ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী নারীর অনিন্দ্য প্রকাশ শাড়িতে, ঈদে বাড়তি আবেদন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ জুন ২০১৬

বাঙালী নারীর অনিন্দ্য প্রকাশ শাড়িতে, ঈদে বাড়তি আবেদন

মোরসালিন মিজান ॥ আলমারির প্রথম তাকে সে রাখল সব নীল শাড়ির/হালকা নীল একটা কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ/দ্বিতীয় তাকে রাখল সব গোলাপীর/একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘তোর নাম অভিমান’/তৃতীয় তাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ/তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ...। শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে এমন অনেক গল্প লেখা থাকে। বাঙালী নারীর যাপিত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই শাড়ি। বহু বহু কাল আগে থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পরিধেয় বস্ত্রটি নারীকে প্রকাশ করে আসছে। গাঁয়ে এখনও শাড়ির কোন বিকল্প নেই। শহরের চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। এখানে প্রতিদিন শাড়ি পরতে দেখা যায় খুব কম মেয়েকেই। তবে, উৎসব পার্বণে শাড়ির কোন তুলনা হয় না। আর এখন তো ঈদ! নিজস্ব ঐতিহ্য ও অহঙ্কারের স্মারক হয়ে সামনে এসেছে শাড়ি। আর সব কেনাকাটার সঙ্গে সযতেœ শাড়ি কিনছেন নারীরা। শাড়ির সূচনা কীভাবে, সেই ইতিহাস এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের বলাটি এরকম- আদিম কালে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ ছিল না। সেলাইবিহিন অখ- বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে ‘ধুতি’ এবং মেয়েদের বেলায় ‘শাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। তখন যেহেতু সেলাই করার কৌশল জানা ছিল না তাই সেলাই ছাড়া টুকরা কাপড় পরাই ছিল স্বাভাবিক। গবেষকদের মতে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। সেই থেকে এখনও আছে শাড়ি। আজকের আধুনিক সময়ে বদলে গেছে অনেক কিছুই। শাড়ি পরেন এমন নারীর সংখ্যাও কমেছে। তাই বলে আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। গ্রামে তো বটেই, শহরেও পরিণত বয়সের নারীরা নিত্য দিন শাড়ি পরে কাটান। অপেক্ষাকৃত কম মেয়েরা শখ করে শাড়ি পরে। বর্তমানে দেশের নানা অঞ্চলে শাড়ি তৈরি হচ্ছে। ঢাকা, ডেমরা, রূপগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ বেশ কিছু এলাকা শাড়ির জন্য বিখ্যাত। এসব এলাকা থেকে আসা শাড়িতে এখন ভরে ওঠেছে ঢাকার বিপণি বিতানগুলো। ঈদ সামনে রেখে দারুণ জমজমাট শাড়ির বাজার। গত কয়েকদিন রাজধানী শহর ঢাকার বিভিন্ন বিপণি বিতান ঘুরে দেখা যায়, শাড়ির বিপুল সংগ্রহ। ঢাকাই জামদানি, বেনারসি, রাজশাহী সিল্ক, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, কাতান শাড়িÑ কী নেই! দেশীয় শাড়ির মধ্যে তাঁতের শাড়ি বিশেষ চোখে পড়ে। পাশাপাশি আছে মিলের শাড়ি। সব ধরনের শাড়ির চমৎকার প্রদর্শনী হচ্ছে বেইলী রোডে। এখানে অনেকগুলো দোকানে সারাবছর শাড়ি বিক্রি হয়। বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভিড় বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে গেছে। বেইলী রোডের সবচেয়ে পুরনো দোকান টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। ছোট্ট একটি ঘরে শুরু। এখন সুদৃশ্য তিনতলার পুরোটা শাড়ি দিয়ে সাজানো। সুতি ও সিল্কের শাড়ি আছে। ঈদ উপলক্ষে মসলিনের ওপর সুন্দর হাতের কাজ করা হয়েছে। আছে এম্ব্রয়ডারি, ব্লক ও স্ক্রিনপ্রিন্ট। ম্যানেজার জসিম উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, সময় বদলাচ্ছে। তাই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সম্বয়ের একটি চেষ্টা