ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আর্মি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে ফুল দিলেন ;###;রাষ্ট্রপতি দেশে না থাকায় তাঁর পক্ষ থেকে প্রথমেই ফুল দেয়া হয় ;###;ফুল দেয়ার পর অশ্রু গড়িয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর চোখ বেয়ে ;###;মন্ত্রিসভার সদস্য, সেনাপ্রধানসহ শ্রদ্ধা জানালেন হাজারো মানুষ

সজল চোখে শ্রদ্ধা ॥ গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে শোক দিবসের শেষ দিন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ জুলাই ২০১৬

সজল চোখে শ্রদ্ধা ॥ গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে শোক দিবসের  শেষ দিন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ হাতে ফুল, চোখে অশ্রু আর হৃদয়ে খুনী জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার। সোমবার এমনই চিত্র ছিল রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়াম। শোকার্ত গোটা দেশ, পুরো বিশ্বও। দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের শেষদিনে শোকাবহ আবহে গুলশানের ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সব শ্রেণী-পেশার মানুষেরই চোখে ছিল অশ্রু, হতভম্ব বিদেশী নাগরিকরাও তাদের আবেগ-কান্না চেপে রাখতে পারেননি। নিহতদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের শেষদিন সকাল ১০টায় আর্মি স্টেডিয়ামে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের নাগরিক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করেন গুলশানের সেই ভয়াল ও নৃশংস হামলায় নিহত ১৭ বিদেশী নাগরিক ও ৩ বাংলাদেশীকে, শ্রদ্ধা জানান ফুল হাতে। নজীরবিহীন এই হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ ও শুভ পক্ষের সব মানুষ। বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেয়া সেই জঙ্গী হামলার ঘটনার পর দুদিন পেরিয়ে গেলেও আর্মি স্টেডিয়ামের বাতাস যেন ভারি ছিল শোকে। সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের কান্না চাপা চোখমুখ বলছিল তাদের অব্যক্ত বেদনার কথা। স্টেডিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে করা মঞ্চে রাখা হয় নিহত তিন বাংলাদেশীর কফিন। তিন বাংলাদেশীর মধ্যে ইশরাত আখন্দ এবং ফারাজ হোসেনের কফিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢাকা ছিল। দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় অবিন্তা কবীরের কফিনে ছিল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। এছাড়া বিদেশী ১৭ নাগরিকের লাশও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। নিহত বাকিদের কফিন স্টেডিয়ামে রাখা না হলেও মঞ্চের পেছনে বাঁ থেকে ভারত, ইতালি, বাংলাদেশ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় স্মরণ করা হয় নিহত বিদেশী নাগরিকদের। নিহতদের স্মরণে পুরো মঞ্চটি বাংলাদেশ, ভারত, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় সজ্জিত করা হয়। এই পাঁচটি দেশের নাগরিকই নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন কাপুরুষ জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের হাতে। এছাড়া মঞ্চের সামনে কালো কাপড়ের ওপর সাদা হরফে লেখা ছিল- ‘হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহতদের জন্য বাংলাদেশের মানুষ গভীরভাবে শোকাহত।’ অনুষ্ঠানের শুরুতেই জানানো হয়, জাপানী রীতি অনুযায়ী, তাদের নিহত নাগরিকের জন্য রবিবার রাত থেকেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়েছে। সকাল ১০টায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে মঞ্চের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী কালো বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রাষ্ট্রপতি ভুটানে থাকায় তার পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বঙ্গভবনে দায়িত্বরত কমান্ডার মিনহাজ আলম। রাষ্ট্রপতির পর সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তার চোখে ছিল বেদনার অশ্রু। হেঁটে শ্রদ্ধা নিবেদন মঞ্চে গিয়ে ফুল দেয়ার পর কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শেষে প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাদের সহানুভূতি জানান। নিহতদের স্বজনদের সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। এ সময় স্টেডিয়ামের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নিহতদের পরিবার-পরিজন এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সান্ত¡না দেয়ার পাশাপাশি আশ্বস্ত করে বলেন, গুলশানে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলাকারীদের অর্থ ও মদদদাতা এবং এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী সবাইকে খুঁজে বের করা হবে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী কর্মকা- বাংলাদেশের মাটিতে হতে দেয়া হবে না। এরপর মঞ্চের সামনে উপস্থিত ভারত, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, নিহতদের স্বজনগণ, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ অপর দুই বাহিনীর প্রধানগণ, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের মহাপরিচালক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে নিহতদের কফিনে একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ইতালির রাষ্ট্রদূত