ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টিআইবি বলছে সেবা নিতে ১৫৮০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ জুন ২০১৬

টিআইবি বলছে সেবা নিতে ১৫৮০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে বিভিন্ন সেবা খাতে ৬৭.৮ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে ও ৫৮.১ ভাগ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয়েছে। জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এছাড়া দেশের মানুষ বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮ লাখ টাকা মোট ঘুষ দিতে হয়েছে, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ ভাগ। সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে (তুলনাযোগ্য খাতের ভিত্তিতে) ঘুষের লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪শ’ ৯৭ দশমিক ৩ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ৬ শতাংশ ঘুষ বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার জাতীয় সেবা খাতের দুর্নীতি ২০১৫ এর খানা জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে আয়েজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়, সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে। এর হার ৭৭.৭ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হন ৭৪.৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০.৮ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশের ১৫ হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ৭ম বারের মতো খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৭.৮% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে; ৫৮.১ ভাগ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। খানা প্রতি বাৎসরিক গড় পরিমাণ ৪ হাজার ৫শ’ ৩৮ টাকা। ২০১৫ সালে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার ২০১২ তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু সেবা গ্রহণকারী খানাসমূহকে ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে। জরিপে সেবা গ্রহণের প্রেক্ষিতে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে পাসপোর্ট ৭৭ দশমিক ৭ ভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪ দশমিক ৬ ভাগ, শিক্ষা (সরকারী ও এমপিওভুক্ত) ৬০ দশমিক ৮ ভাগ, বিআরটিএ ৬০ দশমিক ১ ভাগ, ভূমি প্রশাসন ৫৩ দশমিক ৪, বিচারিক সেবা পেতে ৪৮ দশমিক ২ ভাগ ও স্বাস্থ্য সেবা পেতে ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ লোককে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। বিভিন্ন খাতে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের জনগণের ওপর ঘুষ তথা দুর্নীতির বোঝা অধিক। জরিপে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৭১ ভাগ খানা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটিকে চিহ্নিত করেছেন। অনুষ্ঠানে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি হলো নৈতিকতার ওপর হামলা স্বরূপ, অন্যদিকে ঘুষ যেন প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কমিউনিটি সিরিজের আলোকে নমুনা কাঠামো তৈরি করে তিন পর্যায় বিশিষ্ট স্তরায়িত গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতিতে জরিপটি পরিচালিত হয়। ২০১৪ সালের নবেম্বর থেকে অক্টোবর ২০১৫ পর্যন্ত খানাসমূহ ১৫টি প্রধান ও অন্যান্য খাতে যেসকল সেবা গ্রহণ করেছে তার ওপর ভিত্তি করে ১ নবেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাঁচজন বিশেষজ্ঞের সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। পল্লী এলাকায় ৭০ ভাগ এবং শহর এলাকায় ৩০ ভাগ নমুনা বিবেচনায় ও ৬৪টি জেলা ও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে স্তর বিবেচনায় প্রতি স্তরে দৈবচয়ণের মাধ্যমে ২৪০টি খানা নির্বাচন করা হয়। জরিপের আওতাভুক্ত মোট ১৫ হাজার ৮শ’ ৪০টি খানার মধ্যে ১৫ হাজার ২শ’ ৬টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৭০ দশমিক ৬ ভাগ ও শহরাঞ্চলে ২৯ দশমিক ৪ ভাগ খানা। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় গুরুত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ১৫টি প্রধান খাতকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুত, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ, বীমা। এছাড়া তথ্য প্রদানকারীরা এর অতিরিক্ত যে সকল খাত উপ-খাতের তথ্য প্রদান করেন সেগুলো ‘অন্যান্য’ হিসেবে ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাক বিভাগকে বিবেচনা করা হয়। জাতীয় খানা জরিপের সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার হওয়ার হার ২০১২ সালের তুলনায় সার্বিকভাবে বেড়েছে ৫৮.১ ভাগ বনাম ৫১.৮ ভাগ। তবে সার্বিকভাবে অনিয়ম দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, এনজিও ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার, বিদ্যুত ও বীমা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত আছে। এছাড়া স্বাস্থ্য, বিচারিক সেবা, ভূমি প্রশাসনসহ মোট ৬টি খাতে ঘুষের শিকার খানার হার ২০১২ এর তুলনায় কমেছে। তবে শিক্ষা, বিদ্যুত এবং এনজিওর ক্ষেত্রে এই হার বেড়েছে। ঘুষের হার অপরিবর্তিত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক ও অন্যান্য খাত। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামঞ্চলে সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি ৬২ দশমিক ৬ ভাগ বনাম ৬৯ দশমিক ৫ ভাগ। অনুরূপভাবে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামঞ্চলে ঘুষ প্রদানে বাধ্য হবার হারও বেশি ৫৩ দশমিক ৪ ভাগ বনাম ৫৯ দশমিক ৬ ভাগ। ২০১৫ সালের জাতীয় খানা জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৬ দশমিক ১ ভাগ এবং বিদ্যুত খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৩১ দশমিক ৯ ভাগ। খাতওয়ারি হারের ক্ষেত্রে কৃষিতে ২৫ দশমিক ৮ ভাগ, কর ও শুল্ক খাতে ১৮ দশমিক ১ ভাগ, গ্যাস ১১ দশমিক ৯ ভাগ, বীমা খাতে ৭ দশমিক ৮ ভাগ, ব্যাংকিং সেবায় ৫ দশমিক ৩ ভাগ, এনজিও খাতে ৩ ভাগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিটিসিএল, ডাক, ওয়াসা ইত্যাদি খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ১৭ দশমিক ১ ভাগ। গ্যাসের সংযোগ নিতে গিয়ে খানাকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে যার গড় পরিমাণ ২৭ হাজার ১শ’ ৬৬ টাকা। এছাড়া বীমা খাতে সেবা নিতে খানাকে গড়ে ১৩ হাজার ৪শ’ ৬৫ টাকা ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে। জরিপে অন্তর্ভুক্ত খানাকে বিচারিক সেবার ক্ষেত্রে গড়ে ৯ হাজার ৬৮৬ টাকা এবং ভূমি প্রশাসনে গড়ে ৯ হাজার ২৫৭ টাকা পর্যন্ত ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে। প্রতিবেদনে দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান আইনের আওতায় আনা, সেবা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদৃঢ় নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা এবং এর ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এছাড়াও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা প্রদানে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং সেবাগ্রহীতা ও সেবাপ্রদানকারীর মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধিসহ গণশুনানির আয়োজন করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকা-ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা এবং একইসঙ্গে এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে সক্রিয়তা বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সার্বিকভাবে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, জনগণের সেবা সম্পর্কিত তথ্যে অভিগম্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা খাতে অনলাইনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে দুর্নীতিবিরোধী আইন, তথ্য অধিকার আইন ও বিশেষ করে তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইনের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ কার্যকর বাস্তবায়ন করা ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১ এর প্রয়োগে প্রচারণা ও প্রণোদনাসহ বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও অন্যান্য বাধা দূর করতে পদ্ধতিগত সংস্কার করা, জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের ঘাটতি দূরীকরণে সেবা খাতগুলোতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়।
×