু পার্টির লোকেরাই জানে, আর এখন জানলি তুই, তবে কাউকে বলিসনে। চকবাজারে, সন্ধ্যার পরে যাব- তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব, তবে তুই থাকবি বেগম বাজারের রেহানা সু কোম্পানির কোনায় দাঁড়িয়ে, সেই সন্ধ্যাতে হরিপদ আমাকে গিয়ে নিয়ে যাবার সময় বলল, নোমানীকে কয়েকদিন দেখছিনে হারামজাদা গেলটা কোথায়। খিলগাঁওয়ে নাকি এক ফুফু থাকে হয়তো সেখানে গেছে হাঁটতে হাঁটতেই হরি জানালো। ওকে খুব সন্দেহ আমার। ও কিন্তু সব সময়ই খোঁজখবর রাখে আমার আর তোর, তবে সে খোঁজখবরটি সুবিধেজনক নয়। আমাকে জানিয়েছে গাজী। কথা শেষ হতে না হতেই কিছু লোকের কথা শুনতে গেলাম, সেই লোকের ভেতর থেকে একজন বললেন, শেখ সাহেবকে আজ সন্ধ্যায়ই মুক্তি দেবে। জেলগেটে নাকি একটু পরেই আসবে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দেখে এলাম হাজার হাজার লোক, নিজ কানে শুনে এলাম জেলের তালা ভাঙবো- শেখ মুজিবকে আনবো, তোমার আমার ঠিকানা- পরের কথাগুলো আর শোনা হয়নি। হরিপদ চলার গতিটাকে কমিয়ে দিয়ে ইতিউতি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ওই মসলার দোকানে আজ আর যাব নয়, সময় সুযোগ বুঝে কালপরশু গিয়ে টাকা কয়টা ফেরত নিয়ে আসব-হরিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলি কেন? ও জানালো শেখ সাহেবের মুক্তি দিন কয়েকবারে হলে আমি তাঁকে স্বাগতম জানাতাম, আনন্দ উৎসব করতাম, তুবড়ি জ্বালিয়ে আর বোমা ফাটিয়ে। ছাত্রাবাসে ফিরে দেখি, কেউ নেই, আমাদের ২৫ নম্বরের ঘরের দিকে যেতেই কামরুন নাহার স্কুলের পূর্বদিক থেকে মাইকে শুনতে পেলাম, জেলের তালা ভেঙেছি শেখ মুজিবকে এনেছি, গগন বিদারী সেই শব্দের ভেতরেই, দেলোয়ার ছুটে এসে জানালো, শুনে এলাম পাকিস্তানের নূতন প্রেসিডেন্টের নাম ইয়াহিয়া খান। একটু আগেই আইয়ুব খান পদত্যাগ করেছে। দেলোয়ার হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন মাইকের গর্জনে পুরোটি আর শোনা হলো নয়, শুধু বার বার শুনতে পেলাম, ভেঙেছি, এনেছি। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থেকে দিন কয়েক পরে গাজীর এক ভগ্নিপতি এসে জানালেন, দেবহাটি, আশাশুনি, বুড়ি গোয়ালিনী, এমনকি শ্যামনগরের, পশ্চিম দিকের সুন্দরবন এলাকায় নাকি বেশ কিছুদিন যাবত নতুন নতুন মুখের, চেহারার মানুষ দেখা যাচ্ছে, তারা নদীতেই থাকে, আর এক ধরনের রেডিও দিয়ে কথাবার্তা বলে, তবে বাংলায় নয়, স্থানীয়দের ভেতরে শ্যামনগরের মোস্তফা ইতোমধ্যেই নাকি জানতে পেরেছে ওই সকল লোকজন এসেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, কেন এসেছে, কিসের জন্য এসেছে, সে খবর ভাসা ভাসা শুনেছে বাওয়ালীদের নিকট থেকে। সেই দিনের সেই সন্ধ্যার আলো আধারিতে গাজীর ভগ্নিপতি আরও জানিয়েছিলেন শেখ সাহেব ছাড়া পাবার পর থেকেই বাজারে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকেরা, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আর থাকবে না। তার জন্য যদি সংগ্রাম করতে হয় এদেশের জনগণ তাই করবে। পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান নাকি সেই কথা শুনেই খুলনা, বরিশালে, এমনকি চট্টগ্রামের নদী-বন্দরে কিছু লোক পাঠিয়েছে, তারা নাকি সমুদ্রের মাঝে একখানা জাহাজ দাঁড় করিয়ে রেখেছে, দেলোয়ার ভগ্নিপতিকে থামিয়ে দিয়ে বলল। সবই গুজব, হরিপদ বলল- যদি সত্যি সত্যিই পূর্ব পাকিস্তান একদিন আলাদা হতে