ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মণীশ রায়

কড়াদা বাঁচতে চেয়েছিল

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১ জুলাই ২০১৬

কড়াদা বাঁচতে চেয়েছিল

কড়াদার সঙ্গে আবার কখনো দেখা হবে ভাবিনি। যাকে আমি আমার কৈশোরের ইন্দ্রনাথ ভাবি তাকে এভাবে দেখতে পাব, সত্যি বলছি, কল্পনাও করিনি। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল তখন। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ। দূর থেকে ভেসে আসছিল সোঁ-সোঁ ধ্বনি; নদীর ঢেউ আর বাঁশঝাড়ের মাতামাতি; চারপাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত মোহময় এক শব্দতরঙ্গ। কখনো মনে হচ্ছিল বুক ভরা দুঃখ নিয়ে কেউ অবিরাম কেঁদে চলেছে। কখনো মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন চারদিক দাপিয়ে বিটকেলে রকমের সম্মিলিত হাসি হাসছে। আমি তাকিয়ে রয়েছি সেদিকে। আমার ভেতরকার অশরীরী সব জল্পনা-কল্পনা আজও কৈশোরের মতই আমাকে মুগ্ধ ও শঙ্কিত করতে চাইছে; কেবলি মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে আজ। বুক দুরু দুরু; মন উড়– উড়। কিছু একটা ঘটার আশঙ্কায় ব্যাকুল। উথালি-পাতালি মনের প্রতিটি তন্ত্রী। এরকম হবার কথা নয়। আমার যা বয়স তাতে এসব মাথার ওপর দিয়ে শুকনো খরখরে পাতার মত উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি মানুষটাই এরকম। আমার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের কাছে যতই মিনমিনে টাইপ হই না কেন, ভেতরে ভেতরে আমি প্রচ- রকমের কল্পনাবিলাসী আর সংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ। আমি এ রকম আকাশ দেখলে এবং এর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ পরই এখনও আমার আড়তদার দাদাজানের জলদগম্ভীর মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাই সেখানে। বিশালাকৃতির এক মানুষ। বরে গোলাম আলী খাঁ সাহেবদের মত পাকানো গোঁফ। চোখ দুটো এমনি বড় আর কঠিন যে তাকালেই নিজেকে ছাগশিশু কিংবা বেড়ালছানা বলে মনে হয়। অথচ তিনি কাউকে যে খুব একটা বকাঝকা করেন তা তো নয়। বরং একেবারেই কম কথা বলা মানুষ। তবু তাকেই সবাই ভয় আর সমীহ করে চলে। দাদাজানের পিছু চলা মানুষটি আমাদের কড়াদা; হাতে ধরা কারুকাজময় গড়গড়া। দাদাজানের মূল বাড়ির লাগোয়া ছাড়াবাড়িটায় তিনি কাজকর্ম শেষে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে গড়গড়ার নলটা কড়াদার হাত থেকে নিয়ে টান দিতেন খুব আয়েস করে। মফস্বলের হিসাব কষা পটু ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও দাদাজান স্বভাবে ছিলেন উদার ও পরোপকারী এক মানুষ। এলাকার লোকজনদের ভেতর কেউ বিপদে পড়লে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তার কাছে ছুটে আসতে দ্বিধা করত না। ছাড়াবাড়িটায় পায়চারি করতে