ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩ বছরের লোকসান ১ বছরে উঠে আসছে

রোজায় আমের বাজার তুঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৩০ জুন ২০১৬

রোজায় আমের বাজার তুঙ্গে

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ লাগাতার দীর্ঘ তিন বছর লোকশান গুনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ব্যবসায়ীরা পূজিপাট্টা হারিয়ে বিরূপ হয়ে উঠেছিল এই ব্যবসার প্রতি। কিন্তু ঠিক এই মৌসুমে এবার রোজাকে সামনে পেয়ে পরিবর্তন এসেছে আম ব্যবসায়ে। তিন বছরের লোকশান একই সাথে এক বছরে উঠিয়ে নেবার আনন্দে আত্মহারা জেলার আম চাষী, আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা। এভাবে আম ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে এটা কোনভাবেই আগাম অনুধাবন করতে পারেনি। এই অঞ্চলের আম সম্পৃক্ত সব ধরনের মানুষ। ইতোমধ্যেই বহু মানুষ আম ব্যবসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া শুরু করেছিল। তারা আবার ফিরতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই জেলা জুড়ে প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা সম্পন্ন হয়েছে। বাকি রয়েছে ফজলি, আশ্বিনাসহ প্রায় ২১টি চেনা অচেনা জাত। সম পরিমাণ না হলেও কাছাকাছি অংকের লাভ হতে পারে বলে নিশ্চিত হয়েছে আম ব্যবসায়ীরা। জেলার সর্ববৃহত আম উৎপাদনকারী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরসহ শিবগঞ্জের প্রায় সাড়ে চার হাজার আম আড়তের লক্ষাধিক শ্রমিক সামাল দিতে পারছে না আম পাড়া, মৌজুদ ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। অনুরূপভাবে ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন ও গোমস্তাপুর অঞ্চলে ফজলি, আশ্বিনাসহ ২১ জাতের আমে ঠাসা বাগান। এগুলো সবই আগাম জাতের, বাইরে নামলা জাত বলে খ্যাত। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এখনও প্রতিদিন চাঁপাইনাবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর থেকে একাধিক আম আড়ত থেকে প্রায় ৮০ হাজারের অধিক আম ভর্তি ট্রাক দেশের বিভিন্ন মোকামের উদ্দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছেড়ে যাচ্ছে। রোজাকে সামনে রেখে এবার সমগ্র দেশে বেড়েছে আমের চাহিদা, সাথে সাথে হু হু করে বাড়ছে আমের দাম। চড়া মূল্য দিয়ে বেপারীরা আম কিনছে। বিশেষ করে দেশের সর্ববৃহত আম বাজার কানসাটের প্রায় পৌনে তিন হাজার আড়ত ছাপিয়ে হাজার খানেকের অতিরিক্ত ভাসমান আড়তের সৃষ্টি হয়েছে কানসাট- সোনামসজিদ সড়কে। যার বিস্তৃতি কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। এসব ভাসমান আড়তে আমের দাম কিছুটা কম হবার কারণে বাইরের পাইকার, মহাজন ও বেপারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এসব বাজারে। এদের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই আগাম জাত গোপালভোগ, ক্ষিরশা, লখনাসহ প্রায় ৬১টি চেনা অচেনা জাত একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজারে ল্যাংড়াসহ ৬৮টি গুটি জাত পাওয়া গেলেও তা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে বেপারীরা। কারণ ইতোমধ্যেই ল্যাংড়া ছাড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ। ল্যাংড়া এই মুহূর্তে সীমিত আকারে পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে এসেছে বারির ১০টি জাত। এসব ক্রস করা হাই ব্রিগেড জাত আম দেখতে চোখ জুড়ানো। অনেক বড় বড়। দীর্ঘস্থায়ী ও পাকলেও শক্ত থাকে