চায়, আর তার জন্য যদি শেখ সাহেবের হুকুমে আমাকে যদি পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, আর আমাদের পার্টিপ্রধান মনি সিং যদি বলেন, তোরা যা শুনেছিস, সবই ঠিক শেখ সাহেব অনেক সহ্য করেছেন, পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার- হঠাৎ কোথা থেকে নোমানী এসে পড়ায়, আমাদের আলাপ এগুতে না পারলেও নোমানী জানালো ঝিনাইদহে মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের মারামারি হয়েছে। মিতাকে পাঠিয়েছে হাসপাতালে, আমি কালকেই চলে যাব, ঝিনাইদহে, আমার রুমের চাবি, কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধু বলল। আওয়ামী লীগারদের দেখে নেব, যদি সুযোগ আসে কোনদিন, আর আমি তো খুব ভাল করেই জানি। তোরা সকলেই হরিপদর লেজুড়, ওদের উসকানিতে কান দিসনে, দিলেই সোনার পাকিস্তান দুই টুকরো করে ছাড়বে ওই ইন্দিরা গান্ধী। নোমানীর কথা শুনে, আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওর শার্টের কলার ধরতেই, ভগ্নিপতি আমাকে থামিয়ে দিয়ে, নোমানীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে জানিয়ে দিল- উত্তেজিত হবার কিছুই নেই, রাজনীতি করলে, জেলজুলুম, সভাসমিতি, সভাতে বিপক্ষের নেতার বিরুদ্ধে কিছু বললেই মারামারি হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়তো তাই হয়েছে তোমাদের ঝিনাইদহে। ভগ্নিপতি সে রাতে আমাদের ২৫ নম্বরেই রাত কাটাবেন বলে জানালেন, আরও জানালেন, তোমাদের নেতা যেমন শেখ মুজিব, আমার নেতা হলো বিখ্যাত চারু মজুমদার। আগে মওলানা ভাসানী ছিলেন আমার নেতা, পরে দেখলাম, ভূমিহীনদের প্রতি আমার কিছু কর্তব্য আছে, যেদিন শুনলাম, পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বাড়িতে, নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন চারু মজুমদার, ধনিক শ্রেণী, জোতদার যারা, দীর্ঘকাল ধরে শোষণ করে আসছে তাদের বিরুদ্ধেই নাকি নকশাল বাড়ির আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের ভেতর থেকে খুবই শিক্ষিত ছেলেদের নিয়ে নকশাল বাড়ি আন্দোলন নাম দিয়ে নতুন পার্টি বানিয়েছে চারু মজুমদার। আমি জোতদারদের উচ্ছেদ করার পক্ষে। ততোক্ষণ দেলোয়ার চুপচাপ থাকলেও, সে প্রতিবাদ জানিয়ে ভগ্নিপতিকে জানালো, ওইসব চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিয়ে আপনাদের সুন্দরবনের আশপাশ দিয়ে যারা নদীতে থাকছে, ঘোরাফেরা করছে, তাদের আগে উচ্ছেদ করুন। তারপরে ধনী, আর জোতদারদের। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ভগ্নিপতি থেমে গিয়ে বললেন- কথা তো ঠিকই বলেছেন দেলোয়ার সাহেব, কিন্তু ওদের তাড়াতে গিয়ে যদি যুদ্ধ বেধে যায়, আমি বললাম যদি যুদ্ধ বেধেই যায় কোনদিন, আর যদি শেখ সাহেব বলে দেন, ওই সকল পাকিস্তানী-ফাকিস্তানীদের জায়গা আমার দেশে আর নয়, তক্ষনি আর কেউ না গেলেও, পাকিস্তানীদের কবর খুঁড়ব এই দেশের মাটিতে। নকশাল ভগ্নিপতি, গাজীকে লক্ষ্য করেই বললেন, দেশে একটি গ-গোল হবে বলে টিপু ভাই জানিয়েছেন। হরিপদ জানতে চাইলেন, টিপু ভাই লোকটিকে, ভগ্নিপতি জানালেন, ওই যে, পাবনার টিপু বিশ্বাস, আমাদের কমরেড। সে রাতেই নাকি রেডিও পাকিস্তানের এক খবরে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের কোন অন্যায় আবদার ইয়াহিয়া সরকার শুনবে না। যদিও আবদুর রহমান ছাত্রাবাসে রেডিও না থাকলেও, খবরটি একান-সেকান হতে হতে