ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঝিনাইদহে ২৪ দিনের ব্যবধানে পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ জুলাই ২০১৬

ঝিনাইদহে ২৪  দিনের ব্যবধানে  পুরোহিত ও  সেবায়েত  হত্যা

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝিনাইদহ, ১ জুলাই ॥ ঝিনাইদহে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর শোক কাটতে না কাটতেই আবারও দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল বিগ্রহ মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস গোঁসাইকে। এ নিয়ে গত ২৪ দিনের ব্যবধানে সনাতন ধর্মের দু’জনকে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। এরা হলেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার করাতিপাড়া গ্রামের পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৭০) ও শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল বিগ্রহ মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস গোসাই (৫০)। এর আগে দু’জন হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারা হলেন, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের একাংশের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সেক্রেটারি হোমিও চিকিৎসক আব্দুর রাজ্জাক (৪৫) ও হোমিও চিকিৎসক সমির উদ্দিন খাজা (৭০)। এর আগের ৩টি হত্যাকা-ের সাথে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে আইএস দায় স্বীকার করলেও তা স¤পূর্ণ ভুয়া বলে জানায় পুলিশ। এ সব হত্যাকা-ের মোটিভ পুলিশ উদ্ধার করেছে। পুরোহিত হত্যাকা-ের ঘটনায় এক শিবির নেতা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। এদিকে শুক্রবার সেবায়েত হত্যাকা-ের খবর পেয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ, ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান, র‌্যাব ৬ এর কমান্ডিং অফিসার অফিসার রফিকুল ইসলাম ও ৫৮ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লে.কর্নেল তাজুল ইসলাম সেবায়েত হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভায় মিলিত হন। জানা গেছে, ঝিনাইদহে প্রথম হত্যাকা-ের শিকার হন সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের সমির উদ্দিন খাজা। গত ৭ জানুয়ারি বেলেখাল বাজারে নিজ হোমিও চেম্বারে দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় বশির, শফিকুল ইসলাম কাজল, মিলন মিয়া ও আব্দুল বারি নামে ৪ জনকে পুলিশ আটক করে জেল হাজতে পাঠায়। তারা সবাই জামায়াত-শিবিরের কর্মী বলে পুলিশ জানায়। গত ১৫ মার্চ হত্যাকা-ের শিকার হন কালীগঞ্জে হোমিও চিকিৎসক হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক। রাতে নিজ চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনায় জনি ও শফি নামে দুই সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা সবাই জেল হাজতে রয়েছে। এরপর গত ৭ জুন পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী বাড়ি থেকে বাইসাইকেলযোগে নলডাঙ্গা সিদ্বেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মহিষা ভাগাড় বিলে নিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে। হত্যাকা-ের একদিন পর বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনের রাজনৈতিক সচিব রাজেস উখায় ও প্রথম সচিব কন্স্যুলার ও ভিসা রমাকান্ত গুপ্ত নিহত পুরোহিতের বাড়ি ও হত্যাকা-ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর সরকারের ৩ মন্ত্রী পুরোহিতের শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানান। হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে করাতিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শান্তি সমাবেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও বিমান পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বক্তৃতা করেন। ভারতীয় হাইকমিশনের দুই কূটনীতিক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধি দল যান ঘটনাস্থলে। এ ছাড়া স্থানীয় এমপি, প্রতিমন্ত্রী, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সোচ্চার এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে। জেলা প্রশাসক নিহত পুরোহিতের পরিবারকে ১ লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন। পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান জঙ্গী ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে এলাকায় আইনশঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সমাবেশ করেন। সমাবেশে ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। তিনি জঙ্গী ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় ডিফেন্স পার্টি গঠনের নির্দেশ দেন এবং ডিফেন্স পার্টির জন্য লাঠি-বাঁশি দেয়া হয়। