ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাছের রাজা রুপালি ইলিশের সুদিন ফিরেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ অক্টোবর ২০১৬

মাছের রাজা রুপালি ইলিশের সুদিন ফিরেছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রায় অর্ধযুগের দুর্দিন কাটিয়ে মাছের রাজা খ্যাত ইলিশ আহরণ ও বাজারজাতকরণে সুদিন ফিরে এসেছে। চিংড়ির পর এবার অভাবনীয় সাফল্য এসেছে ইলিশের ক্ষেত্রে। ভোজনরসিকরা এবার মন ভরে ইলিশ খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এবারের এ মৌসুমে আকস্মিকভাবে ইলিশ আহরণ বৃদ্ধির নেপথ্যে বৈজ্ঞানিক যে ব্যাখ্যা রয়েছে তা যদি ধরে রাখা যায় তাহলে আগামীতে এর সুফল আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ইলিশ আহরণ বিগত প্রায় অর্ধযুগের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফিশিং বোট, ট্রলার মালিক, ক্যাপ্টেন, ক্রু, মাঝিমাল্লা, গদি মালিক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা থেকে শুরু করে ক্রেতাকূল পর্যন্ত সকলের ইলিশ নিয়ে এবার আনন্দের সীমা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে সাগরের রূপালী সম্পদ খ্যাত ইলিশের হারানো গৌরব ফিরে এসেছে। এটা কাকতালীয় যেমন নয়, তেমনি সাগরের তলদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা এল নিনো বা ফারাক্কার পানি ভাটিতে নেমে আসার প্রভাবে নয়। সাফল্যের নেপথ্যে প্রধান তিনটি কারণ কাজ করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। সেগুলো হচ্ছে, জাটকা নিধনের স্থলে সংরক্ষণ, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার্থে ইলিশ ধরা বন্ধ ও ইলিশের অভয়াশ্রমে নির্বিচারে যে কোন ধরনের আঘাত বন্ধে প্রণীত আইনের কার্যকারিতা এবং পাশাপাশি রয়েছে সুস্বাদু এ মাছ নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ। অসময়ে ইলিশ নিধন বন্ধে ও বংশ বিস্তৃতি ঘটাতে সরকার যে আইনী বিধি বিধান কার্যকর করেছে তাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিও অন্যতম একটি কারণ। এসব কারণে চলতি মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী এলাকা ও চলাচল সুবিধার নদীগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের বিচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে এবার। অনুসন্ধানে জানা যায়, আহরণে নিয়োজিতরা জালভর্তি ইলিশ তুলছে। আর এ ইলিশ চালান পৌঁছে যাচ্ছে ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারসহ ঘাটে ঘাটে। সেখান থেকে গদিতে। পরে গদি থেকে খুচরা বিক্রির জন্য হাটে বাজারে। ব্যাপক হারে ইলিশ প্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইলিশ নিয়ে গত প্রায় সাতাশ বছর ধরে গবেষণারত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর স্টেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আনিছুর রহমান বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, ইলিশের দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে আওয়াজ উঠেছিল। কিন্তু তা সত্য নয় বলে প্রমাণ করেছে এবারের মৌসুম। তার মতে, সরকার ইলিশ নিয়ে আইন করে তা কার্যকর করেছে। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর প্রয়াসে মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তিনি জানান, একটি মা ইলিশ বছরে একবার ১২ থেকে ১৫ লাখ ডিম ছাড়ে। সে ডিম রেণু হয়ে জাটকায় রূপান্তর হয় এবং পরবর্তীতে জাটকা থেকে কৈশোর পেরিয়ে পরিপূর্ণ ইলিশে পরিণত হয়। পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য সময় লাগে এক বছরের সামান্য বেশি। এ পরিপূর্ণ ইলিশ, স্বাদে, গুণে ও মানে যেমনি অতুলনীয় তেমনি আকারও থাকে বড়। একটি পরিপূর্ণ ইলিশের ওজন ক্ষেত্র বিশেষে ২ কেজিরও বেশি হয়ে থাকে। পরিপূর্ণ ইলিশের যে স্বাদ তা ছোট আকৃতিরগুলোতে থাকে না। এদিকে, মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৭-০৮ সালে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার্থে আইন করে কার্যক্রম শুরু হয়। পরের বছর থেকেই সুফল পরিলক্ষিত হয়। এতে করে মৎস্য বিভাগ আরও এগিয়ে যায়। ফলে প্রতি মৌসুমে ইলিশ আহরণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ হাজার টন হারে উৎপাদন বেড়েছে। ২০১১ সালে আইন করে প্রথমে এগারো দিন, পরে সতেরো দিন এবং এবার (১২ অক্টোবর থেকে ২ নবেম্বর) ২২ দিন ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা ইলিশের মজুদ, বেচাকেনার উপরও বলবৎ থাকবে। উক্ত সময়ে সতর্ক থাকবে নৌ, বিমান বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, নৌ পুলিশ, পুলিশ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং এর পাশাপাশি মৎস্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়। সর্বত্র থাকবে ব্যাপক নজরদারি। দফায় দফায় চলবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আনিছুর রহমান আরও জানান, অতীতের পদ্মা নদী ছিল ইলিশের জন্য খ্যাত। এখন সে পদ্মায় ইলিশ কমে