ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ১ লাখ ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা ঋণ চুক্তির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৮ জুন ২০১৬

পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঋণচুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পাশাপাশি মন্ত্রিসভা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে সবার হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদী জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ২০১১ সাল থেকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়। তখন উভয় সরকারের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি (আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঋণচুক্তি) স্বাক্ষরিত হয়। তখনকার ওই এমওইউ’র আলোকেই এখন চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি এ্যাটমিক এনার্জি প্ল্যান্ট তৈরি করতে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণচুক্তি করা হচ্ছে। গত ১৯ মে মস্কোতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর সঙ্গে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সভার পর ‘মিনিটস ও ডিসকাশন’ স্বাক্ষরিত হয়। তার আলোকেই চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়েছে। রূপপুরে দুটি পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরিতে রাষ্ট্রের মোট ঋণের পরিমাণ ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্প নির্মাণ ব্যয়ের ১০ শতাংশ অগ্রিম হিসেবে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার ফেডারেশনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেবে। ঋণের বাস্তবায়নকাল ২০১৭ থেকে ২০২৪। ঋণ পরিশোধকাল প্রস্তাবিত অর্থায়ন শুরুর পর থেকে ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড। এই ১০ বছর পর থেকে শুরু করে মোট ৩০ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে। মূল ঋণের প্রথম কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে। প্রতি বছরের ১৫ মার্চ ও ১৫ সেপ্টেম্বর সমপরিমাণ কিস্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার উর্ধসীমা ৪ শতাংশের বেশি হবে না। শফিউল বলেন, মোট ব্যয় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন। বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ার অনুদান মিলিয়ে এই ব্যয় নির্বাহ করা হবে। কবে নাগাদ এই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সব প্রস্তুত, আশা করছি জুলাই বা আগস্টে এই চুক্তি হবে। রাশিয়ার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি এখানে (বাংলাদেশ) আসতে পারে বা আমাদের প্রতিনিধি দল ওখানে (রাশিয়া) যেতে পারে। পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠান এ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর চুক্তি হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের। সে অনুযায়ী, ২৪০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটে এ বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরি করা হবে; যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। ৫০ বছর আয়ুর এই বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২১ সালের মধ্যে চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুরে এই বিদ্যুতকেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালের আগস্টে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনায় কোম্পানি গঠন করতে সংসদে বিল পাস হয়। আইন অনুযায়ী, রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্রের মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনের হাতে। আর কেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্ব পাবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ। ১৯৬১ সালে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার পর ১৯৬৩ সালে প্রস্তাবিত ১২টি এলাকার মধ্য থেকে বেছে নেয়া হয় রূপপুরকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০ বছর আগের নেয়া সেই উদ্যোগ সক্রিয় করে তোলা হয়। দ্রুত পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২০১০ সালে সংসদে প্রস্তাব পাস করে গঠন করা হয় একটি জাতীয় কমিটি। ওই বছরই রাশিয়ার সঙ্গে একটি কাঠামো চুক্তি করে সরকার এবং ২০১১ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশে একটি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ দুই দেশ চুক্তি করে। প্রস্তাবিত এ কেন্দ্রের জন্য আগেই অধিগ্রহণ করা হয় ২৬২ একর জমি। এ্যাটমস্ট্রয়ের নক্সায় পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি দিয়ে রূপপুরে এই বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু থাকবে না। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্রের তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়াই ফেরত নিয়ে যাবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জাতীয় কমিটির তৃতীয় বৈঠক হয়েছিল ২০১৩ সালের ৭ আগস্ট। টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অনুমোদন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে সবার হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদী জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অনুমোদন করেছে মন্ত্রিপরিষদ। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটি ১৯৯৮ সালের টেলিযোগাযোগ নীতিমালাকে প্রতিস্থাপন করবে। টেলিযোগাযোগ নীতিমালা ১৯৯৮, জাতীয় আইসিটি নীতিমালা ২০১৫, জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা ২০০৯ এবং আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার টেলিযোগাযোগ সেবা নীতিমালা ২০১০ কে সমন্বিত করে এই নীতিমালা করা হয়েছে। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং নতুন বৈশ্বিক জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে ১০ বছরের জন্য এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন এই নীতিমালায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৮ সালের মধ্যে টেলিঘনত্ব (নাগরিকদের হাতে টেলিফোনের অনুপাত) ৮০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে ইন্টারনেটের বিস্তার ৩৪ থেকে ৪৫ শতাংশে, মোবাইল বা ফিক্সড ব্রডব্যান্ডের বিস্তার ৭ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে, সব জেলা-উপজেলা সদর এবং দুই হাজার ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ বিস্তৃত করা, সব উপজেলা সদরে উচ্চ গতির তারহীন ব্রডব্যান্ড সেবা পৌঁছে দেয়া এবং দেশে জিডিটাল সম্প্রচার চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রায় ছয়টি ‘টার্গেট’ ঠিক করা হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান। ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ টেলিঘনত্ব অর্জন, অর্থাৎ সকল নাগরিকের হাতে টেলিফোন থাকবে। ইন্টারনেটের বিস্তার ৬৫ শতাংশে উন্নীতকরণ, ব্রডব্যান্ডের বিস্তার ৪০ শতাংশে উন্নীতকরণ, সকল ইউনিয়নকে অপটিক্যাল ফাইবারের মহাসড়কে সম্পৃক্তকরণ, সকল ইউনিয়ন পর্যায়ে উচ্চ গতির তারবিহীন ব্রডব্যান্ড সেবা বিস্তৃতকরণ এবং দেশে ২০ শতাংশ বাসস্থান-প্রতিষ্ঠানে উচ্চ গতির অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কিং নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রায় ইন্টারনেটের বিস্তার ৯০ শতাংশে উন্নীত করা, জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে ব্রডব্যান্ড সেবা দেয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি এবং ৫০ শতাংশ বাসস্থান-প্রতিষ্ঠানে উচ্চ গতির অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত যত আইন আছে, তার সবগুলোকে সমন্বয় করে একটি আইন করা হবে।
×