ম্যারিও পালমা, জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানবে ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট। নিহত তিন বাংলাদেশীর স্বজনরা ও হামলায় জীবন দেয়া পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিক, আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, বিএনপি, এফবিসিসিআই ও ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে নিহত ইশরাত, ফারাজ ও অবিন্তার পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য এ সময় পরিবারের সদস্যদের হাতে ডেথ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন। মৃতদেহ হস্তান্তরের পর বেলা ১২টা পর্যন্ত এই শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা সর্বস্তরের মানুষের চোখে-মুখে ছিল একটিই প্রত্যয়- সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রামের। আর সাম্প্রদায়িক এই অশুভ দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কারের বহির্প্রকাশ। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, ড. গওহর রিজভী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবদুস সোবহান গোলাপ, মৃণাল কান্তি দাস, এসএম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মইন উদ্দীন খান বাদল, শেখ শহীদুল ইসলাম, শিরিন আক্তার, ডাঃ শাহাদাৎ হোসেন, ডাঃ ওয়াজেদুল ইসলাম খান। যুবলীগের মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী, হারুনুর রশিদ, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পঙ্কজ দেবনাথ, ছাত্রলীগের সাইফুর রহমান সোহাগ ও জাকির হোসাইন। এছাড়াও একেএম রহমত উল্লাহ ও সাদেক খানের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর উত্তর ও আবুল হাসনাত ও শাহে আলম মুরাদের নেতৃত্বে দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, রুহুল কবির রিজভী, মাহবুব উদ্দিন খোকন, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আনহ আখতার হোসেন ও শায়রুল কবীর খান উপস্থিত ছিলেন। এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, মৎসজীবী লীগ, হকার্স লীগ, তাঁতী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, জাতীয় বিদ্যুত শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আইন পরিষদসহ বিভিন্ন দল, বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও রাষ্ট্রীয় শোকের কর্মসূচী অনুযায়ী সোমবার রাজধানীসহ সারাদেশের মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ বিভিন্ন উপসনালয়ে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া-মোনাজাত ও বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুুষ্ঠিত হয়। সোমবারও দেশের সব অফিস-আদালতে জাতীয় পতাকা ছিল অর্ধনমিত। শোক-শ্রদ্ধায় নিহতদের স্মরণের মধ্য দিয়ে সোমবার শেষ হয় রাষ্ট্রীয় শোকের দুই দিনের কর্মসূচী। প্রতিক্রিয়ায় কূটনীতিকরা যা বললেন ॥ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইতালির নাগরিক নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোন ক্ষতি হবে না। তবে জঙ্গীবাদ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এই হামলার ঘটনায় আমরা শোকাহত। এই সঙ্কট মোকাবেলায় ইতালি সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা আশা করি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকা-ের বিচার হবে। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আমরা পরস্পর সহযোগতিার কথা বলেছি। এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশী উদ্যমী তরুণদের অনুরোধ, তোমরা উগ্রবাদীদের ফাঁদে পা দিও না, উগ্রবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসের পথে পা বাড়াবে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সব রকম সহায়তা দিতে প্রস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। গুলশানের ঘটনায় তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। আমরা বাংলাদেশকে সকল সহযোগিতা দিতে রাজি আছি। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় এক সঙ্গে কাজ করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকের বলেন, প্রতিবেশী, বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের সকল সঙ্কটে ভারত পাশে থাকবে। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ ঘটনায় ফোন করে পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। জিম্মি ঘটনায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপের প্রশংসাও করেন ভারতের হাইকমিশনার। রাজনীতিবিদরা যা বললেন ॥ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে বলেই যে আমরা সেই নীতি থেকে ফিরে আসব, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। সরকার শক্তহাতে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করবে। যে কোন মূল্যে ওদের নির্মূল করবই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে জাতীয় ঐক্য চায় না বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শর্ত দেয়া হচ্ছে। আমরা সব সময়ই বলে আসছি সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য দরকার। কিন্তু সরকারের পক্ষে সাড়া নেই। তিনি বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে সবকিছুর উর্ধে ওঠে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিহত ১৭ বিদেশীর লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু ॥ গুলশানে শুক্রবার রাতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের মধ্যে ৩ জনের লাখ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ১৭ বিদেশীসহ অন্যান্য লাশ রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ ব্যাপারে বাসস জানায়, আইএসপিআরের পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হক তাদের জানিয়েছেন, বিদেশী নাগরিকদের লাশ হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। লাশগুলো ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) রয়েছে। তবে নিহত ৬ হামলাকারী সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। স্বজনের মৃতদেহ এত ভারি ॥ গুলশানের হামলায় শুক্রবার নিহত হয়েছেন যারা তিনদিনেও স্বজনরা তাদের কাছে পাননি। সোমবার আর্মি স্টেডিয়ামে ততক্ষণে আনুষ্ঠানিকতা শেষ। পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে যেতে পারবেন জানানোর পর চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন অবিন্তার পরিবারের সদস্যদের ভেতর থেকে কেউ একজন। মা রুবা আহমেদ স্টেজের সামনের দিকে গিয়ে সেনাসদস্যদের বলেন, মেয়ের লাশ পরিবারের সদস্যরা ধরবেন। তার চোখেমুখে শঙ্কা এখনও কাটেনি। মেয়েকে যেন পরম আদরে সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন। এমন আকুতি করবেনইবা না কেন, মেয়ে বেঁচে নেই, কষ্ট দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে জানার পরও মেয়ের লাশটাকে কোলে নিয়ে, হাতে ছুঁয়ে দেখতে পাননি তিনদিন রুবা এ্যালিগেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান। স্টেজ থেকে একটু দূরে রাখা হয় ইশরাত আখন্দের লাশবাহী কফিনটি। তার মামা বিচারপতি ওবায়দুল হক, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনে কফিন খুলে দেখানো হয় সেখানেই। তারপর তাদের জানানো হয়, লাশ গোসল করানো হয়নি, কেবল পরিষ্কার করিয়ে দেয়া হয়েছে। সেনা কর্মকর্তা লাশ বুঝিয়ে দেয়ার সময় এসে বললেন, ভেতরে ডেথ সার্টিফিকেট আছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে কিছুদিন সময় লাগবে, তখন যেন একটু কেঁপে উঠল তার ভাইয়ের দুচোখ। তারপরও বোনের লাশ নিয়ে বৃষ্টিভেজা মাঠ ধরেই হাঁটেন তিনি। এর আগে এদিকে উপস্থিত ছিলেন নিহত বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা। মেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এত কষ্ট। বাবা নেই ভাবছি আবার মনে হচ্ছে আছেন। নিহতদের পরিবারগুলো কেউ কাউকে চেনেন না কিন্তু তাদের অনুভূতি, আবেগ, পরিস্থিতি সবই আজ এক। ফারাজ তার দুই বন্ধুকে ছেড়ে আসতে চাননি বলেই তাকে মরতে হয়েছে নৃশংসভাবে। সকালে আর্মি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার পর বেলা পৌনে একটার দিকে ফারাজের মরদেহ গুলশানে নেয়া হয়। এ বয়সী একজন সন্তানকে হারিয়ে স্বজনদের শোক যেন বাঁধ মানছে না, কিন্তু তাদের ছেলে যে সাহসী কাজ করেছে সেটুকু ভেবেই সান্ত¡না খুঁজছেন যেন। ফারাজের নানা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী লতিফুর রহমান। যাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাল বাংলাদেশ ॥ গুলশান-২ এলাকার ৭৯ নম্বর সড়কের স্প্যানিশ মালিকানাধীন হলি আর্টিজান ক্যাফেতে শুক্রবার রাতে সন্ত্রাসী হামলায় ২০ দেশী-বিদেশী জিম্মি নিহত হয়। যাদের মধ্যে ৯ ইতালীয়, ৭ জন জাপানী, এক ভারতীয় ও একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এদিনের ঘটনা প্রতিহত করতে গিয়ে বনানীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খান ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার রবিউল ইসলামও নিহত হন। নিহত ইতালির ৯ নাগরিক হলেন- নাদিয়া বেনেদিত্তো, ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনো মন্টি, মারিয়া বিরোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিটিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট। নিহত সাত জাপানীর মধ্যে ছয়জনই ছিলেন মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত। তারা হলেন- কাটাহিরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনালের পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কিউ ওগাসারা (৫৬), যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মাকোতো ওকামোরা (৩২), এলমেক কর্পোরেশনের প্রকৌশলী ইউকো সাকাই (৪২), একই সংস্থার প্রকৌশলী রিও সিমোদারিয়া (২৭), জাইকার নির্মাণ বিশেষজ্ঞ হিরেসি তানাকা (৮০), জাইকার কর্মকর্তা নবহিরো কুরোসাকি (৪৮) ও জাইকার কর্মকর্তা হিদেকি হাসিমুতো (৬৫)। এছাড়া ভারতীয় তারিশি জৈন এবং তিন বাংলাদেশী ইশরাত আখন্দ, অবিন্তা কবীর ও ফারাজ হোসেনও সন্ত্রাসীদের হাতে ওইদিন প্রাণ হারান। গুলশান থানায় মামলা ॥ হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনায় সোমবার রাতে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। পুলিশের গুলশান বিভাগের এসি রফিকুল ইসলাম এ তথ্য স্বীকার করে জানান, ওই মামলায় নিহত পাঁচ হামলাকারীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যার দিকে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ওই হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। এসব মামলায় নিহত পাঁচ হামলাকারীসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হবে।
×