ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে শচীন;###;মোঃ মামুন রশীদ

‘সেও একটা পদক পেয়েছে’

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৯ জুন ২০১৬

‘সেও একটা পদক পেয়েছে’

শচীন টেন্ডুলকরের প্রথমবার ভারতীয় দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটা বেশ ভালই যাচ্ছিল। ঐতিহাসিক এ সিরিজটির ডারবান ও জোহানেসবার্গে প্রথম দুই টেস্টেই অনুষ্ঠিত স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ড্র করতে সক্ষম হয়েছিল ভারত। পোর্ট এলিজাবেথে তৃতীয় টেস্ট খেলার জন্য যায় ভারত। লিটল মাস্টার শচীন একটা বিষয় এ সফরে বুঝতে পেরেছিলেন পেসারদের বিরুদ্ধে বোলিং দ্রুতগতির উইকেটে টেস্ট খেলাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের। তবে সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে তরুন শচীন জোহানেসবার্গে সেঞ্চুরি আদায় করে নেন। প্রোটিয়া পেসারদের মধ্যে এ্যালান ডোনাল্ড, রিচার্ড ¯েœল, মেরিক প্রিঙ্গল, ব্রায়ান ম্যাকমিলানরা দারুন বোলিং করছিলেন। এর সঙ্গে দুরন্ত হয়ে ওঠেন ক্রেইগ ম্যাথুসও। তিনি নির্দিষ্ট জায়গায় টানা বল ফেলার ক্ষেত্রে দারুণ সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং এর পাশাপাশি অফস্টাম্পের বাইরে নির্দিষ্ট ছন্দে বোলিং করে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য দারুণ চাপের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তার বলগুলো অধিকাংশই ব্যাটে লাগানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই শরীরের বিভিন্ন স্থানে গতিময় বলগুলোর আঘাত নিতে হয়েছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল যে পুরো ভারতীয় দলের প্রায় সবারই ঊরু কিংবা পাঁজরে আঘাতের কালসিটে পড়ে গিয়েছিল। সেটাকেই মজা করে ড্রেসিং রুমে একে অপরকে ভারতীয় ক্রিকেটাররা বলতেন, ‘দেখ, দেখ সেও একটা পদক পেয়েছে!’ নিজের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’তে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শচীন। ম্যাথুস বল ফেলতেন অফস্টাম্পের ওপরে, দারুণ গতি নিয়ে সেই বলগুলো আউটসুইং করে বেরিয়ে যেত অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে। সে কারণে ম্যাথুসের অধিকাংশ বলই ব্যাট চালানোর চেষ্টা না করে ছেড়ে দিতেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কিছুটা বৈচিত্র্য আনতেন ম্যাথুস। হুট করে কোন একটি বল ইনসুইং করাতেন। আর সেই বলগুলো ছিল ভয়ানক! সেই বলগুলো ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল একেকটি বিভীষিকা। পোর্ট এলিজাবেথে তৃতীয় টেস্টে ম্যাথুসের বলের আঘাত লাগেনি এমন কোন ব্যাটসম্যান ছিলেন না স্কোয়াডে। দারুণ গতির সেই বলগুলো শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লেগে কালসিটে পড়ে যেত। প্রথমদিকে এটা নিয়ে সবার মধ্যে একটা ভীতি থাকলেও সেটা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে দারুণ কৌতুকময় ব্যাপার। ম্যাথুসের বলে আঘাত না পাওয়াটাই ছিল ব্যতিক্রম। ড্রেসিং রুমে সেটা নিয়ে চলত হাসি-ঠাট্টা। কেউ একজন আঘাত পেয়ে আসার পর সবাই মিলে দেখতেন যেখানে লেগেছে সেটার কি অবস্থা। কোন কালসিটে পাওয়া গেলেই সবাই বলতেন, ‘দেখ, দেখ সেও একটা পদক পেয়েছে!’ আর এমন বোলারের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়েই পরাজয় দেখে ভারত। পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে হারেন শচীনরা। ম্যাথুস ভীতি কাজে লাগিয়ে ‘সাদা বিদ্যুৎ’ এলান ডোনাল্ড তার কৌশলী বোলিংয়ে ১২ উইকেট শিকার করেন। যদিও উভয় দলের প্রথম ইনিংস শেষে কোন দলই এগিয়ে ছিলনা, নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারত যে কোন দলের পক্ষেই। