ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রেক্সিটে বাংলাদেশের দুই খাত ঝুঁকিতে পড়তে পারে

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৭ জুন ২০১৬

ব্রেক্সিটে বাংলাদেশের দুই খাত ঝুঁকিতে পড়তে পারে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের প্রধান দুটি খাত ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই খাতগুলো হচ্ছে শ্রমবাজার ও রফতানি খাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে রফতানি খাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ এতদিন যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছিল, ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সেই শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। এছাড়া, ডলারের বিপরীতে পাউন্ড দুর্বল হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সক্ষমতাও কমে যাবে। এই ঘটনায় ইউরোর দামও কমে যেতে পারে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক শিল্পখাত। এ প্রসঙ্গে এক্সপোর্টাস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের তৃতীয় দেশ হচ্ছে ব্রিটেন। ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে তারা আমদানি সঙ্কোচননীতি গ্রহণ করলে আমরা বিপাকে পড়ব। আবার মুদ্রার দরপতন হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সক্ষমতাও কমে যাবে। তিনি বলেন, ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হওয়ার খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড এবং ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন ঘটেছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। গত ৩০ বছরে এ ধরনের দরপতন হয়নি। ফলে ব্রিটেনে ইইউর বিনিয়োগ কমে যাবে। এতে ব্রিটেনের জনগণের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশটির তৈরি পোশাক আমদানিতে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল মনে করেন, পাউন্ডের দর পতন হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ, বাংলাদেশ বেশিরভাগ লেনদেন করে ডলারে। তিনি বলেন, পাউন্ডের দর পতনের ফলে আমাদের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এছাড়া, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সিংহভাগ রয়েছে ডলারে। এরপর ইউরো ও পাউন্ড। সম্প্রতি আমরা চীনা মুদ্রা রেনমিনবিও রিজার্ভ হিসেবে রাখছি। পাউন্ডের দর পতনে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রিজার্ভে বড় কোনও প্রভাব পড়বে না। জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৫২ শতাংশ রফতানি হয়। ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক ও হিমায়িত খাদ্যসহ বাংলাদেশের বছরে রফতানির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ইউরো। তার মধ্যে ব্রিটেনে রফতানি হয় বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের একক দেশ হিসেবে তৃতীয় বৃহত্তম রফতানি দেশ ব্রিটেন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের রফতানি খাত। ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। এছাড়া অভিবাসনে কিছুটা অভিঘাত আসতে পারে। তিনি বলেন, পোশাক খাতে এর প্রভাব বেশি পড়বে। অবিভক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের চুক্তি ছিল। তা এখন নবায়ন করতে হবে। যা করতে গেলে এক ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য হতে ৩২০ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের রফতানি আয় হয়েছে বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পরেই বাংলাদেশের বড় রফতানি আয়ের দেশ হলো ব্রিটেন। এই দেশে সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে তৈরি পোশাক। এছাড়া হিমায়িত পণ্যের বড় বাজার হলো যুক্তরাজ্য। আবার মধ্যপ্রাচ্যের পরেই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর পরেই আসে যুক্তরাজ্য থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বছরের ১১ মাসে মে পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৮১ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকার প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রেমিটেন্সে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিটেন্স কমে গেলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে বড় অঙ্কের রেমিটেন্স আসছে। পাউন্ড যেভাবে দর হারাচ্ছে তাতে রেমিটেন্সে বড় ধাক্কা লাগবে। এর বাইরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গা হচ্ছে তৈরি পোশাকের রফতানি বাজার। ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা এখন আর যুক্তরাজ্য দিতে বাধ্য নয়। তিনি বলেন, রফতানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে হলে বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে সমঝোতা করতে হবে। শুধু তাই নয়, নতুন করে আইনকানুন করারও প্রয়োজন পড়তে পারে। পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজেএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশের মোট রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জার্মানিতে সাড়ে ১৪ শতাংশের পরেই রয়েছে যুক্তরাজ্যের অবস্থান। তৃতীয় অবস্থানে থাকা দেশটিতে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ রফতানি করে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে তৈরি বিজেএমইএ-এর প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে দেশের তৈরি পোশাক খাত। ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম পড়ে গেছে। এই কারণে আমাদের শঙ্কা যে, আমাদের তৈরি পোশাক খাত হয়ত আরেকবার বিপাকে পড়তে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম কমে যাওয়ায় সেদেশে আমাদের তৈরি পোশাকের দামও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
×