ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের কেনাকাটা

দেইখ্যা লন দুই শ, বাইছ্যা লন দুই শ... ফুটপাথে কেনাকাটার ধুম

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ জুন ২০১৬

দেইখ্যা লন দুই শ, বাইছ্যা লন দুই শ... ফুটপাথে কেনাকাটার ধুম

রহিম শেখ ॥ আলোকসজ্জা নেই। নেই বাহারি পুরস্কার কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। তারপরও ক্রেতার অভাব নেই। কখনও বৃষ্টি, কখনও বা প্রখর রোদে থেমে নেই বেচাকেনা। বাহারি ডিজাইনের সব পোশাক, জুতা, টুপি, আতর থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যার পসরা সাজিয়ে বসেনি ফুটপাথের দোকানিরা। বাদ পড়েনি ঘর সাজানোর পণ্য, বাচ্চাদের খেলনা, পারফিউম, রূপসজ্জার সামগ্রী। পণ্য বিক্রিতে হকারদের হাঁকডাকে ক্রেতার ভিড় এখন চোখে পড়ার মতো। শুধু সড়কের দু’পাশই নয়, রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজের ওপরেও বসেছে অস্থায়ী দোকানপাট। পথচারীদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব হাটের সবচেয়ে বড় ক্রেতা নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। তবে মধ্যম আয়ের ক্রেতারাও তাদের পছন্দসই পোশাকটি কিনতে ভিড় করেন ফুটপাথে। রাজধানীর মতিঝিল, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মিরপুর-১০, গুলিস্তান, নগর ভবন এলাকার ফুটপাথ ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের কেনাকাটার সবই পাওয়া যাচ্ছে এখানে। হকারদের কেউ কেউ ২শ’, ৩শ’, ৫শ’, আবার কেউ ‘দেইখ্যা লন দুই শ’, ‘বাইছ্যা লন দুই শ’, ‘এক দাম দুই শ’, ‘যেইটা নিবেন দুই শ’ টাকাÑ এমন সব সুর তুলে খরিদ্দার ডাকছেন। হাল ফ্যাশনের থ্রি-পিস, শার্ট-প্যান্ট থেকে আধুনিক ডিজাইনের জুতা, বিদেশী ব্র্যান্ডের প্রসাধনী ও সুগন্ধি সামগ্রী সবই পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাথে। হাতের নাগালে সবকিছু থাকায় বিকিকিনিও হচ্ছে দেদার। দামও নাগালের মধ্যে। এসব ফুটপাথে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ছোটদের পোশাক। বড়দের রেডিমেড শার্ট পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকায়। বিভিন্ন রঙ ও ডিজাইনের শার্টগুলো ভাল বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফার্মগেটের ফুটপাথ দোকানের বিক্রয়কর্মী রবিউল। ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের সামনে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রেতা আলিম উদ্দিন বলেন, সারাদিন বিক্রি ভালই হয়েছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এভাবে চললে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তিনি জানান, বিকেল পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে। তার দোকানে ১৫০ থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকার কাপড় রয়েছে বলে জানান। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশ গত ১ মাসে ধরে ফার্মগেটের ফুটপাথে বসতেই দেয়নি। তখন অনেকের মতো বাধ্য হয়ে ফেরি করে বিক্রি করতে হয়েছে। পুলিশের নাম করে বিভিন্ন লোকজনকে ঈদের বকশিশও দিতে হয়। নিউমাকের্টের ফুটপাথে জুতার পসরা সাজিয়ে নিয়মিত বসেন মোঃ রোকন নামে এক দোকানি। তিনি বললেন, বেচাবিক্রি ভালই, ক্রেতারাও আসছেন। বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাথে পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী মোঃ কাউয়ুম জানান, বড় মার্কেটের মতো এখানেও ভালমানের পাঞ্জাবি কম দামে পাওয়া যায়। প্রতিদিনই বিক্রি বাড়ছে। রাজধানী মতিঝিলের ফুটপাথে মেয়েদের পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন রমজান আলী। তিনি জানান, তার দোকানে অনেক ধরনের দেশী-বিদেশী থ্রি-পিস রয়েছে। এসব থ্রি-পিসের দাম ৯০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের টপস ও ফ্রক। এ বছর ঘেরওয়ালা লম্বা পোশাকের চাহিদা বেশি। পোশাক ছাড়াও ফুটপাথের এসব দোকানে নিত্য ব্যবহার্য প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায়। ছেলেদের পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট, বেল্ট, লুঙ্গি, টুপি, সুগন্ধি থেকে শুরু করে মেয়েদের শাড়ি, ঘড়ি, থ্রি-পিস, টু-পিস, সিঙ্গেল কামিজ, রেডিমেড