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে পার্থক্যটা গড়ে দেন ডোনাল্ড। শুরুতেই তিনি জেঁকে বসেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ওপর। মাত্র ৩১ রানের মধ্যে প্রথম ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। তবে ওই অবস্থা থেকে দলকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যান কপিল দেব। দুর্দান্ত একটি সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। এ কারণেই কিছুটা সুযোগ ছিল ভারতের জন্যও। শচীন এই ম্যাচে আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হন। ব্রেন্ট শুলজের বলে কট বিহাইন্ড হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয়েছিল যদিও আদৌ সেটা শচীনের ব্যাটে স্পর্শ করেনি। আসলে বলটি আঘাত করেছিল শচীনের ঊরুতে। ম্যাচশেষে আম্পায়ার শচীনের সঙ্গে দেখা করেন এবং ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেটা মেনে নেয়ার মতোই ব্যাপার। ক্রিকেটে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে আম্পায়ারদের। আর মানুষ মাত্রই যে কোন বিষয়ে মাঝে মাঝে ভুল করেই থাকে। কেপটাউনে সিরিজের চতুর্থ ও শেষ টেস্টে জিততে মরিয়া ছিল ভারত। ক্রিকেটাররা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সিরিজে সমতা আনার ব্যাপারে। ১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারি এই টেস্ট শুরু হয়েছিল। ভারতীয় দল এই টেস্টে খারাপ খেলেনি, তবে সমতা আনতে পারেনি। জাভাগাল শ্রীনাথ দারুণ বোলিং করেছিলেন কেপটাউনে এবং ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। রাউন্ড দ্য উইকেটে শচীনকে অনেকগুলো ওভার বোলিং করার সুযোগ পেয়েছেন ডোনাল্ড। কেপটাউন সমধিক পরিচিত স্পঞ্জি বাউন্সের জন্য। তাই শচীনকে ভড়কে দিতে অধিকাংশ বলই তিনি করেছিলেন শর্ট অব লেন্থে। সে কারণে তাঁকে মোকাবেলার কৌশল হিসেবে ভিন্ন মনোভাব নিয়ে খেলেছেন শচীন। তিনি শর্ট বোলিং করছিলেন এবং বলগুলোকে শচীনের শরীরের ওপরের রাখছিলেন। এভাবে চলতে থাকার পর লিটল মাস্টার খুব ভালভাবেই বুঝতে পারলেন করণীয়টা। তিনি বুঝলেন ডোনাল্ডকে ঠেকানোর সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে তাকে হতাশ করা। শচীনের চিন্তাভাবনাটা খুবই সাধারণ ছিল। যদি বেশ লম্বা কেউ তাদের উচ্চতা ব্যবহার করে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে এই বলগুলো অনায়াসে খেলতে পারে, তাহলে খর্বাকৃতির কেউ পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বলগুলোকে নিচ থেকেই খেলতে পারে। তাই শচীন ম্যাচটিতে তার খেলার ভঙ্গিমায় পরিবর্তন আনেন। সাধারণত শচীন ব্যাটিংয়ের সময় দুই পায়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান রাখতেন দশ ইঞ্চি থেকে এক ফুটের মতো। কিন্তু এই ধরনের বলগুলো মোকাবেলার জন্য দুই পায়ের দূরত্ব বাড়িয়ে দুই ফুট থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত করেন তিনি। এর ফলে যতটা উচ্চতা শচীনের, ব্যাট চালানোর সময় সেটার চেয়েও খাটো হয়ে যেতেন। ফলে খুব সহজেই হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা ডোনাল্ডের বলগুলোকে নিচে থেকে মোকাবেলা করতে পারছিলেন। এটা খুবই কার্যকর হয়েছিল এবং প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা ব্যাটিং করে ৭৩ রানের একটি ইনিংস খেলেন ২০৮ বলের মোকাবেলায়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচে না জিতলেও ড্র করে ভারত। ফলে টেস্ট সিরিজ হারতে হয় ১-০ ব্যবধানে। ওয়ানডে সিরিজটি অনিবার্য কারণে খেলা হয়েছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্টের মাঝ সময়ে। আর সে সময়ই প্রথম দুটি নতুন বলের ব্যবহার হয়েছিল। প্রতিপ্রান্ত থেকে একটি নকরে নতুন বলে খেলা হয়েছে ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবার। ৭ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দারুণ খেলেছিল ভারত, তবে সিরিজ হারে ৫-২ ব্যবধানে। অধিকাংশ ম্যাচই ছিল লো- স্কোরিং এবং ২০০ কিংবা এর আশপাশে করা ইনিংসগুলোই ছিল দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার। দুই ফরমেটেই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে গেলেও শচীন মনে করেন বিশ্বের সেরা কিছু ফাস্ট বোলারকে মোকাবেলা করা ছিল দারুণ উপভোগ্য। কঠিন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষ করে ভারতীয় দল প্রস্তুত হতে থাকে গ্রাহামগুচের ইংল্যান্ডকে মোকাবেলার জন্য। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে তারা ভারত সফরে এসেছিল। সেটাও বিশেষ এক সিরিজ শচীনের জন্য। কারণ ঘরের মাটিতে এটিই ছিল তাঁর প্রথম টেস্ট সিরিজ। (চলবে...) তথ্যসূত্র : শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে
×