ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অভিভাবকদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ

প্রাথমিক সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা আগের মতোই হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ জুন ২০১৬

প্রাথমিক সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা আগের মতোই হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমানের ঘোষণা আটকে গেল মন্ত্রিপরিষদে। প্রাথমিক স্তর অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় মন্ত্রণালয় পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে সায় দেয়নি মন্ত্রিসভা। ফলে এবারও বছর শেষে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় বসতে হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এদিকে ‘প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হবে না’ মন্ত্রীর এ ঘোষণার বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মাঝে। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্লাস ফাইভে যে সমাপনী পরীক্ষাটা হয় এটা বাতিল করে অষ্টম শ্রেণীতে প্রাইমারী সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার একটা প্রস্তাব ছিল। মন্ত্রিসভা এটা বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফের উপস্থাপনের জন্য বলেছে। মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আগের মতো প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চলতে থাকবে। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল- মন্ত্রিসভা তা মানেনি, এবারও পরীক্ষা হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার এই নিয়মিত বৈঠকে ‘অষ্টম শ্রেণীতে প্রাইমারী স্কুল সার্টিফিকেট (পিএসসি) পরীক্ষা পদ্ধতি চালুপূর্বক পঞ্চম শ্রেণী পর্যায়ে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলকরণ’ শীর্ষক ওই প্রস্তাব তোলা হলে তা ‘আরও পর্যালোচনা করে’ মন্ত্রিসভায় আনতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল বলেন, প্রস্তাবটি ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিস্তারিতভাবে ফের মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় এটা অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত আগের পদ্ধতি বহাল থাকবে। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে বাতিলের (পঞ্চমের সমাপনী পরীক্ষা) যে প্রক্রিয়া ছিল, সেটা এবার বাতিল করা যাবে না। কারণ প্রাথমিক স্কুল এক জায়গায়, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম আরেক জায়গায়। হাইস্কুলকে আধা ভাগ করে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। টোটাল ওয়ার্ক করে মন্ত্রিসভা প্রস্তাবটি আবার আনতে বলেছে। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব কত দিনের মধ্যে ফের মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর দিতে পারেননি। এর আগে শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবির প্রেক্ষাপটে গত ২১ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, চলতি বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় এবার থেকেই পঞ্চম শ্রেণিতে আর সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হবে না। কথা হয়ে গেছে, সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে শীঘ্রই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। এবার থেকেই পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা আর হবে না। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় এবার থেকেই পঞ্চম শ্রেণীতে আর সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে হাসিমুখেই মন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা যা বলি বা করি, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই করি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তো কথা বলি। তিনি আরও বলেছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় দু’টি সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এ বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে। অষ্টম শ্রেণীতে হবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার নাম ও অন্য বিষয়গুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রিসভায় একটি প্রস্তাব যাবে। আমি নিশ্চিত হয়েই বলছি, বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা থাকবে না। একেবারেই অষ্টম শ্রেণী শেষে হবে এ পরীক্ষা। মন্ত্রীর ওই ঘোষণায় স্বস্তি ফিরে এসেছিল দীর্ঘদিন ধরে এ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিশু ও উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের মনে। সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। তারা বলেছিলেন, পরীক্ষাটি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছিল। বাতিলের ঘোষণা হওয়ায় চিন্তা দূর হলো। অভিাভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ফোরামের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু করার পর থেকেই শিশুদের ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপানোর অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রচলন শুরু হয়। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় জেএসসি পরীক্ষা। ২০০৯ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা চালুর পরের বছর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য নেয়া হচ্ছে ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা। আগে পঞ্চম শ্রেণীতে আলাদা করে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়া হলেও প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী চালুর পর থেকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকেই বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। এ পরীক্ষার কারণে ঝরে পড়ার হার কমেছে বলে সরকারীভাবে দাবি করা হলেও অভিভাবক ও অনেক শিক্ষাবিদ শিশুদের স্বার্থে পরীক্ষাটি বাতিলের দাবি তোলেন। ২০১০ সালে শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হলে এ দাবি আরও জোরালো হয়। তখন থেকেই পঞ্চম শ্রেণীর বাতিল করে পরীক্ষাটি অষ্টম শ্রেণীতে করার দাবি জোরালো হয়। এমন এক অবস্থার মধ্যে গত ১৮ মে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার কাজ শুরু করে সরকার। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শেষবারের মতো এ বছর পঞ্চম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা নেবে। এ নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছেন দেশের নামী দামী স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আন্দোলনে নামেন ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরা। তারা দাবি পুরনে লাগাতার আন্দোলনেরও ঘোষণা দেন। এরই এক পর্যায়ে ২১ জুন মন্ত্রী পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এদিকে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মাঝে। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের আন্দোলরত অভিভাবকদের একজন রুকসানা হাসান বলছিলেন, সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম আমরা। আমরা স্বস্তির নিঃশাস ফেলেছিলাম। কিন্তু একজন মন্ত্রী এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা না বললেই হতো। শিশুদের নিয়ে এসব আর কত দিন চলবে? একেক সময় একেক কথা। উদয়ন স্কুলের অভিভাবক আকবর হোসেন বলছিলেন, এই গিনিপিগ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। একটি মারাত্মক ভুল স্বীকার করে শুধরে নেবার সাহসও তাদের নেই, এটাই প্রমাণ করে। এই দুটি পরীক্ষার কোনটাই একজন ছাত্রের শিক্ষা এবং জীবনের কোন নিশ্চয়তা যে দেয় না, তারপরও সেই যজ্ঞটি চালাতেই হবে, এটা কোন শিক্ষা অনুরাগী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এ পরীক্ষা আমাদের শিক্ষা/ছাত্র/শিক্ষক/অভিভাবক সকলকেই চরম বিপদের মধ্যে রেখেছে, তা-কি কর্তারা জানেন? আজ এটা তো কাল আরেকটা, কোমলমতি শিশুদের নিয়ে এসব ছেলেখেলার মানে কি? এমন প্রশ্ন করেন বিয়াম স্কুল এ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীর মা মৌসুমী আকতার। তিনি বলেন, সকালে এক নিয়ম, বিকেলে আরেক নিয়ম। শিক্ষা ব্যবস্থা নয় যেন খেলনা। ২১ তারিখ মন্ত্রী ঘোষণা দিলেন এ বছর সমাপনই পরীক্ষা হবে না। এখন আবার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হলো।
×