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় পুলিশ এনামুল হক নামে এক শিবির নেতাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। তার বয়স ২৪ বছর। সে ২১ জুন বিকেল ৪টা থেকে ৬টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঝিনাইদহ অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা জাহাঙ্গীরের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টায় ঝিনাইদহ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং-এ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন বলেন, ঝিনাইদহে পুরোহিত হত্যাকা-ের পর থেকে তদন্ত চালিয়ে আমরা এনামুল হক নামে শিবিরের একজনকে গ্রেফতার করি। তারা শিবিরের কেন্দ্রীয় নির্দেশে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে হত্যা করে। এ হত্যাকা-ের সাথে শিবিরের ৭ জন জড়িত বলে এনামুল হক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে বলেছে। এনামুল হক শিবিরের ঝিনাইদহ পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের সেক্রেটারি এবং সদর উপজেলার আড়মুখ গ্রামের ফজলুল হক জোয়ার্দ্দের ছেলে। পুলিশ সুপার আরও বলেন, এর আগে ঝিনাইদহ হোমিও ডাক্তার সমির উদ্দিন খাজা ও কালীগঞ্জের হাফেজ আব্দুর রাজ্জাককেও শিবিরের কেন্দ্রীয় নির্দেশে হত্যা করা হয়। এ ৩টি হত্যাকা-ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আইএস’র দায় স্বীকারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ঝিনাইদহে কোন আইএস নাই। শিবিরের লোকজন এ ৩টি হত্যাকা- ঘটিয়েছে। সবশেষ শুক্রবার ১ জুলাই সকালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল বিগ্রহ মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস গোসাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মুসুড়িয়া গ্রামে। তার পিতার নাম কিরণ দাস। তিনি দীর্ঘ ৪ বছর ধরে শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল বিগ্রহ মঠের সেবায়েত হিসাবে আছেন। এলাকার মানুষ তাকে অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও ভাল মানুষ হিসেবে জানেন। পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী হত্যার মতো এবারও দুর্বৃত্তরা এক মোটরসাইকেলে ৩ জন এসে সেবায়েতের মাথা, গলা ও ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকা-ের খবর পেয়ে শুক্রবার বিকেলে খুলনা ভিাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ ও খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেসময় তাঁরা হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শীসহ এলকার বিভিন্ন লোকজনের সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নেন। সাথে ছিলেন র‌্যাব ৬ এর কমান্ডিং অফিসার রফিকুল ইসলাম, বিজিবির ৫৮ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম, এডিশনাল ডিআইজি একরামুল হাবিব, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার, পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন, জেলা পরিষদ প্রশাসক এ্যাডভোকেট আব্দুল ওয়াহেদ জোয়ার্দ্দার, ঝিনাইদহ পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ, ৬ উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মকবুল হোসেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট সুবির সমাদ্দার ও ৬ থানার ওসি। কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থল থেকে ফিরে সকলেই ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এক বিশেষ সভায় মিলিত হন। সভায় জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। জানা গেছে। শুক্রবার ভোরে সদর উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের রাস্তার পাশে বন্দুকযুদ্ধের এ ঘটনা ঘটে। ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান জানান, তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন, তেঁতুলবাড়ীয়া এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত নাশকতা সৃষ্টির জন্য অবস্থান করছে। খবর পেয়ে পুলিশের একটি টহল দল তেঁতুলবাড়ীয়া রাস্তা দিয়ে ওই এলাকায় যাচ্ছিল। সে সময় তেঁতুলবাড়ীয় গ্রামের উত্তর মাঠের মধ্যে পৌঁছলে দুবৃর্ত্তরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ পাল্টা চালায় গুলি। উভয়পক্ষের মধ্যে প্রায় ২০ মিনিট গুলিবিনিময় হয়। এতে পুলিশের এসআই প্রবীর, সদস্য রাব্বি ও তরিকুল আহত হন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ২ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ ১টি ওয়ান শূটার গান, ৬ রাউন্ড গুলি, ৫টি বোমা, ৬টি হাসুয়া উদ্ধার করে।
×