ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

লালকার্ডে শুরু হলুদ কার্ড ও কান্নায় শেষ

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৯ জুন ২০১৬

লালকার্ডে শুরু হলুদ কার্ড ও কান্নায় শেষ

ব্যর্থতার বোতলে বন্দী ছিলেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। বার বার চেষ্টা করেছেন সেই বৃত্ত ভাঙার। কিন্তু পারেননি। লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে অনুজ্জ্বলই থেকে গেছেন। অথচ এই মেসি প্রশ্নাতীতভাবে বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের সেরা তারকা। ক্লাব ফুটবলে বার্সিলোনার হয়ে অবিশ্বাস্য সাফল্যগাথার কারণেই এ স্বীকৃতি। অথচ জাতীয় দলের হয়ে অর্জনের ভা-ারটা বরাবরই শূন্য ফুটবলের ক্ষুদে জাদুকরের। এই অপূর্ণতা রেখেই গত ২৭ জুন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন মেসি। জাতীয় দলে মেসির এক যুগের ক্যারিয়ারটা মোটেও সুখকর হয়নি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে অভিষেক হয় এই বিস্ময় বালকের। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে বুদাপেস্টের মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লালকার্ড দেখে মেসির অভিষেকটা হয়েছিল কালিমাময়। অবাক করা বিষয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেসির বিদায়টাও হয়েছে তেতো। চিলির বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে মেজাজ হারিয়ে দেখেছেন হলুদ কার্ড। অর্থাৎ বর্ণময় মেসির ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল লালকার্ডে আর শেষটা হলো হলুদ কার্ড ও কান্নার স্রোতে। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬Ñটানা তিন বছর অপবাদ ঘোচানোর সুবর্ণ সুযোগ আসে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের সামনে। তিনবারই তীরে এসে তরী ডুবিয়েছেন রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের ফিফা সেরা ফুটবলার। সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রে শতবর্ষী কোপা আমেরিকা ফুটবলের ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনা টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হেরেছে চিলির কাছে। ফলে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়ের উৎসব করেছে চিলি। আর আর্জেন্টিনার ২৩ বছরের শিরোপাকরা ঘোচানোর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে হার দিয়ে হতাশার যাত্রা শুরু হয় আর্জেন্টিনার। এরপর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারল দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ। সঙ্গতকারণেই হতাশ গোটা আর্জেন্টিনা দল। দুঃখ, কষ্টের বারতা সবচেয়ে বেশি ছেয়ে গেছে মেসির মানসপটে। বার বার চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি এসে ব্যর্থতা সহ্য করতে পারেননি গত ২৪ জুন ২৯ বছরে পা রাখা মেসি। তাইতো ম্যাচ শেষে কান্নাভেজা কণ্ঠে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। বিদায়ক্ষণে আবেগাল্পুত কণ্ঠে মেসি বলেন, আমার জন্য জাতীয় দল আজ থেকে শেষ হয়ে গেছে। যা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল আমি সবকিছুই করেছি। চারটি ফাইনালে খেলেছি কিন্তু দুর্ভাগ্য, একটিতেও জিততে পারিনি। এটা আমার ও পুরো দলের জন্য অত্যন্ত কঠিন মুহূর্ত। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আর্জেন্টিনার হয়ে আমার যাত্রা এখানেই শেষ। বিদায়বেলায় অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন দেশের হয়ে নিজের ব্যর্থতা। এ প্রসঙ্গে মেসি বলেন, আবারও আকাশসমান হারের বেদনায় জর্জরিত হয়েছি। আমি নিজে টাইব্রেকার মিস করেছি, যেটা দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর্জেন্টিনার হয়ে একটি শিরোপা জিততে আমার সবটুকু সামর্থ্যই উজাড় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। সাফল্যটা ধরা দিল না। কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন? মেসি নিজেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। বলেন, এসব নিয়ে বিশ্লেষণের সময় এটা নয়। ড্রেসিংরুমে বসে আমার মনে হলো জাতীয় দলের হয়ে আর নয়। জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য, শিরোপা জয়, এসব আমার জন্য নয়। তবে মেসির আচমকা অবসর মানতে পারছেন না ফুটবলবিশ্বে তার কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থক। তাইতো অবসর ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মেসিকে ফিরে আসার আকুতি জানাচ্ছেন ভক্তকুলরা। দক্ষিণ আমেরিকার এক সাংবাদিকও মেসিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেনÑ ‘আপনি কি আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন?’ জবাবে মেসি বলেছেন, না, আমি মনে করি না যে আমি ফিরব। আমি আর ফিরব না। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। আমি আমার সর্বস্ব দিয়েছি। এটা আমার চতুর্থ ফাইনাল। এখানেও হেরে গেলাম। অস্বস্তি প্রকাশ করে মেসি আরও বলেন, গত কয়েক ঘণ্টা ধরে কী ঘটছে, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন ভর করেছিল আমার ওপর। কিন্তু এটাই বাস্তব। অবসরের ক্ষণে মেসির বয়স মাত্র ২৯ বছর। ফর্মটাও যে মন্দ তা নয়। খেলছিলেন দুর্দান্ত। এখনও অবলীলায় খেলতে পারেন আরও পাঁচ-সাত বছর। খেলবেন, তবে জাতীয় দলের হয়ে নয়। শুধু ক্লাব ফুটবলে বার্সিলোনার জার্সিতে। কিন্তু হুট করে জাতীয় দল থেকে মেসির এমন অবসরের সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না অনেকে। জাতীয় দলের সতীর্থরাতো বটেই, ভক্ত-সমর্থকরা আরও আবেগী। টুইটার, ফেসবুকে জোর আবেদন, ফিরে এসো মেসি। চিলির সঙ্গে ফাইনাল হারের পর মেসির শিশুর মতো কান্না ছুঁয়ে গেছে সবার মন। মেসির সতীর্থরা ছাড়াও শত্রুপক্ষের লোকজনও সমবেদনা জানাচ্ছেন। চিলি অধিনায়ক ক্লাউডিও ব্রাভো বুঝতে পারছেন মেসির মনের অবস্থা। দুজন একসঙ্গে খেলেন বার্সিলোনার হয়ে। ব্রাভো তাই মেসিকে অনুরোধ জানিয়েছেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার। সার্জিও এ্যাগুয়েরো যেমন বলেছেন, মেসি উত্তেজনার বশেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোর মতে, এই সিদ্ধান্ত থেকে হয়ত সরে আসতে পারেন মেসি। ২০০৪ সালে পেশাদারি ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর পর একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন মেসি। তবে সব কিছুই স্প্যানিশ ক্লাব বার্সিলোনার হয়ে। গত ১২ বছরে কাতালানদের হয়ে জিতেছেন আটটি স্প্যানিশ লা লীগা, চারটি কোপা ডেল রে ও চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপা। লা লীগার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটিও নিজের করে নিয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচবার। এছাড়া আরও অনেক গৌরবময় রেকর্ড নিজের পদতলে আঁছড়ে ফেলেছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই ফুটবলের সম্ভব-অসম্ভব অনেক অর্জনই নিজের করে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের হয়ে ২০০৫ সাল থেকে তাঁর প্রাপ্তির ঘর শূন্যই। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিকের ফুটবলে স্বর্ণপদক ছাড়া আর্জেন্টিনার আকাশি-নীল জার্সিতে কখনোই শেষ হাসিটা হাসতে পারেননি। ২০০৬ থেকে খেলেছেন টানা তিনটি বিশ্বকাপ। প্রথম দুইবার দলকে বিদায় নিতে দেখেছিলেন শেষ আট থেকে। অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড নিয়ে ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুললেও শেষটা হয় কান্নাভেজা। ২০০৭ থেকে খেলেছেন চারটি কোপা আমেরিকা। এর মধ্যে তিন তিনবার ফাইনাল মঞ্চে খেলেছেন। কিন্তু প্রাপ্তির ঘরটা শূন্যই থেকেছে। ২০০৫ সালে অভিষেকের পর আর্জেন্টিনার হয়ে ১১৩টি ম্যাচ খেলেছেন মেসি। ৫৫টি গোল করে গড়েছেন নতুন রেকর্ড। আর্জেন্টিনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডে ছাড়িয়ে গেছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। কিন্তু তাতে কি! দলীয় অর্জনের খাতাটি একেবারেই শূন্য। তাই তো বলা হচ্ছে, বার্সার হয়ে কিংবদন্তি বনে যাওয়া মেসির আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অনুজ্জ্বল প্রস্থান ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বশেষ কোন শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেবার দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপ খ্যাত ‘কোপা আমেরিকা’ জিতে নেয় তারা। কিন্তু গত তিন বছরে তিনটি শিরোপা হাতছাড়া হয়েছে সুপারস্টার মেসি ও তার সতীর্থদের। সেই ব্যর্থতার কষ্টে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরই নিয়ে ফেলছেন মেসি। মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা জ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো ও সার্জিও এ্যাগুয়েরোও অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। অবসর নেয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে লুকাস বিগলিয়া, গঞ্জালো হিগুয়াইন, এভার বানেগা, এজেকুয়েল ল্যাভেজ্জি ও এ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াদের। অধিনায়ক মেসির পথ অনুসরণ করে একই ঘোষণা দিয়েছেন ২৮ বছর বয়সী এ্যাগুয়েরো ও ৩২ বছর বয়সী মাশ্চেরানো। আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগের মেরুদ- মাশ্চেরানো ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অধিনায়কও ছিলেন। নেতৃত্ব ছাড়ার পর ২০১৪ বিশ্বকাপ, ২০১৫ কোপা এবং এবারের কোপা এই তিনটি ফাইনাল খেলেও তিনি শিরোপা স্বাদ পাননি। শুধু এসব আক্ষেপই নয়, অবসর নেয়ার পেছনে আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আর্জেন্টিনিয়ান ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ফুটবলারদের মতপার্থক্য এবং শীতল সম্পর্ক। ফুটবল স্টাফদের সঙ্গেও তেমন বনিবনা হচ্ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে হতাশায় এই তারকা ফুটবলারদ্বয় মেসির পথ অনুসরণ করেছেন। এ কারণে ফুটবলসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সামনে আর্জেন্টিনার ফুটবলে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ উতরাতে পারবে কিনা এই প্রশ্ন চলে এসেছে।
×