ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুকান্ত গুপ্ত

জীবনে বর্ষার আমেজ

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৭ জুন ২০১৬

জীবনে বর্ষার আমেজ

এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায় এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়। রমণীয় দৃশ্য দেখে এবং মধুর শব্দ শুনে সুখী প্রাণীও পর্যুৎসুক হয়ে ওঠে, তখন সে ভেবেচিন্তে বুদ্ধিপূর্বক না হলেও কোন জন্মজন্মান্তরের সৌহার্দ্যরে কথা স্মরণ করে। নূতন ঋতুর আবির্ভাবে ধরণীর চারদিকে যে পরিবর্তন ঘটে তা দেখে ও শুনে মানুষের মন সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেই নবসৌন্দর্যের মাধুর্যে আবিষ্ট হয়ে যায়। বর্ষা বিশ্বপ্রকৃতির অন্তগূঢ় কোন বেদনার কান্না। সেই অবিরল ধারায় বারিবর্ষণ দেখে আর আকাশ ঘেরা কালো মেঘের গভীর মায়া মনে লেগে মন উদাস আকুল হয়ে ওঠে। সুখী ব্যক্তিরাও মেঘ দেখে আনমনা হয়ে যায়। বর্ষা অনলে মন কেমন জানি উদাসিনী সেই আকাশের মতো। বর্ষায় বিরহ জাগে তখন প্রাণের আকুতি প্রণয় প্রতিবেদনে পরিব্যক্ত হতে চায়। যার জন্য মহাকবি কালিদাস হতে আরম্ভ করে বিদ্যাপতি পর্যন্ত সকল প্রাচীন কবির কবিতায় বর্ষার শুষ্ক বিরহিনী রূপ বর্ণিত হয়েছে। সে সব গান পথ চাহিয়া থাকা আনমনা অবস্থারই গান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- এক নারীর প্রেমের মধ্যে একটি অত্যন্ত আদিম প্রাথমিক ভাব আছে- তা বহিঃপ্রকৃতির অত্যন্ত নিকটবর্তী তাহা জলস্থল আকাশের গায়ে গায়ে সংলগ্ন। ষড়ঋতু আপন পুষ্প পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রেমকে নানা রঙ্গে রাঙ্গাইয়া দিয়া যায়। যাহাতে পল্লবকে স্পন্দিত, নদীকে তরঙ্গিত, শস্যশীর্ষকে হিল্লোলিত করে, তাহা ইহাকেও অপূর্ব চাঞ্চল্যে আন্দোলিত করিতে থাকে। পূর্ণিমার কোটাল ইহাকে স্ফীত করে এবং সন্ধ্যাভ্রের রক্তিমায় ইহাকে লজ্জামণ্ডিত বধূকে পরাইয়া দেয়। এক একটি ঋতু যখন আপন সোনার কাঠি লইয়া প্রেমকে স্পর্শ করে তখন সে রোমাঞ্চ কলেবরে না জাগিয়া থাকতে পারে না। সে অরণ্যের পুষ্প পল্লবের মতো প্রকৃতির নিগূঢ় স্পর্শাধীন। সেই জন্য যৌবনাবেশ বিধুর কালিদাস ছয় ঋতুর ছয় তারে নরনারীর প্রেম কিঞ্চিত সুরে বাজিতে থাকে। তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন- তিনি বুঝিয়াছেন, জগতে ঋতু অবতরণের সর্ব প্রধান কাজ প্রেম জাগানো, ফুল কাটানো প্রভৃতি অন্য সমস্তই তাহার আনুষঙ্গিক। যে কথা জীবনে অপরিব্যক্ত থেকে যাচ্ছে, যে কথা জগতের কোলহলে হারিয়ে যাবে তা যেন আজ এই মনবর্ষার যবনিকার অন্তরালে বসে কানে কানে বলা যায়।সেখানে যতটুকু ফাঁক সেইখানে ততটুকু মাথা গলাতে হয়। মাঝের থেকে দুই বাহু প্রসারিত করে এই অঞ্জলি পূর্ণ করে প্রকৃতির এই অগাধ অনন্ত বিস্তীর্ণতাকে গ্রহণ করতে পারি না। শেষের কবিতায় কবিগুরু বর্ষা, বৃষ্টি আর প্রেমের যে ছান্দিক মিল ঘটিয়েছিলেন তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে- ‘দুদান্ত বৃষ্টি। বৃষ্টির দিন, যাকে ভালবাসি তার দুই হাত চেপে ধরে বলতে ইচ্ছা করে জন্মে জন্মান্তরে আমি তোমার। আজ এই কথাটি বলা- সহজ। আজ সমস্ত আকাশ যে মরিয়া হয়ে উঠল হু হু করে কী হেঁকে বলেছে তার ঠিক নেই, তারি ভাষায় আজ বন বনান্তর ভাষা পেয়েছে, বৃষ্টিধারায় আবিষ্ট জগত আকাশে কান পেতে দাঁড়িয়েছে। কি মনের কথাটি বলার মগ্ন যে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এরপরে যখন কেউ আসবে তখন কথা জুটবে না, তখন সংশয় আসবে মনে। তখন তাণ্ডব নৃত্যোন্মও দেবতার মাভৈঃ রব আকাশে। মিলিয়ে যাবে, বছরের পর বছর নীরবে চলে যায়, তার মধ্যে বাণী একদিন বিশেষ প্রহরে হঠাৎ মানুষের দ্বারে এসে আঘাত করে। সেই সময়ে দ্বার খোলবার চাবিটি যদি না পাওয়া গেল, তবে কোন দিনই ঠিক কথাটি অকুণ্ঠিত স্বরে বলবার দৈবশক্তি জোটে না। যে দিন সেই বাণী আসে, সেদিন সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে খবর দিতে ইচ্ছে করে শোন তোমরা আমি ভালবাসি। ছবি : তানভির আহমেদ মডেল : রিমন ও সাদিয়া আফরিন
×