করি আমরা। আমাদের এখানে প্রবীণরা শাড়ি কিনতে আসেন না। বরং অনেক তরুণী পছন্দের শাড়ি খুঁজতে আসেন। ৩৫ বছর আগে শুরু হওয়া শাড়ির ব্যবসা ভবিষ্যতেও নির্বিঘেœ চলবে বলে মনে করেন তিনি। বাংলার গৌরব ও আভিজাত্যের প্রতীক মসলিন অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এখন মার্কেটে আছে সেই ধারার বিভিন্ন কাজ। মসলিনের উত্তরাধিকার জামদানিকে ঈদের প্রধান আকর্ষণ বলা চলে। নিউমার্কেট, ইস্টার্ন প্লাজার দোকানগুলোতে জামদানির বিপুল বিক্রি দেখে অবাকই হতে হয়! ঈদ উপলক্ষে শহরে জামদানি মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। এসব মেলায়ও আগ্রহী ক্রেতার অভাব হচ্ছে না। জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত জামদানি মেলা ঘুরে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। রূপগঞ্জের বিসিক শিল্প নগরী থেকে আসা কারিগররা এখানে স্টল সাজিয়ে ছিলেন। তাঁদের একজনের নাম জহিরুল ইসলাম। সেতু জামদানি কুটিরের কর্ণধার বলেন, শাড়ি তো বাঙালী নারীর প্রথম পছন্দ। এই পছন্দের কথা মাথায় রেখে আমরা কাজ করি। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে দুইজন কারিগরের ছয় মাস সময় লেগে যায়। এটা কেবল শাড়ির বেলায়ই সম্ভব। জামদানির দাম বেশি। এর পরও নারীরা এসব শাড়ি কিনে পরেন। এই ভালবাসাই শাড়ি পরার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। ঐতিহ্য ধরে রেখেই জামদানির নক্সায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয় বলে জানান তিনি। অবশ্য শাড়ি নিয়ে সবচেয়ে সাম্প্রতিক নিরীক্ষা দেখার জন্য একবার আজিজ সুপার মার্কেটে ঢুঁ মারা চাই। এখানে নিত্য উপহার নামের ফ্যাশন হাউসটি ১২ হাত লম্বা শাড়িকে ক্যানভাসের মতো ব্যবহার করেছে। শাড়ির গায়ে লেখা হয়েছে কবিতার প্রিয় পঙক্তি। কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানের মতো শিল্পীদের করা নক্সা শাড়ির গায়ে দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ফ্যাশন হাউসটির কর্ণধার বাহার বলেন, শাড়ি অনেক লম্বা হয়। প্রচুর জায়গা পাওয়া যায় ছবি আঁকার জন্য। আমরা সুযোগটি দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছি। এসব শাড়ি নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। এভাবে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও, টিকে আছে শাড়ি। আবেদন ফুরোয়নি। বুধবার বেইলী রোডে শাড়ি কিনতে এসেছিলেন দিলসাদ নাহার। একটি কলেজে পড়ান। বললেন, আমরা তো কলেজে যেতাম শাড়ি পরে। এখন নিজে শিক্ষক। ছাত্র ছাত্রীদের পড়াই। তা-ও শাড়ি পরেই! ঈদ উপলক্ষে এখন পর্যন্ত ৪টি শাড়ি কিনেছেন বলে জানান তিনি। তরুণী ও মাঝবয়সী নারীরাও খুব শখ করে শাড়ি কিনছেন। গাউসিয়ায় এমন দৃশ্য বেশি দেখা গেল। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী মৌমিতা বললেন, ঈদ উপলক্ষে জামা বেশি কিনি। কিন্তু শাড়িটা স্পেশাল। ঈদের দিন আমরা সব বান্ধবীরা শাড়ি পরে বেড়াই। এ জন্যই অসহ্য গরমের মধ্যেও শাড়ির খোঁজ করছেন বলে জানান তিনি। নিউ মার্কেটের একটি দোকানে শাড়ি কিনতে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন এক পুরুষ ক্রেতা। আগ্রহ নিয়ে তাকে অনুসরণ করে জানা গেল, তিনি মায়ের জন্য শাড়ি খুঁজছেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যেটি পছন্দ হয়েছে, দাম অনেক বেশি। তবুও কিনে নিলেন। কেন? জানতে চাইলে বললেন, আমাদের হরেক রকমের কেনাকাটা। কিন্তু মায়ের জন্য শাড়িটাই ঈদ। আর তো কিছু দেয়ার থাকে না। বৃদ্ধ মা এখনও নতুন শাড়ি পেলে খুশি হন। শাড়ি পরেন। পছন্দের শাড়ি আলমিরাতে জমিয়ে রাখেন। পরের কথাটি শুনে চোখ ছল ছল করে ওঠল। তিনি বললেন, শুধু তো শাড়ি নয়। মায়ের আঁচল! এই আঁচলেই তো মুখ মুছে বড় হয়েছি!
×