ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদমেলা ॥ বাড়তি উৎসব আনন্দ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২ জুলাই ২০১৬

ঈদমেলা ॥ বাড়তি উৎসব আনন্দ

ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগাতে ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে ঈদ মেলা রাজশাহীর বাঘাবাসীর সঙ্গে ঐতিহ্য হয়ে মিশে আছে। ঈদের দিন ঘনিয়ে আসায় আনন্দের সঙ্গে বাড়তি উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে উপজেলার মানুষ। বিশেষত ২০ রোজার পর পরই শুরু হয় ঈদ মেলার আয়োজন। এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় প্রহর গোনে এখানকার মানুষ। শুধু বাঘা নয়, আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দ যোগায় এখানকার ঈদমেলা। জেলার ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ উপজেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ বাঘা উপজেলার ঈদ মেলার ঐতিহ্য পাঁচ শ’ বছরের। মূলত ঈদের আগের দিন থেকেই শুরু হয় মেলায় আয়োজন। চলে টানা ১০ দিন। কোন কোন বছর এ মেলার স্থায়িত্ব হয় ১৫ দিন থেকে টানা এক মাস। প্রতি বছরের মতো এবারো মেলার আয়োজন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মেলার স্থান ইজারা নেয়া হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আব্বাসীয় বংশের হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (র.) ও তার ছেলে হযরত আবদুল হামিদ দানিসমন্দ (র.)-এর সাধনার পীঠস্থান রাজশাহীর বাঘা। আধ্যাত্মিক এ দরবেশের ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতরে আরবী সওয়াল মাসের ৩ তারিখে ধর্মীয় ওরস মোবারক উৎসবকে সামনে রেখে বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের উদ্যোগে বিশাল এলাকাজুড়ে আয়োজন করা হয় এ মেলার। বিভাগীয় শহর রাজশাহী নগরী থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা মানুষগুলোর আনন্দ বাঘার ঈদ মেলাকে ঘিরে। তাই এই মেলা এখানকার মানুষের কাছে আবেগ এবং গভীর আগ্রহের। পুরনো স্মৃতির পটভূমিতে নতুন করে আঁচড় কাটে ঈদ মেলা। বছর ঘুরে তাই এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে সবাই। যাদের স্বজনরা সীমান্তের ওপারে থাকে, তারা বছরের নির্দিষ্ট এ সময়টা বেছে নেয় একে অপরের সঙ্গে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বসবাস ছুটে আসে তারাও। পাঁচ শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় লাখো মানুষের সম্মিলন ঘটে। গ্রামের মেঠো পথ ছুঁয়ে ধনী-গরিবের মিলনমেলায় পরিণত হয় মেলাকে ঘিরে। দূরের জেলা থেকেও মেলায় আসে মানুষ। শুরু থেকেই ঈদ মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে ব্যবসায়ীরা। বেচাকেনা চলে ঈদের দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত। পাওয়া যায়, রকমারি মিষ্টি, খেলনা, মনোহারী সামগ্রী, লোহা ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্রসহ সদরঘাটের পান। মেলাকে ঘিরে আয়োজন করা হয়, সার্কাস, মৃত্যুকূপ ও মোটরসাইকেল খেলা। এ ছাড়া বিভিন্ন খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। এবারও একই নিয়মে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। শুধু তাই নয়, মেলা প্রাঙ্গণে ওরস মোবারককে ঘিরে সারারাত চলে ভক্তদের জিকির, সামা কাওয়ালি। ভক্ত ও আগ্রহী মানুষ এতে যোগ দেয় দূর-দূরান্ত থেকে এসে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে পাপমোচন ও পুণ্য লাভের আশায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাঘায় আসে পবিত্র ওরস মোবারকে অংশ নিতে ও মাজারে নামাজ আদায় করতে। তাই বাঘা ওয়াকফ এস্টেট কর্তৃপক্ষ এখন ব্যস্ত। সুশৃঙ্খল আয়োজন বজায় রাখতে তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। স্থানীয় বাসিন্দা নূরুজ্জামান জানান, মূলত ওরসকে কেন্দ্র করেই মেলার আয়োজন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব মানেই বাঘার ‘ঈদ মেলা’। তিনি জানান, শিল্প মহিমার বিস্ময়কর স্থাপত্য নকশার অনন্য নিদর্শন বাঘা শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উত্তরে বাঁ দিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (র.)-এর মাজার শরীফ। শাহী মসজিদের উত্তরে খানকা বাড়ির ভেতরে তার ছেলে হযরত শাহ আবদুল হামিদ (র.)-এর মাজার শরীফ। আর সংলগ্ন এলাকাজুড়েই বসে ঈদমেলা। ঈদমেলায় বেড়াতে এসে এখানে মেলে পুরাকীর্তি দেখার সুযোগ। জানা যায়, পাঁচ শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস অনুযায়ী এখানে ছিল উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও মাজার শরীফের পাশে আছে বিশাল দীঘি। বাঘা শাহী মসজিদ এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ মসজিদের ছবি রয়েছে ৫০ টাকার নোটে। ওরস ছাড়াও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মনবাসনা পূরণের জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থী আসে বাঘা শাহী মসজিদ ও মাজার শরীফে। এখানে রয়েছে বিশাল আয়তনের স্বচ্ছ পানির দীঘি। এ বছরই এখানে চালু হয়েছে জাদুঘর। বছরের পর বছর ধরে বাঘা ওয়াকফ এস্টেট পরিচালনা কমিটি ধর্মীয় আয়োজনে ওরস ও ঐতিহ্যবাহী এই ঈদমেলা পরিচালনা করে আসছে। এবারও আয়োজক কমিটি ওয়াকফ এস্টেট। তবে প্রকাশ্য ডাকে ইজারার মাধ্যমে ঈদমেলা পরিচালনা করা হয়ে থাকে। স্থানীয়রা জানায়, বাঘার ঈদমেলাকে ঘিরে ভারত থেকে অনেক মানুষ আসে। ঈদের আগের দিন ভারত থেকে জামাইসহ মেয়েরা চলে আসে বাপের বাড়ি। মেলায় ঘুরে কিছুদিন থেকে সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে আবার ফিরে যায়। মূলত বছরের এই সময়টির জন্য বাঘার মানুষ অপেক্ষা করে সারাবছর। মেলা দেখতে আসে পর্যটকরাও। এতে মেলা লাখো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। Ñমামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×