ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী

যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম

কেমন আছেন? আপনার বর্তমান দিনযাপন নিয়ে কিছু বলুন ভাল আছি। মানুষের ভালবাসা নিয়ে পথ চলছি। চিকিৎসক জীবনের বাইরেও অবসর খুব একটা মেলে না। স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুুক্ত আছি। প্রতিদিনই কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে। অনুষ্ঠানে যাই। এভাবেই দিন কেটে যায়। সামাজিক কাজে যুক্ত আছি- এটা আমার জন্যে অনেক আনন্দের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কীভাবে সংশ্লিষ্ট হলেন? ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সাত-ই মার্চের আগের দিন থেকেই উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে কী বলবেনÑতা শোনার জন্য। ৭ই মার্চে আমি এবং আমার স্বামী রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলাম। তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণ শুনে আমরা উপলব্ধি করলাম আমাদের দেশের জন্য কিছু করতে হবে। অনুভব করেছিলাম ‘স্বাধীনতা’ চাই, চাই-ই। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে আমি আমার এলাকা হাজীগঞ্জে চলে আসি। এখান থেকেই আমি ও আমার স্বামী মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিই। আপনার সহযোদ্ধা কারা ছিলেন? আমাদের কমান্ডার ছিলেন জহিরুল হক পাঠান। তাঁর নেতৃত্বেই মধুমতি কোম্পানি গড়ে উঠে। এ দলে সাড়ে তিনশ’ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের মধ্যে ভূঁইয়া মোঃ কলিম উল্লাহ (বিএম কলিম উল্লাহ), সুবেদার আঃ রব, আবদুল গফুর, সুবেদার আঃ সাত্তার (হারিস) প্রকৌ. দেলোয়ার হোসেন, প্রফেসর রতন ছিলেন উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধদিনের একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলুন। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়তাম। আমি পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। আমি যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম। এছাড়াও যেহেতু আমি ডাক্তারি পড়ছিলাম, স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবার ভার ছিল আমার ওপর। অনেক স্মৃতি আছে যুদ্ধ দিনের। তবে ১৯৭১-এর একটি দিনের কথা আমার এখনও বিশেষভাবে মনে আছে। যতদিন বাঁচি, ততদিন এ ঘটনা আমি ভুলতে পারব না। সেদিন ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর। বিকেল বেলা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা সবাই নৌকায় ছিলাম। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন জহিরুল হক পাঠান। সেদিন শাহরাস্তির অফিস চিতোষীতে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আমাদের যোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে আমরাই বিজয়ী হই। ক্যাম্প দখল করা হলে আমাকে যখন খবর দেয়া হলো, আমি ক্যাম্পের ভেতরে গেলাম। আগেই আমাদের কাছে খবর ছিল এ ক্যাম্পে পাকিস্তানীরা কয়েকজন মেয়েকে ধরে এনেছে। যখন আমি ভেতরে গেলাম, দেখলাম ক্যাম্পের একটা অংশে কতগুলো মেয়ে, তাদের গায়ে কোন বস্ত্র ছিল না, সারা শরীরে পাশবিক নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন। পরবর্তীতে আমি আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তাদের জামা নিয়ে মেয়েদের পরতে দিলাম। ঐ সময় আমার সঙ্গে কোন ওষুধপত্র ছিল না। আমরা তখন মেয়েদের নিয়ে পানিয়ারার দিকে চলে গেলাম। সেখানে ক্যাম্পে আমি তাদের সেবা-শুশ্রƒষা করি। জানা গেল মেয়েদের বাড়ি চাঁদপুর পার্শ্ববর্তী জেলা শরীয়তপুরে। তারা সুস্থ হলে তাদের যখন বললাম, তোমরা বাড়ি যাও। আমার কথা শুনেই কয়েকটা মেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল। বলল, আমাদের তো আমাদের পরিবার গ্রহণ করবে না। সমাজও আমাদের নেবে না। পরে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমরা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেই। এই ঘটনাটা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। যুদ্ধের সময় আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার যোগান কীভাবে হতো? আমরা নৌকায় থাকতাম। মাঝে মধ্যে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠতাম। তবে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠা বিপজ্জনক ছিল। নৌকায়ই বিশেষত খাওয়া-দাওয়া করতাম। বেশিরভাগই আলুর তরকারি। কখনও সখনও মাছ খেতাম। আত্মীয়রা গোপনে তরি-তরকারি এনে দিতেন। সেসময় কোনমতে খেয়ে-পরে ছিলাম। আমাদের মাঝি ছিল এরশাদ। ওই রান্না করত। যুদ্ধের পর কী করলেন? আগেই বলেছি, যুদ্ধের সময় আমি মেডিক্যালের ছাত্রী ছিলাম। যুদ্ধ শেষ হলে আমি ডাক্তারি পাস করি। তারপর চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। এখনও এ পেশায়ই আছি। যুদ্ধের সময় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে? অনেকের সঙ্গেই এখনও যোগাযোগ আছে। আবার অনেকে তো এখন নেই। একটু আগে যে নৌকার মাঝি এরশাদের কথা বললাম, ও এখনও মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে। আমি সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। প্রকৌ. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গেও আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযোগ্য সম্মান দিচ্ছে। সরকারের কাছে নতুন কোন প্রত্যাশার কথা কি কিছু বলবেন? বঙ্গবন্ধু কন্যা মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযোগ্য সম্মান দিচ্ছেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেÑএটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। সরকারের কাছে আমার আর কোন দাবি-দাওয়া নেই। আমি বেঁচে থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে পেরেছি, রাজাকারদের ফাঁসি দেখেছিÑএজন্যে আমি শেখ হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার কেবল একটিই প্রত্যাশা, বাকি যেই যুদ্ধাপরাধীরা আছে, তাদের বিচারের কাজও যেন দ্রুত শেষ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারে মুক্তিযোদ্ধাদের কী করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানুষের মাঝে যেভাবে মুক্তিযোদ্ধারা সঞ্চারিত করতে পারবেনÑঅন্য কেউ সেভাবে পারবেন না। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারাই তো রণাঙ্গনে ছিলেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও কদর্যতা তারাই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন। আমরা কেউ মা হারিয়েছি, কেউ বাবা, পুত্র, কন্যা, কেউ স্ত্রী, সংসার। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে সেটা মুক্তিযোদ্ধারা ভাল জানেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সেমিনারে, বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, লেখালেখির মাধ্যমে তারা তাদের ত্যাগের কথা, হানাদারদের শোষণের কথা তুলে ধরতে পারেন। তাহলে নতুন প্রজন্ম একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানবে, তেমনি উপলব্ধি করবে স্বাধীনতার জন্যে সেসময়ে বাঙালীরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিল। এই বিষয়টি যখনই কোন তরুণ উপলব্ধি করবে, তখন তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অমোচনীয়ভাবে সঞ্চারিত হবে। বর্তমান বাংলাদেশকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। যেই সোনার বাংলাদেশ পাওয়ার জন্যে আমরা যুদ্ধ করেছি, সেই সোনার বাংলা গঠনের কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আগামী দশ-পনেরো বছরের মধ্যেই আমরা সোনার বাংলায় বসবাস করব। আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাব। বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে ভাল করছে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এখন বাংলাদেশ ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ছোঁয়া আমাদের আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন ঘরে বসে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। খাদ্যের নিশ্চয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব বিষয়গুলো আমাকে আপ্লুত করে। আপনি তো ২০১২ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। এ পদক প্রাপ্তির অনুভূতি সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন। স্বাধীনতার এতো বছর পর স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করেছেÑএটা ভাবতেই ভাল লাগে। স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি আমাকে আনন্দিত করেছে। আমাকে এই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। বর্তমান সময়ে নারীদের আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? একটা সময় ছিল নারীদের পদচারণা বাসন-কোসন মাজা আর রান্না-বান্নার ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের সঙ্গে নারীরা পাল্টেছে। তারা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, চাকরি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। আমি বলবো, দশ-পনেরো বছর আগেরকার সময় থেকে নারীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে জানে। নারীদের এগিয়ে চলার পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা আপনার চোখে পড়ে? নারী বৈষম্য বাংলাদেশে আইনগতভাবে দূর হয়েছে। কিন্তু মনের বৈষম্য এখনও দূর হয়নি। নারীর কোন কীর্তিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিবাদন জানানোর পরিবেশ এখনও ভালভাবে সৃষ্টি হয়নি। তবে আমার মনে হয়, আগামী ক’ বছরের মধ্যেই এ অবস্থার উত্তরণ ঘটতে পারে। তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের বাংলাদেশ। আর তরুণ তরুণীরাই এ দেশের প্রাণশক্তি। তারা স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। তারা স্বাধীনতার চেতনা যেমন সঞ্চার করবে, তেমনি অন্যদের মাঝে সঞ্চারিতও করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলেই সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে। বিজয়ের মাসে আপনাকে জানাচ্ছি অশেষ শ্রদ্ধা ও সালাম। সময় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তোমরা এসেছ, আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছ, সেজন্যে তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
×