কামিজ, টপস, টাইটস, গজ কাপড়, বিভিন্ন ধরনের অর্নামেন্টস, কসমেটিক্স, বাচ্চাদের পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, ফ্রক, স্কার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, বড়-ছোট সকলের জুতা, স্যান্ডেল, চশমাসহ সংসারের বাসনকোসনও মেলে এখানে। ফলে অনেকে ঈদ উপলক্ষে সংসারের জন্য নতুন গ্লাস সেট, প্লেট, টিফিন বক্স, শো-পিসও কিনে নেন এসব দোকান থেকে। রাজধানীর কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম। কাজ করেন মতিঝিলের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। রবিবার দুপুরে বেরিয়ে পড়েন সন্তানদের নিয়ে ঈদের পোশাক কিনতে। কিন্তু পড়েন বৃষ্টির বাগড়ায়। ছেলের একটি প্যান্ট কেনার পরই বৃষ্টি তাদের আটকে ফেলে গুলিস্তানে। শরিফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, একদিনেই অন্তত পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটার ইচ্ছে তার। মা-বাবার জন্য আরও একদিন মার্কেটে আসবেন। মূলত যাদের আয় একটু কম তারাই আসছেন নগরীর ফুটপাথে কেনাকাটা করতে। রাজধানীর বিলাসবহুল শপিংমলগুলো যখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের ভিড়ে সরগরম, তখন ফুটপাথের দোকানগুলো নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কেনাকাটায় জমজমাট হয়ে উঠছে। বিক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরুতে তেমন বেচাকেনা না হলেও এখন ভাল হচ্ছে ব্যবসা। তবে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা। রবিবার নিউমার্কেটের সামনে ফুটপাথের একটি দোকানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করছিলেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, বড় শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই এখান থেকেই ঈদের কেনাকাটা করি। এছাড়া এখানে কম দামে পছন্দের জিনিসও পাওয়া যায়। আর এসব জিনিসের মানও ভাল। আমি দেখেছি অনেক সময় একই জিনিস নামিদামি দোকানে কয়েকগুণ মূল্য দিয়ে বিক্রি করে। তবে ফুটপাথের পণ্যের দাম নিয়ে ভিন্নমতও আছে কারও কারও। পেশায় রংমিস্ত্রী জয়নাল বলেন, কিছুদিন আগেও যেসব টি-শার্ট ৩শ’ টাকায় কিনেছি, এখন তার দাম রাখা হচ্ছে ৫শ’ টাকা। চাঁদনী চক মার্কেটের সামনে গজ কাপড় কিনতে আসা একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিউলি আক্তার জানান, ভেতরের দোকানগুলোতে দাম বেশি। তাই ফুটপাথ থেকে থেকে কেনাকাটা করছি। তবে এখন ফুটপাথেও দাম বেশি বলে অভিযোগ করলেন শিউলি। ফুটপাথের বিক্রয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গার্মেন্টসে তৈরি নানা রঙের কাপড়ও বিক্রয় হচ্ছে ভাল। প্রতিটি প্যান্ট পিসের দাম পড়বে ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। তবে খুব ভালমানের কাপড় নিতে চাইলে দাম কিছুটা বেশি পড়বে। সেক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে একেকটি প্যান্ট পিস। বিক্রেতারা জানান, মার্কেট ভেদে ছেলেদের শার্ট বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, জিন্স প্যান্ট ৪৫০ থেকে সাড়ে ৮০০ টাকায়, টি-শার্ট ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, মেয়েদের থ্রি-পিস ৪৫০ টাকা থেকে ১০০০-১২০০ টাকা, শাড়ি ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা, বাচ্চাদের থ্রি-কোয়ার্টার জিন্স প্যান্ট ৪০০ টাকা, গেঞ্জির সেট ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, ফ্রক ও টপস ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা, ছেলে ও মেয়ে শিশুদের জন্য হাতাকাটা গেঞ্জি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। জামা কাপড়ের সঙ্গে ফুটপাথে পাওয়া যাচ্ছে ছোট-বড় সবার জন্য জুতাও। ছেলেদের প্রতিজোড়া জুতার দাম পড়বে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। দামী ব্র্যান্ডের আদলে ডিজাইন করা সু পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর ফুটপাথগুলোতে। দেখতে সুন্দর জুতাগুলো তৈরি করা হয় রেক্সিন ও চামড়ার মিশ্রণে। পাওয়া যায় মেয়েদের জুতাও। মাত্র ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেই মিলবে জুতা-সিøপার। এগুলোও তৈরি করা হয় রেক্সিন ও চামড়ার মিশ্রণে।
×