ভিতর বলে চাহিদা অধিক। প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে প্রায় চার হাজার টাকার কাছাকাছি। ইতোমধ্যেই বাজারে এসে পড়েছে সুরমা ফজলিসহ এই জাতের প্রায় ৭ ধরনের আম। বেপারী ও দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতা করে বাগান থেকে আগাম আম কেনা শুরু করেছে। তাদের টার্গেট ল্যাংড়া ইতোমধ্যেই শেষের পথে থাকলেও এর চাহিদা পূরণ করবে ফজলি দিয়ে। তারা চাচ্ছে ফজলির পুরোটা ও আশ্বিনার আংশিক দিয়ে রোজা শেষ করতে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা রোজা শেষ হলে আমের চাহিদা কি পর্যায়ে থাকবে তা কেউ বলতে পারছে না। তাই ফজলির মাধ্যমে রোজা মৌসুম শেষ করতে চাচ্ছ বলে প্রচ-ভাবে বেড়ে গেছে ফজলির চাহিদা। স্থানীয়ভাবে আমের কেনা বেচা ও খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে চড়ামূল্যের কারণে। এখন আম ব্যবসায়ী ও আড়ত গুনছে টাকার বান্ডিল আগাম আম বিক্রির। কানসাট, মহারাজপুর, বারঘরিয়া, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুরের ৪১টি পয়েন্টে এবার আমের কেনাবেচা এতটাই বেশি যে তারা এখন পর্যন্ত লাভের পরিমাণ নিরূপন করতে পারেনি। জেলার প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর আমের জমিতে রয়েছে প্রায় ৩১ হাজার ছোট-বড় আম বাগান গাছের সংখ্যা ২২ লাখ। যার প্রত্যেকটি এবার লাভ করেছে তিনগুণের অধিক। কানসাটের আম ব্যবসায়ী তৈমুর রহমান তিনটি বাগাম থেকে এবার এখন পর্যন্ত ৬১ লাখ টাকা লাভ করেছেন। এখনও অন্যান্য জাতের গাছে কাঁচা আম ঝুলছে। অনুরূপভাবে সদরের বিল্লাহ, মহারাজপুরের আনিস, কানসাটের তালেব, সুরাট, মকিম, লালাসহ ২১ আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা অতীতের লস পূরণ করেও কায়েকগুণ লাভ করেছে। এবার লোকসানের আশঙ্কার বহু বাগান মালিক যাদের সংখ্যা অর্ধ সহস্রাধিক হবে। তারা যথাসময়ে বাগান বিক্রি করতে না পেরে হতাশার মধ্যে ছিল। তারা এবার শেষ মুহূর্তে এসে বাগানের দাম পেয়েছে চিন্তার বাইরে। তারা এখন নতুন করে শক্তি পেয়েছে আম ব্যবসায়ের প্রতি। তাই আগাম বাগান পরিচর্চাতে মন দিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো এলাকায় ভারতের মুর্শিদাবাদ ও মালদহের অবস্থান। এখানে আমের চড়ামূল্য থাকার কারণে ব্যাপকভাবে ভারতীয় আম ঢুকছে বাংলাদেশে। এক কথায় এবার রোজা আম ব্যবসায়ীদের এনে দিয়েছে লাভের এক বিশাল মোহনায়। জাত পাত না বুঝেই আম উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাইকার ও ব্যাপারীরা দেশের অভ্যন্তর ভাগের বাজারে। ইফতারিতে যোগ হয়েছে অভিজাতসহ সকল শ্রেণীর মানুষের ইফতার ও সেহরি পাতে আম। তাই এবার নজরকাড়া অস্বাভাবিক চাহিাদ আমের। শতবর্ষের অতীত রেকর্ড ভেঙ্গে এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম জায়গা করে নিয়েছে চড়ামূল্যের সারিতে। তাই এবার দেশের অভ্যন্তর বাগের বাজারে রাজশাহীসহ দেশের ১৭টি অঞ্চলের আম বিক্রি হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বলে। তবে একটি আশার কথা পুরো মৌসুম জুড়ে প্রচ- তাপদাহ ও গরম থাকায় প্রায় প্রতিটি জাত আগাম কোন কেমিক্যাল ছাড়াই প্রাকৃতিক ভাবে পরিপক্কতা পেয়ে পাকছে। তাছাড়া খরার কারণে এবার কেমিক্যালমুক্ত আম বাইরের বাজারে খুবই সুস্বাদু। এক কথা মধুমাস আমকে দিয়ে এবার প্রকৃতি বড় ধরনের ফায়দা লোটার কারণেই আমে কার্বোহাইড্রেড বা চিনির স্বাদ অধিক পরিমাণে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাড়ছে চাহিদা। দাম উঠছে হুহু করে।
×