করতে তিনি সেসব সমস্যার সমাধান দিতেন। তাই এটাই ছিল দাদাজানের সঙ্গে দেখা করবার উত্তম সময়। বর্ষাকালে তিনি নদীটার তীর ধরে হেঁটে বেড়াতে ভালবাসতেন। ফতোয়া আর সাদা লুঙ্গি পরা মানুষটাকে আমার তখন অন্যরকম লাগত। তার সঙ্গে লেখাপড়া জানা আমার আব্বাকে কিছুতেই মিলাতে পারতাম না। আব্বা একেবারে মিঁউমিঁউ করা এক পুরুষ। আম্মাকে যেমন সমীহ করতেন তেমনি দাদাজানের সামনেও হাত কচলাতেন। আমি তারই মত; তবে আমার প্রিয় মানুষ আব্বা নন, আমার দাদাজান। কৈশোরে ঢাকা থেকে এখানে বেড়াতে এলে আমার ভেতর অদ্ভুত সব কল্পনা ডানা মেলতে শুরু করত। ছাড়াবাড়িটায় পা রাখতে না রাখতে আমি গাছেদের নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দ পেতাম। হাওয়ার তালে এলোমেলো নড়াচড়া করে ওরা যেন আমাকেই স্বাগত জানাত। আমি সব টের পেতাম। এসবই দাদাজানের কাজ; আমারই অগোচরে আমার ভেতর কখন যে এগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছেন, টেরই পাইনি। তিনি এক-একটি গাছকে ধরে ধরে হাত দিয়ে আদর করতেন আর কড়াদাকে বলতেন, ‘বল তো শতবর্ষী এই গর্জন গাছটার নাম কি কড়া?’ ‘ফুলমিঞা। আপনার দাদজানের খাস সেবক।’ ‘ওই বেটা একবার দাদাজানকে সাপের কামড় থেকে বাঁচিয়েছিল। দাদাজান তার নামে এই গাছটা পুঁতে দিয়েছিলেন।’ বলে আমার দিকে তাকাতেন। আমি হতবাক হয়ে গাছটার আকাশ সমান মাথার দিকে তাকিয়ে ফুলমিঞার চোখমুখ-হাত-পা খুঁজে ফিরতাম। একটু পর তিনি গিয়ে দাঁড়াতেন নদী বরাবর বাঁশঝাড়টার তলায়। কড়াদার দিকে তাকিয়ে এবার হেসে ফেলতেন। জলদগম্ভীর মানুষের চেহারায় ভেসে উঠত অর্ধস্ফুট অথচ উজ্জ্বল এক হাসি। সঙ্গে সঙ্গে আর সবার ভেতর সেটি সংক্রমিত হত। আমরাও দাদাজানের মত মুখভঙ্গি করে হাসার চেষ্টা করতাম। দাদাজানের দেখাদেখি কড়াদাও ঘাড় উঁচিয়ে ওই বাঁশঝাড়টিকে দেখত। তারপর মনিবের হাসির উত্তরে একরকমের অবয়বহীন হাসি ভাসিয়ে তুলত নিজের চোখে-মুখে। সেই অস্ফুট হাসিটা কড়াদার পাথর-খোদাই চেহারা থেকে শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে ভোরবেলাকার শিউলী ফুলের মত ঝরে পড়ত। পিছনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধচোখে দাদাজান ও কড়াদাকে দেখতাম আমি। দাদাজান বলতেন, ‘এই বাঁশঝাড়টার নাম হুসনি ঝাড়। লবণ ব্যাপারী আমার দাদাজানের বড় প্রিয় লোক ছিল সে। যাত্রপালায় রানী সাজত বলে ওকে তিনি হুসনি বেগম বলতেন। ওই আমলে বড় বড় গৃহস্থদের উপদেষ্টা থাকত। হুসনি বেগম ছিল সেরকম এক উপদেষ্টা। তাকে ছাড়া দাদাজানের চলত না। বিদূষক কিসিমের। হাসির একখান খনি আর কি। এমন রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলত যে দাদাজান হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ত। হুসনি ঝাড়টা তারই নামে। হুসনি বেগমের গানের গলাও আছিল দুর্দান্ত। কড়া, তুই তো একটা গান গাইতে পারিস। গাইবি?’ বলে দাদাজান কড়াদার দিকে তাকাতেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে কড়াদা গড়গড়াটা মাটিতে রাখত। তারপর হেঁড়ে গলায় এক ধরনের মাদকতা এনে হাত দুলিয়ে নেচে-নেচে গাইতে শুরু করত, ‘গাছ মরিলে লতা মরে। তবু লতা গাছ ছাড়ে না। পিরিতের জগতে এমনি কানুন, রাধা ছাড়া শ্যাম বাঁচে না।’ গান থামবার পর আমি ও কড়াদা সেই ঝাড়টার দিকে তাকিয়ে সদাহাস্যময় প্রাণবন্ত এক মুখ খুঁজতাম। মূল বাঁশটিকে মনে হত হুসনি বেগমের দেহকা- আর চিকন ডালপালাগুলোকে ভেবে নিতাম অবয়ব- রেখা। কড়াদা আমকে প্রশ্ন করত, ‘হুসনি বেগমরে দেহ নাই শরাফত?’ কিশোর বয়সের সেই আমি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে কড়াদার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার চোখে কল্পনার রং। সে তখন দাদাজানের থেকেও অদ্ভুত সব কথা বলে আমার ভেতরকার কল্পনাগুলো উসকে দিত, ‘বালা কইরা চাইয়া দেহ শরাফত মিঞা। হুসনি বেগমরে দেকবার পাইবা। হের হাসির চোটে এইহানে থাহন মুশকিল। নাইচ দেখছ? নদীর থেইকা বাতাস পাইলেই তাইনে নাইচ শুরু করেন। তাক ধিন ধিন না। বাপরে বাপ। বেডা মাইনষের এমন নাইচ কমই দেখছি। চাইয়া থাহ, টের পাইবা।’ হয়তো সেসময় নদীর বুক থেকে আসা বাউল বাতাসের দোলায় বাঁশঝাড়টা নড়ে উঠত; তাতে সোঁ-সোঁ-হো-হো ধরনের শব্দ হত। আমি ভাবতাম, হুসনি বেগমের হাসি; কখনো ঘুঙুর পরা পায়ের তা-ধিন ধিন-না; অদ্ভুত এক মাদকতা পেয়ে বসত, যা এই মধ্য বয়সেও ছেড়ে যায়নি আমায়। ছেষট্টি-সাতষট্টি সনে কড়াদার তারুণ্য একেবারে উথলে পড়ছে। বলবার আগেই তাকে সুপারি-নারকেল গাছের ডগায় দেখতে পাওয়া যায়। দাদিজান মাছের কথা বললে সে লাফ দিয়ে নদীতে ঝাপ দেয়। শীতের ভোরবেলায় পলো আর কোচ দিয়ে কত যে রিটা মাছ ধরে নিয়ে এসেছে শীতালক্ষ্যা থেকে তার হিসাব পাওয়া মুশকিল। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের পর কড়াদাকে দেখেছি ভাসমান প্রতিমার খড়কুটো আর বাঁশ-বেতের কাঠামোর তলায় ডুব দিয়ে খালিহাতে চিংড়ি মাছ ধরতে। পাড়ে এসে আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে কড়াদা বলত, ‘সব চিংড়ি এখন কাডামের তলায়।’ ‘কেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম। ‘আরে দুগ্গাঠাকরুন মা না। মায়ের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিব না? আমি আর আমার মা আশ্রয় নিছি না আব্বাজানের বাড়িত। বুজজ শরাফতভাই?’ সারল্য ঝরে কড়াদার দৃষ্টি থেকে। তালগাছের মত মিশকালো বিশাল একখানা শরীর; যখন দুহাতে দুটো লাঠি নিয়ে চরকির মত ঘুরাতে শুরু করে তখন দাদাজানের চরম শত্রুটিও মুখ ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় সেই মানুষটাকেই অদ্ভুত রকমের সরল বলে মনে হয়। কড়াদার মুখ থেকে কত শুনেছি শাকচুন্নি আর শীতের সময় শীতালক্ষ্যায় মাছ খেতে আসা অজস্র মেছো ভূতেদের গল্প। ডাঙায় যখন ওর সঙ্গে চলতাম তখন এই গল্পগুলো আমি গোগ্রাসে গিলতাম। আবার একই আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখতাম, কড়াদা নদীর তলা থেকে কিভাবে যাদুকরের মত খালি হাতে ডুব দিয়ে একটু পর দুহাতে করে বিশাল বিশাল সব সোল আর রিটা মাছ তুলে আনছে। তাকে তখন আমার শুঁশুক বলে মনে হত। নইলে কি করে খালি হাতে মাছ ধরে ডালা ভরে ফেলত চোখের নিমিষে? দাদাজানের বাড়ির এক কোনায় ওদের আশ্রয়। ওর পুরো নাম কড়িরঞ্জন দাস। শুনেছি, দাদাজান একবার ভাটি অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে কড়াদার মা ও শিশু কড়াদাকে কোন এক নদীর ঘাটে মরণাপন্ন অবস্থায় খুঁজে পান। কলেরা আক্রান্ত গ্রামের বাসিন্দা ওরা; শ্বশুরবাড়ি জায়গা হয়নি বলে বাধ্য হয়ে নিঃস্ব বাপের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে মা-ছেলে। কেউ ওদের ছুঁতে চাইছে না, যদি মরণ-ব্যাধির ছোঁয়া লাগে সেই ভয়ে। ঘাটের এক কোনায় নাওয়া-খাওয়াহীন পড়েছিল দুটো প্রাণী। হয়তো একসময় মরেই যেত। দাদাজানের দয়া হল। ওদের অসহায় অবস্থা দেখে এতটাই কাতর হয়ে পড়েন তিনি যে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এসে নিজের বাড়ির এক কোনায় থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। ঘটনাটি বাড়ির অনেকেরই পছন্দ হয়নি তখন। একে ধর্মে হিন্দু, তার ওপর নিজের বাড়ির আঙিনায় জায়গা করে দেয়া; বাড়ির অন্যরা অদূর ভবিষ্যতে শরীকী সমস্যা হতে পারে ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দাদাজানের সামনে কারও এ নিয়ে কথা বলার বুকের পাটা ছিল না বলে ধীরে ধীরে বিষয়টি অনেকেই না পারতে মেনে নেয়। কড়াদার মায়ের শ্বশুর ও পিতৃ পরিবারের কাউকে কোনদিন আমাদের দাদাজানের বাড়ি আসতে দেখিনি। শুনেছি, কড়াদার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছে এবং অন্যরা ওরা মুসলমান হয়ে গেছে মনে করে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। সত্যিকার অর্থেই দুটি মানুষ ছিল এতিম, নিঃস্ব ও দুঃখী। ওদের ওই কষ্টটুকু কড়া বয়সে আমার পক্ষে বোঝার কথা নয়। দাদাজান হয়তো বুঝতে পারতেন; হয়তো সেজন্য পরিবারের বাধা সত্ত্বেও ওদের থাকতে দিয়েছিলেন নিজের বাড়ির এক কোনায়! কড়াদার মাকে আমরা মাসিমা বলে ডাকতাম। মহিলা দাদাজানের বাড়ির এক কোনে দোচালা একটি ঘরে কড়াদাকে নিয়ে বসবাস করত। মাটির উনোনে রান্না-বান্না করে খেত। পাঁচফোঁড়নের সম্বার দিয়ে যখন নিরামিষ রাধত তখন পুরো বাড়ি মৌ-মৌ করত। কড়াদার মায়ের হাতের সেই নিরামিষ তরকারি আর মুগের ডাল খাওয়ার জন্য আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম। পেঁয়াজ-রসুনের ঝাঁঝ ছাড়াও যে রান্না করা তরকারি সুস্বাদু হতে পারে তা ওই কম বয়সে বোঝবার কথা নয় আমার। তবু বুঝে ফেলেছিলাম। (চলবে)
×