ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিয়ঁর অ্যাম্ফিথিয়েটারে আজ দুই সিংহের অহং রক্ষার যুদ্ধ

প্রকাশিত: ২০:২৮, ৬ জুলাই ২০১৬

লিয়ঁর অ্যাম্ফিথিয়েটারে আজ দুই সিংহের অহং রক্ষার যুদ্ধ

প্যারিসের মতো রাজ-ঐশ্বর্য না হলেও লিয়ঁর প্রাচুর্য বড় কম নয়। তারও রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যকলা আছে, আছে ক্যাথিড্রাল, শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা দুই শতাব্দী পুরনো রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার। ইতিহাসের প্যাপাইরাস ঘাঁটলে জানা যায়, তিবেরাস সিজার অগাস্তাস, তাঁর ও রোমের পুরোহিতের সুরক্ষার কথা ভেবে লিয়ঁ অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি করেছিলেন। পুরনো চাকচিক্য অনেকটাই নেই, জায়গায়-জায়গায় ভেঙে পড়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচারে প্রাসঙ্গিক সে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে আলোচিত। ফ্রান্স ইউরোর শ্রেষ্ঠ ‘ডুয়েল’ যে আজ অ্যাম্ফিথিয়েটারের শহরেই হচ্ছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বনাম গ্যারেথ বেল। না, এঁদের হাতে আজ অসি থাকবে না। পায়ে ফুটবল থাকবে। মাদ্রিদ কত কথা বলে তার দুই মহাতারকাকে নিয়ে। দু’জনে পাশাপাশি খেলেন, রিয়াল মাদ্রিদ নামের রাজপ্রাসাদের মর্যাদারক্ষার দায়ভার কাঁধে নিয়ে ছোটেন দু’জন পাশাপাশি, কিন্তু তবু সিআর সেভেন আর ওয়েলশ উইজার্ডের সম্পর্ক নাকি একদম ভাল নয়। কেউ কেউ বলেন, এঁদের ব্যাপারটা নাকি পুরনো সোভিয়েত-আমেরিকার ঠান্ডা যুদ্ধের মতো। খোলাখুলি ‘আয়, দেখে নিচ্ছি’ বলে কেউ কাউকে হুঙ্কার দেন না। কিন্তু তলায়-তলায় যুদ্ধ চলে। লড়াই ঠান্ডা না গরম, সে যুক্তিতর্কে না ঢোকাই ভাল। পাঠক বুঝে নেবেন। তার চেয়ে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যা নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ গত কয়েক বছরে বারবার আক্রান্ত হয়েছে। ১) পেনাল্টি বা ফ্রি-কিক হলে রিয়ালে রোনাল্ডোই শেষ কথা। পর্তুগিজ মহাতারকাকে ডেড বল সিচুয়েশন থেকে যত শট নিতে দেখা গিয়েছে, তার অর্ধেক সুযোগও পাননি ওয়েলশ রাজপুত্র। ২) জোনাথন বার্নেট। বেলের এজেন্ট। ভদ্রলোক এতটাই ঠোঁটকাটা যে, একবার দুম করে বলে ফেলেছিলেন, তাঁর ক্লায়েন্ট ফুটবলটা খেলেন। ফুটবলে কী ভাবে শ্রেষ্ঠত্বের শৃঙ্গে ওঠা যায় তার চেষ্টা করেন। কোনও এক ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো ‘আন্ডারওয়্যার সেলস’ নিয়ে নেচে বেড়ান না! ৩) সিআর স্বয়ং। রোনাল্ডো একবার বলেছিলেন যে, টিম স্পিরিট তৈরি করার জন্য গ্যারেথ বেলের সঙ্গে তাঁর ডিনারে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না! ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড অধ্যায়ে রায়ান গিগস বা রিও ফার্দিনান্দের সঙ্গে ‘হাই-হ্যালো’-র বাইরে কোনও দিন যাননি। বেলের সঙ্গেও তাই। খেলা খেলার জায়গায়, সম্পর্ক সম্পর্কের। গ্যারেথ বেল প্রচুর চেষ্টা করেছেন ব্যাপারটা থামানোর। স্পেনের কাগজে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাক্ষাত্কারে বারবার বলেছেন, রোনাল্ডোর সঙ্গে তাঁর কোনও শত্রুতা নেই। রোনাল্ডোর আবেগ, রিয়ালের প্রতি দায়বদ্ধতা বুঝতে না পেরে মিডিয়া গল্প লেখে। এটাও বলে দেন, টটেনহ্যাম থেকে রিয়ালে আসার সময় সবচেয়ে বেশি যদি তাঁকে কেউ সাহায্য করে থাকেন, তো তিনি রোনাল্ডো। একবর্ণ স্প্যানিশ জানতেন না বেল, ইংরেজি ছাড়া তাঁর কোনও সহায়-সম্বল ছিল না। রোনাল্ডো ইংরেজি বলতেন, রিয়াল সংসারে তাঁকে সহজ করার কাজটা রোনাল্ডোই করেন। কিন্তু বেল কী বলছেন না বলছেন, তা বেদবাক্য মনে করে চলতে নিকুচি করেছে মিডিয়ার। তারা দেখেছে, একই প্র্যাকটিস সেশনে দু’জন ট্রেনিং করছেন দিনের পর দিন। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। তারা দেখেছে, আটলেটিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত গোল করে রিয়ালকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিচ্ছেন বেল, সতীর্থরা লাফিয়ে পড়ছে তাঁর ঘাড়ে, কিন্তু রোনাল্ডো সামান্য পিঠ চাপড়েও দিচ্ছেন না! সিআর-সমালোচকরা বলেন, পর্তুগিজের মতো আত্মকেন্দ্রিক ফুটবলার দুনিয়ায় আর নাকি দু’টো নেই। যে কারণে কোনও দিন তাঁর পক্ষে লিওনেল মেসি হওয়া সম্ভব নয়। যিনি নেইমার, সুয়ারেজদের আগমনে অস্তিত্ব বিপন্নতায় ভুগবেন না, দেখবেন ভ্রাতৃসম চোখে। নিন্দুকরা আরও বলাবলি করেন, রিয়াল ড্রেসিংরুমের ‘বস্’ একজনই, রোনাল্ডো। ক্যারিশমা, মেজাজ, ঠাঁটবাটে ড্রেসিংরুমে আধিপত্য এতটাই বজায় রাখেন যে, কোচকে পর্যন্ত তাঁর মন রেখে চলতে হয়। সেখানে বেল কে? তাঁর ফুটবল-প্রতিভার জাঁকজমক রোনাল্ডোর সহ্য হবে কেন? রিয়াল লকাররুমের নিয়মটা নাকি জলবৎ তরলং। থাকতে গেলে রোনাল্ডোর নেতৃত্ব মেনে নাও। নইলে প্রচুর ক্লাব আছে বিশ্বে, ইচ্ছেমতো খুঁজে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ো। আসলে প্রকৃতিগত ভাবেও দু’জনে এতটা ভিন্নধর্মী যে, ফারাকটা চোখে লাগে। রোনাল্ডো চিরকালের উচ্চাকাঙ্খী। বেল নরমসরম, মাটির অনেক কাছাকাছি। ইউনাইটেডে যে বয়সে রোনাল্ডো সতীর্থদের বলাবলি করতেন, ‘তোমরা দেখে নিও, আমি একদিন ঠিক বিশ্বের এক নম্বর প্লেয়ার হব,’ বেল ভাবতেও পারতেন না। উনিশ-কুড়ির বেলের কাছে টটেনহ্যাম থেকে একটু ছুটি পাওয়া মানে গাড়ি নিয়ে সোজা কার্ডিফ। মায়ের সঙ্গে গল্প করা, ঘরের কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আজও খুব পাল্টাননি বেল। অতীব সাধারণ তিনি। নিজের তারকা-দ্যুতি বিসর্জন দিয়ে ম্যাচের আগে সমর্থকদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে তাঁকে এখনও দেখা যায়। রিয়ালে