ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

একটি বিজয় দিবস পালনের ইতিবৃত্ত

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

একটি বিজয় দিবস পালনের ইতিবৃত্ত

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর প্রকাশ্য সভায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করার মতন সাহসী মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না, এমনকি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিষিদ্ধ নাম। আমি ১৯৮৪ সালে কুয়েতের বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে চাকরি নিয়ে যখন কুয়েতে গেলাম তখন ওখানে বাঙালী ছিল ৭০ হাজারেরও বেশি। অথচ বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন একজন জামায়াত নেতা, যিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছর সিনিয়র ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। প্রতিবছরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন এবং ২০০০ হাজার ভোটের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি ভোট তার ভাগ্যে জুটত। তিনিও আমার মতো ফরিদপুরের অধিবাসী ছিলেন। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সুহৃদ ছিলেন। আমি আমার পূর্বপরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে যোগাযোগ করে বললাম, ‘আপনারা থাকতে একজন জামায়াত নেতা কিভাবে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়’। এ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ছিলেন বাংলাদেশ যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক, যিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বছর সিনিয়র ছিলেন এবং তিনিও ফরিদপুরের আমার এলাকার সন্তান। অনেক বছর পর দেখা হওয়ার পর প্রথম আলাপেই শ্রদ্ধা জানালেন আমার বড় ভাই গত বছর প্রয়াত অধ্যাপক আজিজুল হক খানের প্রতি। যার উপদেশ শুনে তিনি যে মিজান আওয়ামী লীগ ছেড়ে মূল আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছিলেন সে কথা আমার সাথে শেয়ার করলেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঠিক করেন রাষ্ট্রদূত, জনগণ নয়’। এরশাদের সামরিক শাসনে তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মেজর জেনারেল। এ ধরনের মোটা বুদ্ধির মানুষ মেজর জেনারেল হতে পারেন বা রাষ্ট্রদূত হতে পারেন সেটা ঐ ভদ্রলোকের সাথে আলাপ না হলে আমি বুঝতে পারতাম না। বিশেষ করে উনার সাথে আলাপের অভিজ্ঞতার পর আমি সামরিক শাসনের সমালোচনা করে কুয়েতের ইংরেজী দৈনিক কঁধিরঃ ঞরসবং-এ এক নিবন্ধ লিখি যার ফলে রাষ্ট্রদূত মহোদয় আমাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আমার পাসপোর্ট বাতিলের জন্য সরকারকে লিখলেন। অবশ্য সে যুদ্ধে আমার পাসপোর্ট বাতিল না হয়ে রাষ্ট্রদূত সাহেব চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। এর পর একটি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দূতাবাসের মিনিস্টার যিনি ১৯৭১ সালে জনাব হোসেন আলীর সাথে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী কলকাতা মিশনের একজন কূটনীতিক। তিনি তাঁর প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধুতো দূরের কথা মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসও স্পর্শ করলেন না। তাঁর ভাষণের পর আমি তাঁকে বললাম, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেপে গেলেন’। তাঁর উত্তর ছিল, ‘ভাই চাকরি করতে গেলে অনেক কিছুই চেপে যেতে হয়। সবাইতো সমান সাহসী হয় না’। এ অতি বিনয়ী কূটনীতিক পরবর্তীতে কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কুয়েতে তখন সবচেয়ে উঁচু পদে চাকরিরত ড. কবীর চৌধুরী (লন্ডন প্রবাসী যিনি ‘৭১ সালে লন্ডনে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধ স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন) যিনি কুয়েত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন এবং জনাব বজলুর রহমানের, যিনি কুয়েত ইকোনমিক ফান্ডে অনেক উঁচু পদে কর্মরত ছিলেন, নেতৃত্বে কুয়েতে বসবাসকারী সকল বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নির্বাচিত হবেন এ উদ্দেশ্যে এক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এ উদ্দেশ্য মূল প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আমাকে একটা গঠনতন্ত্র তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তী রাষ্ট্রদূত একজন ঝানু আমলা জনাব নজরুল ইসলাম আনন্দচিত্তে এ গঠনতন্ত্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং অনুমোদন দেন। (কুয়েতে রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন ছাড়া কোন সংগঠন করার বা সভা করার অধিকার ছিল না)। এ গঠনতন্ত্রের পরিপ্রক্ষিতে কুয়েতে অবস্থানরত হাজার হাজার বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী মানুষের ভোটে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। যেহেতু বেশিরভাগ বাংলাদেশী ছিলেন অদক্ষ শ্রমিক, প্রায় ১০০টি বাস ভাড়া করা হয় তাদের দূতাবাসে এসে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। কুয়েত তথা অন্যান্য দেশের কুয়েতে কর্মরত মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছিল যে দেশে সামরিক শাসন চলছে সে দেশের জনগণ সুশৃঙ্খলভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। আমাদের প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রকৌশলী হাতেম আলী শাহ যিনি আমার থেকে ৫ বছর আগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান করেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে কর্মরত আছেন। আমি যে প্যানেলে ছিলাম সে প্যানেল (২১টি পদ) শতকরা ৭৪ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার উপরে উল্লেখিত যুবলীগ নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা আমার বিপরীত প্যানেলে সহসভাপতি হিসেবে প্রতিদ¦ন্দি¦তা করে পরাজিত হন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসালাম সাহেব পররাষ্ট্র সচিব হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। এই অতি তীক্ষèধী কূটনীতিক আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন, কিন্তু কোনদিন প্রকাশ্য সভায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করেননি। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তিনি বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত হন। তখন আমার ধারণা হলো আমার কাছে নিজের নৈতিক অবস্থান উঁচুতে রাখার জন্য তিনি আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতেন। তখন রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন কিংবদন্তি কূটনীতিক জনাব কে এম শেহাবুদ্দীন যিনি বিশ্বে প্রথম বাঙালী কূটনীতিক যিনি সর্ব প্রথম (৬ এপ্রিল ১৯৭১) বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমার সাথে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের পরিপূর্ণ মিল থাকায় আমাদের দুই পরিবারের মাঝে এক হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তাঁকে কুয়েতে স্বাগত জানিয়ে আমরা বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শত শত বাঙালীর উপস্থিতিতে এক গণসংবর্ধনা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তাঁর দেয়া একটা চিঠি আমি সেদিনের বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঢাকাতে অর্পণ করেছিলাম এবং শেখ হাসিনার জবাবী চিঠি তার কাছে অর্পণ করেছিলাম। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমালে তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। গত বছর অকস্মাৎ প্রয়াত কিংবদন্তি এ কূটনীতিক এ বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মতো একজন মহান দেশেপ্রেমিককে জীবিত থাকাকালীন স্বাধীনতা পদক না প্রদান করাটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য এক চরম দীনতা। আমাদের প্রথম অনুষ্ঠানটি ছিল বিজয় দিবস উদযাপন। পাকিস্তানসহ ১৩ জন রাষ্ট্রদূত এবং কয়েক হাজার হলভর্তি বাঙালীর উপস্থিতিতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমি আমার বক্তৃতায় যখন বললাম, ‘আপনাদের মনে আছে কি ৭ই মার্চের সে বজ্রকণ্ঠ? মনে আছে কি সে বজ্রকণ্ঠের সে উদাত্ত আহ্বানের বাণী ‘আর যদি একটা গুলি চলে...’ ভাষণের এ উক্তির সাথে সাথে হল ভর্তি হাজার হাজার শ্রোতা করতালি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলাম অনেকে আবেগে চোখ মুছছেন ’৭৫ সালের পর ’৮৭ সালে বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর নাম এ প্রবাসে প্রথম উচ্চারণে। রাষ্ট্রদূত মহোদয় প্রধান অতিথির ভাষণেও বিজয়ের পিছনের সত্য ইতিহাস, তিনি কিভাবে তার দুটো শিশু কন্যাকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল, যখন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি, দিল্লীর পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিলেন তার বিবরণ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে এ মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। ‘ইতিহাস কথা কও’ নামের যে গীতি আলেখ্যটি পরিবেশিত হলো সেটিতেও মঞ্চের পিছন থেকে ভেসে আসলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সে অংশটুকু, ‘আর যদি একটা গুলি চলে..., এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। একইভাবে হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার করতালি এবং আনন্দধ্বনিতে বিরাট অডিটরিয়ামটি মুখরিত হয়ে উঠলো। এ অনুষ্ঠানটির বাংলায় ধারা বর্ণনা করেছিলেন আমার স্ত্রী লেখিকা তাসরীনা শিখা ইংরেজীতে করেছিলেন বাংলাদেশের এবং কুয়েতে টিভির বিখ্যাত ইংরেজী সংবাদ পাঠিকা আয়েশা জায়গীরদার। এ অনুষ্ঠানটির সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কুয়েত বিমানবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠান শেষে আমি এবং রাষ্ট্রদূত মহোদয় একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে আমি বললাম, ‘১৯৭৫ সালের পর আপনি বোধহয় প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি হাজার হাজার বাঙালীর উপস্থিতিতে আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ককে স্মরণ এবং শ্রদ্ধা জানালেন, যদিও এখন বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী সরকার দেশ শাসন করছেন। আপনার এ সাহসকে আমি আর একবার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি’। রাষ্ট্রদূত মহোদয় বললেন, ‘’৭১ সালে যখন সব ভয়কে অতিক্রম করেছিলাম, আজকের এ স্বাধীন বাংলাদশে কোন সরকারের রক্তচক্ষুকে আমি ভয় পাই না’। আজকের এ অনুকূল পরিস্থিতিতে সেদিনের সে বিজয় দিবস উদযাপনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকেই অনুধাবন করতে পারবেন না। এ বিজয় দিবসের কথা রাষ্ট্রদূত শেহাবুদ্দীন তাঁর বই অ উরঢ়ষড়সধঃ’ং ঞধষব-এ লিখেছেন, ‘আমি যখন কুয়েতে আসি তখন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ড. মোজাম্মেল খান এবং হাতেম আলী শাহ। ... বাঙালী সমাজের মঙ্গলের জন্য তাঁরা বিরাট অবদান রেখেছিলেন।... তাদের নেতৃত্বে আমি ১৯৮৭ সালে কুয়েতে আসার পর পরই বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন যে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস তুলে ধরে যে বিজয় দিবস উদযাপন করে সেটা আমি কোনদিন ভুলবো না’। মোজাম্মেল খান : ক্যানাডা প্রবাসী অধ্যাপক এবং টরন্টোতে অবস্থিত তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিনেটের স্পীকার।
×