গেছে। পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ সুস্বাদু। এর খ্যাতি রয়েছে ব্যাপক। পদ্মায় এবারও ইলিশ কম মিলেছে। তবে মেঘনায় মিলেছে ভাল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মৌসুমে ইলিশের গড় আহরণ ছিল ৩ লাখ ২৭ হাজার টন। এর আগের বছরগুলোতে অর্থাৎ পাঁচ বছর ছিল স্বাভাবিকভাবে কম। ফলে ইলিশ নিয়ে সর্বত্র হৈ চৈ সৃষ্টি হয়। মৎস্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম চালিয়ে প্রণীত হয় সুপারিশ। ইলিশের অভয়াশ্রম নষ্ট করতে না দেয়ার পাশাপাশি কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ, জাটকা নিধন বন্ধ ও প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার কথা বলা হয় সুপারিশে। মন্ত্রণালয় এসব সুপারিশ আমলে নিয়ে পর্যায়ক্রমে তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করায় এবারের মৌসুমে সুফল ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ও ফিশারিজ ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ইলিশ নিয়ে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে আমাদের মৎস্য সম্পদের মধ্যে ইলিশের পরিমাণ ও আহরণ বেড়ে যেতে বাধ্য। ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আনিছুর রহমান জানান, ১৯৯৯-২০০২ এবং ২০০২-২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশে ইলিশর উৎপাদন ১ লাখ ৯৯ হাজার টনে নেমে আসার পর গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় জোরালোভাবে। এতে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসে কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, জাটকা ও মা ইলিশ ধরা এবং এর পাশাপাশি ইলিশের অভয়াশ্রম হুমকির মুখে পড়ে যাওয়া। তিনি জানান, বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ও সংশ্লিষ্ট নদী মোহনা ও নদী অভ্যন্তরে ৮ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়ে আসছিল। যা থেকে আহরিত হচ্ছিল এর অর্ধেক। কিন্তু আহরণের পরিমাণ আরও অর্ধেকেরও কমে নেমে যাওয়ায় শঙ্কার সৃষ্টি হয়। ফলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্র ধরে সরকার সুপারিশ বাস্তবায়ন করে। এতে করে ইলিশের ক্ষেত্রে এবার যে সাফল্য মিলেছে তা অভাবনীয়। সূত্র মতে, আগামী দিনগুলোতে সরকারী সকল পদক্ষেপ ও সম্মিলিত প্রয়াস ইলিশ নিয়ে অব্যাহত থাকলে আহরণের ক্ষেত্রে সর্বকালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইলিশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে সচেতনতা যেহেতু ইতোমধ্যে বেড়েছে এবং এর সুফলতা এসেছে সঙ্গত কারণে আগামীতে তা আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের আশাবাদ রয়েছে। ড. আনিছুর রহমান জানান, দেশের সব নদ নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নদী দূষণ, নদীতে চর পড়ে যাওয়া এবং নির্বিচারে জাটকা নিধন, প্রজনন মৌসুমে আহরণ ও মাইগ্রেশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় ইলিশের বংশ বৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে যায়। তার মতে, ইলিশ মূলত বাংলাদেশী মাছের একটি। এর সত্তর শতাংশ সাগরের বাংলাদেশী সীমানা ও নদ নদীতে থাকে। অবশিষ্ট ত্রিশ শতাংশ রয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারে। গত প্রায় অর্ধযুগেও বেশি সময় ধরে সরকারী কঠোর নজরদারি ও বিভিন্ন মহলের ইতিবাচক সংশ্লিষ্টতার কারণে এবার আড়িয়াল খাঁ, রূপসা, শীর্ষা, রাবনাবাদ, আন্দারমানিক, তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর চ্যানেল, হাতিয়া, মনপুরাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ইলিশ মিলছে প্রচুর পরিমাণে। এছাড়া মধুমতি নদীতেও এবার ইলিশ মিলেছে। পাশাপাশি সুরমা, কুশিয়ারা, মহানন্দা, হাকালুকি হাউড়েও এবার ইলিশ মিলেছে। এর ফলে জেলেদের হাতেও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছে। অপরদিকে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম মহানগরী ও সীতাকু-ে এবার চালানে চালানে ইলিশ এসেছে। সন্দ্বীপ চ্যানেলে এবার রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট এলাকায় প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক ইলিশ বোঝাই ফিশিং বোটের লাইন পড়েছে। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নবেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ না করার বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে। যা দেশ ও জাতির জন্য বড় ধরনের কল্যাণ বয়ে আসবে ইলিশের ক্ষেত্রে। অতীতে বাংলাদেশ ইলিশ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করেছে। বর্তমানে ইলিশ রফতানি বন্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি থাকলে আগামীতে রফতানির পথ পুনরায় খুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যা থেকে আসতে পারে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। সমৃদ্ধ হবে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার।
×