ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পল্লী বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে জনজীবন দুর্বিষহ

গ্রামীণ জনপদে মাঝে মাঝে বিদ্যুত আসে মাত্র

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১ জুলাই ২০১৬

গ্রামীণ জনপদে মাঝে মাঝে বিদ্যুত আসে মাত্র

রশিদ মামুন ॥ কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক মোঃ মোতায়েম হোসেন স্বপন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে মুক্তির জন্য একটি আবেদন করেন মে মাসে। সেই আবেদনটি গত ১৮ মে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ আজিম উদ্দিন বিশ্বাস বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে প্রেরণ করেন। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুতের জন্য এমন হাহাকার দেশজুড়েই রয়েছে। শিল্প মালিকদের হাহাকার আরও তীব্র। গত ১৩ জুন পাবনার ইশ্বরদী স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলহাজ মোঃ নুরুল ইসলাম খান পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্থানীয় জেনারেল ম্যানেজারের (জিএম) কাছে আবেদন করেছেন। একই সঙ্গে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন এই উদ্যোক্তা। বিদ্যুতের উন্নয়নের জোয়ারে ভাসার গালগল্পের মধ্যে সারাদেশের গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতবঞ্চিত হওয়ার হাহাকার ক্ষোভে রূপ নিয়েছে। যার খবর আসছে খোদ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। গ্রামে বিদ্যুত ব্যবস্থার নাজেহাল পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ মনে করে গ্রামে বিদ্যুত থাকে নাÑ মাঝে মাঝে আসে মাত্র। পল্লী বিদ্যুত সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখলে রহস্যভরে জানতে চান তাদের লোডশেডিংয়ের ব্যবসা কেমন চলছে? বিদ্যুত সপ্তাহে এসব বিষয় নিয়ে নাটক বানিয়েও প্রচার করেছে বিদ্যুত বিভাগ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শায়লা শারমিন নড়াইল থেকে টেলিফোনে জনকণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সাড়ে ৫ ঘণ্টা সময়ে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা বিদ্যুত থাকে। বাকিটা সময় বিদ্যুতবিহীন থাকতে হয় তাদের। এ পরিস্থিতি এক দিনের নয় নিত্যদিনের। কেন বিদ্যুত থাকে না এ প্রশ্নের উত্তরও নড়াইলের বিতরণকারী কর্তৃপক্ষের কেউ গ্রাহককে দেয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশের অন্তত ১৪টি জেলার বিদ্যুতের সরবরাহ অতিমাত্রায় খারাপ। আরইবি তাদের প্রচলিত লোডশেডিংয়ের প্রতিবেদন থেকে জেলাগুলোকে সরিয়ে রেখেছে। পৃথক প্রতিবেদন বলছে, জেলাগুলোতে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুতও সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির সঞ্চালন সীমাবদ্ধতা। এসব জায়গাতে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ১৩২ কেভি লাইন ওভারলোড অবস্থায় রয়েছে। যে জেলাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ সেগুলো হচ্ছেÑ শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মেহেরপুর, নাটোর, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং চাঁদপুর। এর বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুরের কয়েকটি উপজেলা, কুলিয়ারচর, ঘাটাইল, ভূয়াপুরে আরইবির বিদ্যুত সরবরাহে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সূত্র জানায়, চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে সারাদেশের পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোর। এর মধ্যে অন্তত ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিজেদের কারিগরি ত্রুটির কারণে নিতে পারে না। আন্যদিকে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ১৩২ কেভি লাইন ওভারলোডেড থাকার কারণে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ করা যায় না। অর্থাৎ আরইবিকে ১০০ ভাগ বিদ্যুত সরবরাহ করা হলেও এই ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়। এর বাইরে পিডিবির উৎপাদন কম হওয়ার কারণে সঙ্কট তো রয়েছেই। আরইবির গত চার মাসের বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার হিসাব বলছে, লোডশেডিং প্রায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে গ্রামীণ জনপদে। আরইবি বিদ্যুত চাহিদা এবং বিতরণের যে দৈনিক প্রতিবেদন বিদ্যুত বিভাগে জমা দেয় তাতে দেখা যায় নিত্যদিনই বিদ্যুতের সঙ্কটে ভুগছে সমিতিগুলো। গত ১ মার্চ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত আরইবির বিদ্যুত প্রাপ্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোন কোন দিন গত বছরের তুলনায়ও তারা কম বিদ্যুতের সরবরাহ পাচ্ছে। চলতি জুন মাসের ১, ৩ ও ৫ তারিখে এমন নজির রয়েছে। ২৫ জুন পর্যন্ত সরবরাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৫ দিনের মধ্যে ১০ দিন আরইবির চাহিদার ৮০ থেকে ৮৭ ভাগ বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। একদিন চাহিদার ৭৬ ভাগ বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ১৪ দিন চাহিদার ৯০ ভাগের উপরে সরবরাহ করা হয়েছে। জুনে সর্বনিম্ন ৭৬ ভাগ (৪ জুন) সরবরাহের দিন পল্লী বিদ্যুতায়ন এলাকায় ১ হাজার ৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। ১২ এবং ১৩ জুন সর্বোচ্চ চাহিদার ৯৭ ভাগ সরবরাহ করেও ১৩০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে (ওভারলোডেড এলাকার বাইরে এ চিত্র)। গত মে মাসে ৩১ দিনের বিদ্যুত বিবরণ পরিস্থিতির মধ্যে দেখা যায়, ১১ দিন গত বছরের তুলনায় আরইবিকে চলতি বছর কম সরবরাহ করা হয়েছে। ১ মে আরইবিকে চাহিদার ৮৯ ভাগ বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। ওই দিন একই সঙ্গে বিগত বছরের তুলনায় এক হাজার ১৬৮ মেগাওয়াট কম সরবরাহ দেয়া হয়। ১০ থেকে ১৮ মে তারিখের মধ্যে কেবলমাত্র ১৫ মে ছাড়া প্রত্যেক দিন বিগত বছরের তুলনায় কম বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। এর বাইরে ২০ এবং ২১ মে তারিখেও একই অবস্থা ছিল। বিতরণ ব্যবস্থায় দেখা যায়, ৯০ থেকে ১০০ ভাগের মধ্যে মাসের ১৭ দিন বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। ৮০ থেকে ৯০ ভাগের মধ্যে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে ৫ দিন। এছাড়া বাকি নয় দিন ৬০ থেকে ৭০ ভাগ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়। ওই মাসে ৩ মে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৮৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। যদিও এ মাসে ৫ দিন শূন্য লোডশেডিং করার কথাও বলছে প্রতিবেদন। গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ লোডশেডিং করা হয় ২৬ এপ্রিল দুই হাজার ৪৬ মেগাওয়াট। গত বছর এপ্রিলের তুলনায় ৮ দিন কম সরবরাহ করা হয়। এপ্রিলে ১৩ দিন ৯০ থেকে ১০০ ভাগের মধ্যে আরইবির চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়। এপ্রিলে ১৩ দিন ৯০ থেকে ১০০ ভাগ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল ২ দিন আর ৯ দিন সরবরাহ ছিল চাহিদার ৭০ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে। বাকি ছয় দিন ৫০ থেকে ৬০ ভাগের কোটায়। গত মার্চেও এ সঙ্কটের চিত্র দেখা যায়। ১৫ মার্চ সর্বোচ্চ আরইবি এলাকায় ৬৪১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। তবে মার্চে বিবেচ্য ৪ মাসের তুলনায় পরিস্থিতি একটু ভাল ছিল। ওই মাসের ২৩ দিনই আরইবিকে চাহিদার ৯০ থেকে ১০০ ভাগের মধ্যে সরবরাহ দেয়া হয়েছে। তবে ওই সময় সেচ কাজের জন্য সরবরাহ কিছুটা বেশি দেয়া হয়। সেচ শেষের দিকে গ্রামের বিদ্যুতে ভাগ বসায় শহর। ঈশ্বরদী স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ মোঃ নুরুল ইসলাম খান পাবনা পল্লী বিদ্যুত সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার বরাবর দেয়া চিঠিতে বলেন, আপনাদের কাছে বার বার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের কথা বললেও দিতে পারছেন না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত দিচ্ছি-দিতেছি বলে দিন পার করছেন। যদি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত দিতে না পারে তবে আমরা বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুত সংযোগ গ্রহণ করব। সেক্ষেত্রে বিআরইবি থেকে অনাপত্তি পত্র প্রদান করবেন। তিনি ওই চিঠির অনুলিপি বিদ্যুত বিভাগেও পাঠান। দেখা গেছে, একটু গরমেই পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। বিদ্যুত চলে গেলে গ্রাহক কখন আসবে জানার জন্য ফোন করেন বিতরণ কক্ষে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এখানেও তাদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বিদ্যুত বিভাগ নিজের উদ্যোগে মন্ত্রণালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম চালু করে। সরেজমিন ওই কন্ট্রোল রুমে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। আর ফোন করলে একজন কর্মকর্তা জানান, এটা আগে কন্ট্রোল রুমের নাম্বার ছিল এখন আর নেই। সম্প্রতি কন্ট্রোল রুমের অবস্থার বাস্তব অবস্থা ফুটে ওঠে বিদ্যুত বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলামের বিব্রত এক ফোন কলের পর। সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগ পরিবেশবাদীদের সঙ্গে এক আলোচনার আয়োজন করে রাজধানীর বিদ্যুত ভবনে। দুপুরের পর সেখানে দুই দফা বিদ্যুত চলে যায়। বিদ্যুত সচিব সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেও কেউ সেই ফোনে সাড়া দেননি। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ সময় বলেন, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী যেখানে যান সেখানেও এখন বিদ্যুত চলে যায়।
×