ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইমরান চৌধুরী

কালো গোলাপ

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

কালো গোলাপ

বাসর রাতে আমি ঘুমাইনি। এটা কোন বলার মতো ঘটনা না। সব অনুষ্ঠান শেষ করে স্বামী-স্ত্রী নিজের ঘরে আসতেই রাত প্রায় শেষ হয়ে যায়। বাকি থাকে সামান্য। সেই সামান্য রাতে যারা ঘুমায় তারাই বরং গল্পের বিষয়বস্তু হতে পারে। জেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জেগে থাকাটা স্বাভাবিক নয়। আমি বারান্দায় বসে আছি। আমার নববিবাহিতা স্ত্রী রুমের ভেতর। আমাদের পরস্পর দেখা হয়েছে মাত্র কয়েক মিনিট। কথা হয়েছে একটি বাক্য। বাক্যের মধ্যে শব্দ ছিল দুটি। আমার কিছু বলার প্রয়োজন পড়েনি। রুম ছেড়ে বারান্দায় আসার সময় স্ত্রীর অনেক কান্না শুনেছি। এখন কী করছে জানি না। আমি যখন বারান্দায় তখন রাত প্রায় ২টা। এখন ভোর ৫টা। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই। মদও খাই না। কফি খাই। খুব কফি খেতে ইচ্ছা করছে। উপায় নেই। কারণ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাছাড়া আমি যে জেগে আছি সবাই জানুক সেটা আমি চাই না। ঘরের মধ্যে শুধু দু’গ্লাস দুধ রাখা আছে। ঠা-া হয়ে জঘন্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। খাবার অযোগ্য। পানির জগটা নিয়ে এসেছি। যখন গলা একদম শুকিয়ে যাচ্ছে তখন একটু করে পানি খাই। বেশিও খেতে পারছি না। কারণ দুটি, প্রথমত জগের পানি শেষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত ওয়াশরুমে যেতে হবে। সেটা রুমের ভেতরে। আপাতত রুমের ভেতরেও যেতে চাচ্ছি না। নিঃসন্দেহে বিয়ে সবার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমার জীবনে তো বটেই। পশ্চিমা দেশগুলোয় ছাড়াছাড়ি তেমন কোন ব্যাপার না। আমাদের দেশে এখনও সে পর্যায়ে যায়নি। বিয়ে নামক ঘটনাটা একবারই ঘটে এবং আজীবন ধারণ করতে হয়। আমার ধারণাও তাই। সেভাবেই আমার বেড়ে ওঠা। বিয়ের ব্যাপারে আমার থেকেও শতগুণ চিন্তা ছিল বাবা-মায়ের। বিশেষ করে মায়ের। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সে হিসেবে ঠিকই আছে। তাদের তো সে ইচ্ছা থাকতেই পারে। আমার মা লিটল জুয়েলস স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। বাবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল। যেহেতু আমি তাদের একমাত্র সন্তান তাই চারটি চোখ সারাক্ষণ আমাকে পাহারা দিত। সব বাবা-মা-ই পাহারা দেয়। আমারটা বোধ হয় একটু বেশি। বাবা চুপচাপ স্বভাবের হলেও মা ছিলেন স্পষ্ট বক্তা। যা যা উনি করবেন, তার বিশদ বিবরণ থাকত। বাবাকে বোঝা যেত না। তবে আমি এটা নিশ্চিত থাকতাম, বাবা কোন ব্যাপারে হ্যাঁ করলে সেটা হবেই। মার কোন কোন কথা হয়তোবা নড়চড় হতো। কিন্তু বাবার কোন কথার ব্যত্যয় হতে আমি দেখিনি। মায়ের কাছেই শোনা গল্প। আমি নাকি ছোটবেলায় সারাদিন ঘুমাতাম আর রাতে জেগে থাকতাম। শুধু জাগা না, চিৎকারে সবার ঘুম হারাম করে দিতাম। তখন বাবা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আমি ঘুমাতাম। মাও ঘুমাতেন। আমি বড় হয়ে নিজে বাবার কাজগুলো দেখেছি। উনি চুপি চুপি কাজ করতে পছন্দ করেন। আমি নিশ্চিত সবাই ঘুমালেও বাবা আজ ঘুমাবেন না। আমার ঘরটি তিনতলায়। আমার নিচের ঘরটিতে বাবা থাকেন। মা ঘুমিয়ে গেলে তিনিও কি পানির জগ নিয়ে বারান্দায় বসে থাকবেন? কেন বলছি, তার কারণ আছে। আমার ডাক্তারি পরীক্ষার সময় প্রায় সারারাত জেগে পড়ালেখা করতাম। মা আমাকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে যেতেন। আমার ধারণা ছিল বাবাও ঘুমিয়ে যেতেন। আমি আমার রুমে বসেই পড়তাম। কোনদিন বারান্দায় যেতাম না। সুন্দর বারান্দাটায় যেতে হলে মায়ের বেডরুমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেজন্যই বোধ হয় এড়িয়ে যেতাম। একদিন খুব ইচ্ছা করল বারান্দায় বসে চা খাব। মা চা বানিয়ে ফ্লাক্সে রেখে দিতেন। চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা বসে আছেন। আমাকে দেখে উনি খুবই অবাক