ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্টিভ স্বার্থপর নয়, বলে দিলেন সৌরভ

প্রকাশিত: ১৯:১৪, ২৮ জুন ২০১৬

স্টিভ স্বার্থপর নয়, বলে দিলেন সৌরভ

অনলাইন ডেস্ক ॥ সৌরভ ‘কামব্যাক’ গাঙ্গুলি মনেপ্রাণে আর একটা প্রত্যাবর্তন দেখতে চাইছেন। কোনও ক্রিকেটারের নন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় চাইছেন লিওনেল মেসির কামব্যাক দেখতে। টসের জন্য যাঁকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন, এত বছর পরে সেই স্টিভ ওয়র পাশে দাঁড়াচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শেন ওয়ার্ন বনাম স্টিভ ওয় বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলছেন এবং বলে দিচ্ছেন ওয়ার্ন ভুল, স্টিভ ঠিক। অথচ মেনে নিচ্ছেন, সেই স্টিভ ওয়কে সতেরোর খুদে উইকেটকিপার পার্থিব পটেলের গুজরাতি ইংরেজিতে স্লেজিং দারুণ উপভোগ করতেন। মেনে নিচ্ছেন, স্টিভকে স্লেজ করতে চাননি বলে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ থেকে এক সতীর্থকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। রাহুল দ্রাবিড়কে সরিয়ে দিয়েছিলেন! সেই সতীর্থকে নিয়ে সৌরভ বলে দিচ্ছেন, ‘‘দ্রাবিড় ঠিক সময় একেবারে ঠিক কথাগুলো বলতে পারে। এই যে একদম ঠিক সময় বলে দিল, আমাকে জুনিয়র কোচ করে দাও! আমি ওটা পারি না।’’ শোনা যাচ্ছে আপনিই নাকি রবি শাস্ত্রীকে সরিয়ে অনিল কুম্বলেকে কোচ করেছেন? শুনে সৌরভ বলে দিচ্ছেন, ‘‘নেক্সট কোয়েশ্চেন!’’ এক মাস পরেই সিএবি নির্বাচন। লড়তে হলে কী করবেন? ‘‘দেখা যাক। হলে হবে। না হলে অন্য কিছু করব।’’ স্থান, সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুল। উপলক্ষ, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ক্যাপ্টেন ৬০০ ইকিউআর আয়োজিত ‘মুখোমুখি সৌরভ’। যেখানে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে যে রকম খোলামেলা মেজাজে পাওয়া গেল, অনায়াসে অনুষ্ঠানটার নাম পাল্টে করে দেওয়া যায় ‘সৌরভ আনপ্লাগ্‌ড’! ফুটবল রাজপুত্রের আন্তর্জাতিক অবসর ঘোষণার ঘণ্টাকয়েক পরে যে আড্ডায় সৌরভ বলে দিলেন, মেসির সিদ্ধান্তে তিনি প্রচণ্ড অবাক। আশা করছেন, মেসি ফিরে আসবেন। তাঁর সর্বকালের সেরা ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা, যাঁর সঙ্গে তুলনায় আসতে গেলে মেসির একটা বিশ্বকাপ চাই-ই। ‘‘জানি না মেসি এটা কেন করল। হয়তো হারের হতাশা থেকে। কোপা ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে পেনাল্টি মিস করাটা খুবই হতাশার। আমার কিন্তু মনে হয় না এটা ঠিক সিদ্ধান্ত,’’ বলে সৌরভ জুড়ে দেন, ‘‘আশা করছি আর্জেন্তিনার ফেডারেশন মেসিকে ফেরাবে। ও আরও একটা বিশ্বকাপ খেলে দিতে পারে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মেসি ফিরে এসেছে, পরের বিশ্বকাপে খেলছেও।’’ শুনতে শুনতে আশ্চর্য লাগে। যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কামব্যাকের স্লোগান এক সময় রাজ্য বনাম দেশ ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিয়েছিল, সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও তা হলে কারও প্রত্যাবর্তনের প্রহর গুনছেন! যাঁকে তাঁর অন্যতম ‘শত্রু’ হিসেবে ভেবে এসেছে ক্রিকেটবিশ্ব, ভেতরে ভেতরে সেই স্টিভ ওয়কে তা হলে এতটা শ্রদ্ধা করেন সৌরভ! সঞ্চালক গৌতম ভট্টাচার্যের সঙ্গে আড্ডায় শুধু মেসি নন। কপিল দেবের রেকর্ড থেকে সৌরভের বায়োপিক, সিএবি নির্বাচন থেকে ফেলুদা, অনিল কুম্বলে থেকে স্টিভ ওয়— উঠে এল নানা গল্প, নানা তথ্য। কিছু জানা, কিছু কিছু আবার পরম সৌরভ-ভক্তকেও চমকে দেবে। স্টিভ ওয়কে টসে অপেক্ষা করিয়ে রেখে তার কোন কারণ দেখিয়েছিলেন কলকাতার রাজপুত্র, কারও অজানা নয়। কিন্তু ব্রিসবেনে জীবনের শেষ টেস্টের আগে সৌরভকে ডেকে স্টিভ কী বলেছিলেন, ক’জন জানেন? ক’জন জানেন, টেস্টের আগের দিন ম্যাচ রেফারির মিটিং সেরে স্টিভ প্রায় অনুরোধ করেছিলেন, ‘স্কিপার, এই টসটা ঠিক সময়ে করি?’ ক’জন জানেন সৌরভের উত্তর— আমি তোমার আগেই পৌঁছে যাব। তবে একটা শর্তে। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে যখন কলামটা লিখবে, আমাকে নিয়ে ভাল কিছু লিখো! এই স্টিভের বিরুদ্ধে যখন ওয়ার্ন স্বার্থপরতার অভিযোগ তোলেন, সৌরভ সটান ওয়ার্নকে বলে দেন, এটা ঠিক করলে না। ‘‘ওরা খুব আলাদা দু’জন চরিত্র। কিন্তু দু’জনেই চ্যাম্পিয়ন,’’ বলেন সৌরভ। সাউথ পয়েন্টের প্রাক্তন ছাত্র, পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী-সহ অনেকেই তাঁকে নিয়ে বায়োপিকে আগ্রহী, কেউ কেউ নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু সন্দীপ রায় যখন হন্যে হয়ে নতুন ফেলুদা খুঁজছিলেন, তখন যে একটা প্রস্তাব গিয়েছিল বীরেন রায় রোডের বাড়িটাতেও, ক’জন জানেন? যে প্রসঙ্গ তুলে সৌরভকে জিজ্ঞেস করা হল, প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিলেন কেন? ফেলুদা তো আপনার খুব প্রিয় চরিত্র। সৌরভের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘যেটা যার কাজ...!’’ গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে তাঁর সুমধুর সম্পর্ক ভারতীয় ক্রিকেটে লোকগাথা। কিন্তু ব্রিসবেনে সৌরভ যখন সেঞ্চুরির কাছাকাছি, মিসেস গ্রেগ চ্যাপেলের তখন স্বামীকে দেখে কী মনে হচ্ছিল, জানার সৌভাগ্য ক’জনের হয়েছে? গ্রেগকে দেখে জুডি চ্যাপেলের মনে হয়েছিল, ক্রিজে বুঝি তাঁদের জামাই ব্যাট করছেন! ঘটনাটা যত না মজার, তার চেয়েও মজাদার সৌরভের উত্তর, ‘‘আমি তো ওঁর মেয়েকে কোনও দিন দেখিওনি। ওর কোনও অনিষ্টও করিনি। তা হলে আমার উপর অত রাগ করলেন কেন?’’ এগুলো যদি পছন্দের স্পিন হয়, তা হলে কড়া বাউন্সারও সামলাতে হল সৌরভকে। যেমন, এক মাস দূরের সিএবি নির্বাচন। যেমন, বিশ্বরূপ দে। যেমন, শাস্ত্রীকে সরিয়ে কুম্বলেকে কোচ করা নিয়ে জল্পনা। যেমন, আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটে ‘দাদার বিভূতি’ শব্দদ্বয়ের আবির্ভাব। ‘‘পরের প্রশ্ন, পরের প্রশ্ন’’ বলে কয়েকটা ডাক করলেন। শেষেরটার উত্তরে যা বললেন, অনায়াসে তাঁর আত্মজীবনীর ট্যাগলাইন করে দেওয়া যায়— আমি যত না অবিচারের শিকার, তার চেয়ে অনেক বেশি আশীর্বাদধন্য! ক্রিকেটার হিসেবে, দেশের অধিনায়ক হিসেবে কম কিছু পাননি সৌরভ। তবে আজও মনে করেন, ছিয়ানব্বইয়ের লর্ডস তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর প্রশ্নে সৌরভ বলে দেন, ‘‘ওই টেস্টটা মানুষ হিসেবে আমাকে বদলে দিয়েছিল।’’ ঐতিহাসিক ওই সেঞ্চুরির পরের দিনের আনন্দবাজার পত্রিকার ফ্রেমে বাঁধানো প্রথম পাতা উপহার দেওয়া হল তাঁকে। সৌরভ বললেন, তিনি অভিভূত। নিজের বাড়িতে এই ফ্রেম খুব যত্ন করে রেখে দেবেন। সেই সেঞ্চুরির পর যখন হেলমেট খুলেছিলেন, মাথায় অনেক বেশি চুল ছিল। এখন হয়তো কিছুটা কম। কিন্তু তখনও চলমান অনুপ্রেরণা ছিলেন, আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মানে এখনও মোটিভেশনাল ক্যাপসুল। না হলে কেন তাঁকে দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাজারখানেক স্কুল-পড়ুয়া? না হলে কেন একটা স্কুলের প্রতিটা তলা কেঁপে ওঠে প্রিয় ‘দাদা’কে দেখার হুড়োহুড়িতে? না হলে কেন তাদের দেখা দিতে গাড়িতে উঠেও আবার নেমে আসতে হয় সৌরভকে? তার আগে ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের জীবন দর্শনের প্রেজেন্টেশন দিয়ে গিয়েছেন সৌরভ। বলেছেন, ‘‘যা-ই করো না কেন, তাতে সেরা হওয়ার চেষ্টা করবে। তা হলে কেউ তোমাকে অপছন্দ করলেও সে তোমার প্রশংসা করতে বাধ্য হবে।’’ বলেছেন, স্টিভ ওয়র মতো ব্যক্তিত্বকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার ঔদ্ধত্য দেখানো যায় একমাত্র যখন তাকে হারানোর ক্ষমতাটাও পাশাপাশি থাকে। ক্রিকেট উৎসাহী ছাত্রদের বলেছেন, বিরাট কোহালিকে দেখে শেখো। খেলাটার বেসিকস আগে ঠিক করো। ভিজে টেনিস বলে খেলে টেকনিক ঠিক করো। বলেছেন, ক্রিকেটকে বরাবর দেখে এসেছেন প্রেমিকার মতো, যার জন্য সব কিছু করতে সব সময় তৈরি ছিলেন। মঞ্চে ছিলেন ঘণ্টাখানেক। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্ভাবনা আর সাহসের যে সৌরভের সন্ধান দিয়ে গেলেন, তার রেশ বোধহয় অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী! সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×