সেই রাতেই পৌঁছালো, ছাত্রাবাসের ৯ নম্বর কক্ষে। সকাল বেলা হরিপদ জানালো ভগ্নিপতি যাবার সময তাকে বলে গেছেন, দেলোয়ারের কথাটি তার খুবই পছন্দ হয়েছে, তাই তিনি কাল-পরশুর ভেতরে চলে যাবেন সুন্দরবনের আশপাশে নদীতে ভাসমান লোকগুলোর খোঁজখবর নিতে, যদি ভগ্নিপতি বুঝতে পারেন, লোকগুলো বাঙালীর শত্রু, তাহলে তিনি ফিরে এসে আমাদের দুজনকে নিয়ে যাবেন সুন্দরবনে, যদি গাজী আর দেলোয়ার যেতে চায় ওদেরকেও সঙ্গে নেয়া যেতে পারে। কয়েক মাস পরে ঢাকায় এসে, ভগ্নিপতি, সুন্দরবনের আশপাশের অনেকগুলো গ্রামের নাম করে জানালেন, তিনি নিজে গিয়ে অচেনা অজানা কিছু লোককে দেখেছেন, গিয়েছিলেন বাওয়ালী সেজে মধু বিক্রি করতে, তক্ষনি ভগ্নিপতির সন্দেহ জেগেছিল, লোকগুলোর কুমতলব আছে, এবং তাদের হাতের ওয়ারলেস, রেডিওতে কাকে যেন উর্দুতে বলতে শুনেছিলেন, হারামি বাঙ্গালী লোগ, রেস ফোর্স মে-। পরের কথাটুকু আর বুঝতে পারেননি তিনি, মধু বিক্রয় করলেও নৌকার লোকগুলো টাকা না দিয়ে তাকেও নাকি বলেছিলেন ‘বাঙ্গালী লোগ নিমকহারাম।’ ভগ্নিপতি যখন ফিরে শ্যামনগরের নিজবাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন তখন তিনি শুনতে পেলেন, কে যেন- বলছে, শেখ সাহেব নাকি বলেছেন যুদ্ধে যেতে। ভগ্নিপতি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না কেন যুদ্ধে যেতে হবে। গাজী আজিজ, দেলোয়ার, হরি আর আমাকে বলল ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ নয়, আমি কালকেই সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে চলে যাব। তোরা যার যার দেশে চলে যা শেখ সাহেব সরাসরি বলে দিয়েছেন, এবার আর পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙ্গালীদের থাকা সম্ভব নয়। আমি কোথায় যাব যখন কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলাম না তখন হরিপদ বলল চল নরসিংদী। মনোহরদীতে বড় দিদি থাকে, জামাই বাবু ঢাকার রাজারবাগের পুলিশের কনস্টেবল, মনোহরদিতে প্রায় জোর করেই হরি সেদিন আমাকে নিয়ে এসেছিল। আর হরির জামাই বাবু আগরতলা দিয়ে পালানোর সময়, হরি আর আমাকে নিয়ে আগরতলায় পৌঁছে দিয়েই সেই রাতেই কোথায় যে, কার সঙ্গে পালিয়ে গেলেন, আমরা দু’জনের একজনও জানতে পারিনি, তবে দেশের ভেতরে পাকিস্তানী আর্মি আর বিহারীরা মিলে বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবার আগেই দিল্লী থেকে আকাশবাণীর খবর পাঠ করলেন নীলিমা সান্যাল। খবর পাঠিকা আরও জানালেন সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে, পুলিশ ইপিআর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। হরিপদর জামাই বাবু কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে আমাদের আগরতলায় রেখে সেই যে গেলেন, যুদ্ধের ৯ মাস পরেও যখন ফিরে এলেন না, তখনই জানা গেল, স্ত্রী সুবোধ কুমার মল্লিক, মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হয়েছেন আখউড়া সীমান্তে। হরিপদ, আমাকে জানিয়েছিল, গাজীর মারফতে, সেই সঙ্গে গাজী আরও জানিয়েছিল তার ভগ্নিপতি খায়রুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গিয়েছেন, খায়রুলের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল মাও সেতুংয়ের ছবি, আর টিপুর লেখা একটি চিঠি। চিটির শেষে লেখা ছিল জিন্নাহ সাহেব থাকবেন, সঙ্গে থাকবে জিন্দাবাদ। মুক্তিযোদ্ধাদের অচিরেই পাঠিয়ে দেব ইন্দিরার দেশে।
×