হয়েছেন। তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি আমি। সেদিনই আমি আবিষ্কার করলাম আজ পর্যন্ত আমাকে জাগা রেখে বাবা নাকি কখনও ঘুমাননি। সেজন্যই বলছিলাম আমি নিশ্চিত আজ বাবাও জেগে আছেন। কিন্তু আমার মনে কী দ্বন্দ্ব চলছে সেটা কি বাবা জানেন? আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি বাবা ছায়ার মতো আমার পাশে আছেন। কখনও আমি কোন সমস্যার কথা চিন্তা করতাম না। হোক সেটা কোন দুষ্পাপ্য বই বা কোন খেলনা। বাবাকে রাজি করাতে পারলেই হয়ে যেত। সেটা আমি পেয়ে যেতাম। আমার ধারণা বাবা এমনই একটি সত্তা, যেখানে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু আমার ভেতর যে দ্বন্দ্ব এখন তৈরি হয়েছে, সেটা কি বাবা নিরসন করতে পারবেন? আমার প্রতি বাবার এ যতœ নেয়াটা কখনও কখনও একটু বেশি মনে হয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধের আগের বছরটা। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। সেদিকে কারও মনোযোগ নেই। সবাই উদ্বিগ্ন ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে। আমার বন্ধুরা প্রায়ই মিছিলে যায়। আমারও খুব ইচ্ছা হয়। বাবা-মা ভীষণ ভয় পান। আমি খুব বেশি সাহসী ছিলাম না। তবে আমার বন্ধু যারা সাহসী, তাদের খুব পছন্দ করি। রাতুল আর রুমি সাহসী ছেলে। আমার বন্ধু। ওরা প্রায়ই ক্লাসে না এসে মিছিলে যায়। আমি ওদের গল্প শুনি। ওরা ক্লাসের সব নোট আমার থেকে নেয়। ওদের নোট দিয়ে মিছিলে না যেতে পারার কষ্টটা কমাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রাতুল আর রুমি রেসকোর্সের ময়দানে গিয়ে শোনে। আমি ওদের মুখে শুনেই বুঝতে পেরেছি এত কাছাকাছি থেকেও ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারিনি। আমি হয়ত সেদিন যেতাম। গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা থাকাতে যেতে পারিনি। রাতুল আর রুমি পরীক্ষা না দিয়েই গিয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে। আর আমি ৭ মার্চের ভাষণ না শুনে পরীক্ষা দিয়েছি। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। বাবা বিচক্ষণ মানুষ। ছায়ার মতো আমাকে খেয়াল করেন। যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। আমার মনের অবস্থাও বদলাতে শুরু করেছে। ডাক্তারদের বহু দল যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কেউ কেউ চলেও গেছে। বাবা এগুলো সব খেয়াল রাখেন। একদিন উনি আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দেন। ইংল্যান্ডে এক বছরের একটা ফেলোশিপ। এটা যোগাড় করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে আমার ভাল রেজাল্ট আর বাবার চেষ্টার ফলে। মা তো হাতে চাঁদ পেয়েছেন। সেখানে বড় খালা থাকেন। আমার কোন অসুবিধা হবে না। আসলে কেন এত খুশি সেটা আমি বুঝি। দেশে এখন যুদ্ধ। এ সময় আমি দেশের বাইরে থাকলে নিরাপদ। সেটাই আসল কারণ। আমার আরেকটা দুর্বলতা হচ্ছে বাবা-মাকে ‘না’ বলতে পারি না। আমার যত কষ্ট হোক আমি মেনে নিই। বিদেশে গিয়ে উচ্চ ডিগ্রী নিতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু যখন বন্ধু-বান্ধব, বিশেষ করে মেয়েরাও যুদ্ধে যাচ্ছে তখন উচ্চশিক্ষাটার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? তারপরও গিয়েছি। কষ্ট বুকে নিয়ে কাপুরুষের মতো উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে যাই। বাবা প্রায়ই একটা কথা বলেন। সংসারটা হচ্ছে একটা সমঝোতা। সিরিজ অব কম্প্রোমাইজ। আগে তেমন না বুঝলেও আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি। এখানে স্বার্থ হাসিল না স্বার্থ ত্যাগ, কোনটায় আনন্দ আমি বুঝি না। আমি স্বার্থ ত্যাগেই আনন্দ পাই। মেয়েরাও আমাকে পছন্দ করত। কিন্তু মা এমনভাবে উৎসাহ দেখান যে, আমি বিব্রত হই। সব সময় বলেন, ‘আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে তোর বউ করে আনব। আজেবাজে কোন মেয়েকে কাছে আসতে দেব না।’ সেজন্যও হতে পারে। কোন মেয়ের সঙ্গে আমার কখনও ঘনিষ্ঠতা হয়নি। বউ খোঁজার ব্যাপারটা মায়ের ওপরই ছেড়ে দিই। দেশ স্বাধীন হলো। বহু আত্মত্যাগ হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত গেছে। অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। অনেকের স্বপ্ন ভেঙ্গেছে। সেদিক থেকে আমাদের তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। আমাদের পুরানা পল্টনের বাসাটা লুট হয়েছে। মার সব অলঙ্কার খোয়া গেছে। যুদ্ধের ভয়াবহতার তুলনায় এসব নগণ্য। আমার ডিপ্লোমা শেষ হলো। মা ও তার কথা রেখেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কি-না জানি না; আমি এর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখিনি। আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। আমি দেশে এলেই বিয়ে হবে। বিয়েটা খুব তাড়াহুড়া করেই হয়। তাই বলে ধুমধামের কোন কমতি হয়নি। মেয়ের নাম প্রিসিলা পারভীন। আগে তার শুধু ছবি দেখেছি। ছবির চেয়েও সে সুন্দরী। আগে আমাদের কথা হয়নি। এনগেজমেন্টের দিন সে আমাকে কিছু বলতে চেয়েছে। হয়ত একা একা বলত। সে সুযোগ পায়নি। তখন বুঝতে না পারলেও এখন মনে হচ্ছে তার কথাগুলো আমার শোনা উচিত ছিল। তাহলে ব্যাপারটা এতদূর গড়াতো না। তার আগেই মিটমাট হয়ে যেত। সে হয়ত চেষ্টাও করেছিল। যোগাযোগ করতে পারেনি। আমাদের বাড়িতে এখন অনেক মেহমান। সবাই জাগার আগেই একটা সিদ্ধান্তে আমাকে আসতে হবে। অনেক তো চিন্তা করেছি। এবার সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়েছে। আমি যখন ঘরের দরজা বন্ধ করে একান্তে প্রিসিলার কাছে যাই, আমার মনে হাজারও জিজ্ঞাসা। সব পুরুষের মনেই থাকে। সারাজীবনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। এ মুহূর্তটা সবাই মোকাবেলা করে। আমি করব। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে উত্তরটা পেয়েছি নিশ্চয়ই সেটা স্বাভাবিক নয়। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, প্রিসিলা কেমন আছো? ‘আমি প্রেগনেন্ট’ এ দুটি শব্দ। দুই শব্দ দিয়ে বাক্য হয় কি-না জানি না। তবে জেনেছি বুকের পাঁজর একটাও অক্ষত নেই। তার পরে তার কান্না শুনেছি। আর আমি ভাঙ্গা পাঁজর আর ভাঙ্গা স্বপ্ন নিয়ে সেই পাঁচ ঘণ্টা ধরে বারান্দায় বসে আছি। আর বেশি সময় পাওয়া যাবে না। আমাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। জীবনে প্রথম একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি একা একা। শুধু নিজের জন্য। বাবা-মা কেন কারও পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আমার বিবেক আমাকে গাইড করছে। সেটাই যথেষ্ট। আমি এখন প্রিসিলার কাছে যাব। তাকে বলব, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। নিঃসন্দেহে তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। দুই লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে। তারাও মর্যাদায় সমান। তুমি যদি তাদের একজন হও, তোমার কোন চিন্তা নেই। সারাজীবন শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় আগলে রাখব। আর যদি অন্য কোন কারণ হয় তবে সসম্মানে মুক্তি দেব। যে যুদ্ধ এড়িয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে আর যে যুদ্ধ মোকাবেলা করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মর্যাদায় নিশ্চয়ই দু’জন সমান হতে পারে না। প্রিসিলাকে মর্যাদার আসন দিয়ে নিশ্চয়ই আমি ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি। কাল গোলাপ শুধু তুরস্কে পাওয়া যায়। অটোম্যানদের সৌর্য-বীর্যের কথা সারা পৃথিবী জানে। জানে না শুধু তাদের মা-বোনদের না জানা কষ্টের ইতিহাস। সবগুলো কষ্ট ধারণ করে গোলাপগুলো হয়েছে নাকি কালো। অটোম্যানরা আজ গত হয়েছে প্রায় পাঁচ শ’ বছর। কাল গোলাপ কিন্তু আজও ফোটে। পৃথিবীর সব মানুষ সেই গোলাপ দেখতে যায়। কারণ সেটা বিরল ঘটনা। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদেরও আছে দুই লাখ ৩০ হাজার কালো গোলাপ। সেগুলো দেখা যায় না। যাবে কিভাবে? সেগুলো তো থাকে হৃদয়ে। অনেক সৌভাগ্যবান না হলে সেগুলোর দেখা মেলে না।
×