ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদমেলা পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২ জুলাই ২০১৬

ঈদমেলা পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আনন্দ-খুশিকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্য আয়োজন হয় ঈদমেলার। মেলা বলতে আনন্দ-উল্লাস আর আবেগঘন মনের খোরাক ও প্রাণের মেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মাদারীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মেলার আয়োজন করা হয়। মাদারীপুরে যেসব মেলার প্রচলন রয়েছে তা হলোÑ বৈশাখী মেলা, মধুমাসের মেলা, ঈদের মেলা, কুম্ভ (গণেশ পাগলের) মেলা, আমগ্রামের মেলা, চড়ক পূজার মেলা, বাজিতপুরের মেলা, বসন্তবরণ মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, নীল পূজার মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কুন্ডুবাড়ি কালিপূজার মেলা, পৌষমেলা, স্বাধীনতা দিবসের মেলা, বিজয় দিবসের মেলা, একুশের মেলা রথযাত্রার মেলা ইত্যাদি। ঘোষণা দিয়ে মাদারীপুর অঞ্চলে ঈদের মেলার আয়োজন হয় না। এ ধরণের মেলার কোন কমিটিও থাকে না। শুধু আনন্দ-উল্লাস করার জন্য ঈদমেলা হয়ে থাকে। খোলা জায়গায় এক শ্রেণীর উৎসুক দোকানি পসরা সাজিয়ে বসে। বাঁশ-খুঁটি পুঁতে তাঁবু বা পলিথিন টাঙ্গিয়ে রং বে-রঙের খেলনা সাজিয়ে ঈদে বেড়াতে আসা ছোট্ট-ছোট্ট শিশু ছেলেমেয়েদের আকৃষ্ট করে। বাঁশি আর ঝুনঝুনি বাজিয়ে মানুষকে মেলায় আসার আহ্বান জানানো হয়। এভাবেই ভিড় বাড়তে থাকে এবং শুরু হয় লোক সমাগম। মানুষের কলরবে এবং নানা ধরনের বাঁশি, ভেঁপু আর ঝুনঝুনির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরতে আসা সকল শ্রেণীর মানুষ নানা পণ্য কেনাকাটা করে। পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় আর কোলাকুলি করে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমাগম ঘটে ঈদমেলায়। সকল ভেদাভেদ ভুলে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাব বিনিময় করে। এ অঞ্চলে মেলাকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। মেলা কোথাও গোলইয়া, কোথাও আড়ং, কোথাও বান্নি নামে ডাকা হয়ে থাকে। তবে যে নামেই ডাকা হোক মেলা বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব। মেলা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালীর প্রাণের উৎসব। যা ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করে বাঙালীকে অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। অনেকে মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। কেউ-কেউ মেলাকে ‘হিন্দুয়ানি’ আচার-অনুষ্ঠান বলে থাকে। কিন্তু এ কথার কোন ভিত্তি নেই। মাদারীপুর অঞ্চলে মেলা, গোলইয়া, আড়ং বা বান্নি সবই বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে। মেলার আবেদন আবহমানকালের এবং তা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে যুগ-যুগ ধরে। ঈদ উপলক্ষে মাদারীপুরে বড় মেলা বসে নতুন শহর স্বাধীনতা অঙ্গনে। অন্যান্য মেলার মতো হরেক রকম পসরার পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলায় টুপি, রঙিন রুমাল, জায়নামাজ, তসবিহ, ইসলামিক বই ইত্যাদি পাওয়া যায়। অন্যান্য উপজেলার গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, খোলা জায়গায়, নদীরপাড়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে ঈদ উপলক্ষে মেলা বসে। মেলায় যে শুধু মুসলমান আসে, এমন নয়। এ মেলায় ধর্ম বর্ণের কোন ভেদাভেদ থাকে না। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ঈদের মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। মাদারীপুর অঞ্চলে ঈদমেলাসহ অন্যান্য মেলা সাধারণত এক থেকে সাত দিনের জন্য বসে। ঈদের মেলা তিন দিনের বেশি থাকে না। তবে দোকানিদের ওপর নির্ভর করে মেলার সময়সীমা বাড়ানো-কমানো। আগের তুলনায় বিগত কয়েক বছর ধরে ঈদ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলার আবেদন অনেকটা কমে এসেছে। কারণ ধর্মীয় গোড়ামি ও ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ বর্তমান প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ঈদমেলাকেও দেখা হচ্ছে ভিন্ন চোখে। ফতোয়া দিয়ে সমাজে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনও এক শ্রেণীর মানুষ মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। এ বিচার বিবেচনা কেবল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নয়, স্বাধীনতার আগেও করা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীর প্রাণের উৎসব মেলার আয়োজন থেমে থাকেনি। কারো ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান বলাতেও মেলা উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়নি। আজও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বাঙালী হিন্দু-মুসলমান মেলা উদযাপন করে আসছে। আনন্দ-উল্লাস ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সমানভাবে। বাঙালীর প্রাণের উৎসব মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন মানুষের মাঝে থাকে নানারকম আয়োজন। ঈদের মেলায় দেখা হয় পুরনো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করে একে অপরের সঙ্গে। ফলে ঈদমেলা ঈদ পুনর্মিলনীতে পরিণত হয়। শুধু কেনাকাটাই নয়, ঈদের মেলা প্রাঙ্গণ ভাব বিনিময়েরও অন্যতম মাধ্যম। Ñসুবল বিশ্বাস মাদারীপুর থেকে
×