প্রথম এসেছিলেন যখন রোনাল্ডো-রামধনুর ঝলসানিতে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। শুধু একটা ভুল করেছিলেন বেল। অকল্পনীয় অর্থ দিয়ে টটেনহ্যাম থেকে তাঁকে রিয়াল কিনে নেওয়ায় ভেবেছিলেন, টিমটা তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হবে। ভেবেছিলেন আরও একজন। বেলকে কেন্দ্র করে নতুন রিয়াল সৃষ্টির কথা ভেবেছিলেন। তিনি রাফায়েল বেনিতেজ, আজ আর রিয়াল মাদ্রিদে নেই। ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। বেল ওই একবারই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন, বেনিতেজের মতো কোচকে এ ভাবে যেতে দেওয়া ঠিক হল না। কিন্তু রিয়াল করবে কী? রোনাল্ডো তখন ক্লাব ছাড়ার কথা ভাবছেন। তাঁর ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তন নিয়ে তীব্র জল্পনা চলছে। বেনিতেজ-বিদায়েও যে পরিবেশ খুব পাল্টেছিল, তা নয়। আটলেটিকো লা লিগায় জেতার পরে রোনাল্ডো বলে দিয়েছিলেন, রিয়ালের এগারোটা রোনাল্ডো থাকলে এই দিন দেখতে হত না! নিগূঢ় অর্থ: বেল, তুমি কেউ না! করিম বেঞ্জিমাকে এ সময় রোনাল্ডো পাশে পেয়ে যাওয়ায় ওয়েলশ তারকা আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যান। বুধবারের যুদ্ধ নিয়ে দেখা গেল, ফ্রান্সে তুমুল কাড়ানাকাড়া বাজছে। কাগজে-কাগজে অনলাইন ক্যুইজ। জিতবে কে? ফাইনালে উঠবেন কোন মহারথী? বিশেষজ্ঞদের অনবরত বিশ্লেষণ, বেটিং-বাজার আগুন। ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফিলিপ স্কোলারি সরাসরি রোনাল্ডোর পক্ষ নিয়েছেন। বলেছেন, “রোনাল্ডোই জিতবে।” হ্রিস্টো স্তোইচকভ আবার রসিকতা করে বলেছেন, বেল জিতলে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচনের কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। তবে তাঁরও পছন্দ রোনাল্ডো। পর্তুগালের এক কাগজ বেলের বিশাল ছবি দিয়ে লিখেছে ‘লাস্ট টেস্ট অব গ্যারেথ বেল।’ ওয়েলশ উইজার্ড যতই রোনাল্ডো-প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে যান, সিআর সেভেন যতই যুদ্ধের আগে নৈঃশব্দকে বেছে নিন, ফুটবলবিশ্ব ক্লাব-দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি দেশের জার্সিতে দেখছে। তার চেয়েও বড়, ইউরোয় ‘দাদাগিরি’-র সংজ্ঞা হয়ে গিয়েছে উল্টো। মাদ্রিদের সম্রাট রোনাল্ডো এখন বিপন্ন। মাদ্রিদের যুবরাজ বেল এখন ইউরো কাঁপাচ্ছেন। পোয়েটিক জাস্টিস খুঁজবে না লোকে? প্রতিবেদনের চার নম্বর পরিচ্ছদে তাই মনে হয় একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে গেল। প্লিজ, সংশোধন করে নেবেন। পায়ে ফুটবল নেই, থাকতেই পারে না। অ্যাম্ফিথিয়েটারের শহরে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং গ্যারেথ বেল আজ সরাসরি অসিযুদ্ধেই নামছেন! সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×