ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২০ জুন ২০১৬

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

এ প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছি। বিশেষ করে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক যখন প্ররোচনামূলক মিথ্যা বক্তব্য রাখেন তখন কিছু বলতেই হয়। প্রামাণিক বলেনÑ “খুনী গ্রেফতার ও শাস্তি না হওয়ায় জনগণ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকার ইচ্ছা করেই এই খুনীচক্রের মূল্যেৎপাটন করছে না। হিন্দু সম্প্রদায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বাড়িঘর, মন্দির হারিয়ে, যাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায়, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিষয়ে কোন ভূমিকা রাখেন না।” হিন্দু মহাজোটের সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন, “হিন্দু নারীরা এখন নিরাপত্তার অভাবে হাতের শাঁখা খুলেও সিঁদুর মুছে চলাফেরা করেন।” [প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬] তিনি আরও কিছু কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় আসেনি। কিন্তু দু’একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, তা’হলো, তিনি বলেছেন, হিন্দু মহিলাদের এখন বোরখা পরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। শুধু তাই, নয়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজো অর্চনা বন্ধ হয়ে গেছে। হিন্দু মহাজোট, হিন্দু সমাজ সংস্কারক সমিতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের অনেক নেতাই বিভিন্নভাবে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। রানা দাশগুপ্ত নতুনভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার কথা বলেছি, রাস্তায় থেকেছি, তাদের অনেকের কাছে এ ঘটনাগুলো শুভবুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে হচ্ছে না। অন্তিমে তা হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বটেই দেশেরও ক্ষতি হবে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা নীরবে যে ক্ষমতায়ন করে যাচ্ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তাতেও অভিঘাত হানবে। অতীতে আমরা দেখেছি, দু’একজন ব্যক্তির কারণে, তাদের উচ্চাশা এবং সে উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণে হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়ায় সম্প্রদায় শুধু নয় দেশের ক্ষতি হয়েছে। আমি শুধু বলতে চাই, এক রৈখিক চিন্তায় কেউ লাভবান হবেন না। এবং বর্তমানে, হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে যে সব বিতর্ক ওঠানো হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই এমন চিন্তা না করা দুরূহ এবং এ রাজনীতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে যে যাবে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। হিন্দু মহিলারা বোরকা পরে চলাফেরা করেন, শাঁখা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে, পুজো হয় নাÑ এগুলো সর্বৈব মিথ্যা কথা। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা যদি এর জোরালো প্রতিবাদ না করেন তা’হলে বুঝতে হবে এই মিথ্যাচারের সঙ্গে তারাও যুক্ত। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের অবিলম্বে এর প্রতিবাদ জানান উচিত। না হলে, বুঝতে হবে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করছেন। যদি সেটি করে থাকেন তবে নিশ্চিত তা বাস্তবায়িত হবে না। মুরুব্বি ধরে কোন লাভ হবে না। তিনি কিছুই করতে পারবেন না। হ্যাঁ, এসব ঘটনায় আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে ছিলাম তারা ক্ষতিগ্রস্ত হব কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সংখ্যালঘু বিশেষ করে নিম্নবর্গের সংখ্যালঘুরা। উচ্চ বর্গের সংখ্যালঘুদের তখনও কিছু হয়নি। এখনও কিছু হবে না। এই গোবিন্দ প্রামাণিক কে? তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। গোলাম আযম জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গোবিন্দ তাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। সে সময়ের পত্র-পত্রিকা দেখুন। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন চলাকালীন ভায়োলেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই এসব কাজ করছে এবং দায় চাপাচ্ছে জামায়াতের ওপর। তিনি যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন, তা অনেক পত্রিকাই ছাপেনি। প্রথম আলো বড় শিরোনামে তা প্রকাশ করলেও, পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। এ মিথ্যাচার হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করা, সংখ্যাগরিষ্ঠকে অপবাদ দেয়া এবং দাঙ্গা লাগানোর প্রচেষ্টা। ভারতের বিজেপি ঘোষণা করেছে, নির্যাতিত হয়ে ভারতে হিন্দুরা এলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এর পরপরই বাংলদেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা দিল্লী যান এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন। লক্ষণীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদে আজ পর্যন্ত কোন বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান সম্পাদক হননি। তিন সম্প্রদায়ের তিনজন। তবে, পরিচিত সিআর দত্ত। মোদির সঙ্গে দেখা করতে কোন খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ গেছেন বলে জানা যায়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন গণ্যমান্য আমাকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, পরিষদের দু’একজন নেতা তাকে সফরসঙ্গী হতে বলেছিলেন। তিনি যাননি। যারা গিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই আমাদের পরিচিত, ব্যক্তিগত বন্ধু, যদিও সফরটি একান্ত গোপনীয়তায় হয়েছে। আমাদের ঐ বন্ধু বললেন, মোদির আমন্ত্রণে তাদের উল্লাস যদি দেখতেন! ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল ঠেকেনি। মোদির কাছে আমরা কেন নালিশ করতে যাব?’ তাকে বলা হয়েছিল, মোদির সঙ্গে সাক্ষাত না করে তিনি ভুল করেছেন। গোবিন্দ প্রামাণিকের প্রেস কনফারেন্সের পর, তিনি আমাকে জানালেন, না গিয়ে তিনি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে টার্গেট কিলিং শুরু হয়। ‘হিন্দুরা ভয়ে দেশত্যাগ করছে’ এ রকম হিড়িক তোলা হয়, রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে গত নির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে। এটি আরও বৃদ্ধি পাবে যদি এখান থেকে বড় সংখ্যক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এখন যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রশ্ন আসছে, অনেকেই তাতে সাড়া দেবেন। আমেরিকা যদি এখন নাগরিকত্ব দেয় ভিন্ন মতাবলম্বীদের এ রকম ঘোষণা দিয়ে, বাংলাদেশের অনেক বিএনপি-জামায়াত বা আটকে পড়া পাকিস্তানীরা আমেরিকা চলে যাবে সব ছেড়ে ছুড়ে। শুনতে খারাপ লাগবে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এখন অনেক বাঙালীকেও আকৃষ্ট করে না, গর্ববোধ করে না। পরিস্থিতি এখন এ রকমই। পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ আসা হিন্দু নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিজিপি লাভবান হবে। অসমে বাংলাদেশী [মুসলমান] খেদাও আন্দোলন করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে যেটি কেউ সম্ভব বলে মনে করেননি। যা হোক, এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশ রায় দৈনিক জনকণ্ঠে, সোহবার হাসান প্রথম আলোতে লিখেছেন। যদিও দুজনের লেখা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির। স্বদেশ রায় নিজ সম্প্রদায়ের ‘নেতা’দের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং লিখেছেন, ‘সম্প্রদায়ের নামে বিভেদ ছড়ানো উচিত নয়।’ সোহরাব লিখেছেন, “রানা দাশগুপ্ত কেবল সংখ্যালঘুদের সমস্যার কথা বলছেন না, দেশ শাসনেও তাদের ন্যায্য হিস্যা চাইছেন। ফলে ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তার ওপর ক্ষুব্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।” [প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬] প্রথম আলো পাঠক নন্দিত পত্রিকা। এলিটদের প্রিয়। সোহরাবের এই মন্তব্য দেখে বিস্তারিত কিছু বললাম না বা লিখলাম না। তা’হলে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। সোহরাব নিজেও তা জানেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আনন্দবাজারের সার্কুলেশন। প্রভাব প্রতিপত্তির কথা সবাই জানেন। এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, আনন্দবাজার যখন আমার প্রশংসা করে তখন শংকিত হই, বুঝি যে ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আনন্দবাজার সমালোচনা করলে খুশি হই। বুঝি যে ঠিক পথে চলছি। সমস্যা হচ্ছে যে, যারা বলছেন বা লিখছেন তারা সবাই পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুতার সম্পর্কে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। ফলে, অনেক বক্তব্য, লেখা যথেষ্ট ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবে। সেটি মেনে নিয়েই এই লেখা। তবে, একই সঙ্গে বলতে হচ্ছে, কাউকে শত্রু বা বিরোধী পক্ষ ধরে এ লেখা নয়। মূল কথাÑ এক রৈখিক চিন্তাভাবনা কি সঠিক? একই ন্যারেটিভ যা বার বার দেয়া হচ্ছে তার যৌক্তিকতা কতটুকু বা সত্যতা কতটুকু? ॥ দুই ॥ দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়েছি। আমার জন্মের বছর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। ঐ সময় এবং এর পরবর্তী অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে আমাদের জেনারেশনের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। আমরা কে হিন্দু বা মুসলমান ধর্মাবলম্বী সেটি কখনও মনে করিনি, অন্তত আমার মনে কখনও আসেনি। আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখছি, এখন আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে চিহ্নিত করছি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ হিসেবে। বাঙালী পরিচয়টি এখন গৌণ। আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ একটি পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। একটা পর্যায়ের পর ধর্ম বিষয়টি চলেই আসে। এটি অস্বীকার করতে পারেন গায়ের জোরে, কিন্তু এটিই বাস্তব। দৈনিক জনকণ্ঠে গত ১৩ জুন স্বদেশ রায়ের লেখাটি পড়ে আবার এ বিষয়টি মনে হলো। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন হয়ে এ ধরনের সত্য বলা কঠিন ব্যাপার। আমাদের অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। স্বদেশ রায়ের লেখায় একটি বক্তব্য আছে যেটি অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে তা হলো সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়ন। সোহরাব হাসান যে লিখেছেন, রানা দাশগুপ্ত ক্ষমতার হিস্যা চান, সেটি কীভাবে? ক্ষমতায়ন না হলে হিস্যা চাইলেই পাবেন? মোদি বললেই হবে? বিষয়টা এত সোজা নয়। বর্তমানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা যে ধরনের কথা বলছেন তাতে সে ক্ষমতায়নে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, যারা সবসময় তাদের পাশে ছিলেন তাদের অনেকেও এই সব হটকারী বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে একমত হবেন না। সম্প্রতি রানা দাশগুপ্ত ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দুজনই বলেছেন, তারা এমন বক্তব্য দেননি। পীযূষের বক্তব্য অনেকে মেনে নিলেও রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য অধিকাংশই বিশ্বাস করেছন না। রানা দাশগুপ্ত স্পষ্টভাবে বলেছেনÑ “প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবোধ নিয়ে জানতে আমাদের ডেকেছিলেন। আমরা আমাদের পরিস্থিতির কথা তাকে জানিয়েছি। আমরা সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু মোদির হস্তক্ষেপ কামনার কথা ভারতের পিটিআই যেভাবে প্রকাশ করেছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা কোনভাবেই তার হস্তক্ষেপের কথা বলিনি। পিটিআইর যে সাংবাদিক আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি লেখার সময় কোন কারণে এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছেন। পিটিআইর প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই আমরা ঢাকায় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। ফলে নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চাওয়ার প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর।” [বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৮.৬.১৬] রানা দাশগুপ্ত এখানে একটি ভুল করেছেন। তিনি পিটিআইএর খবর অস্বীকার করার পর বিবিসি পিটি আইয়ের কাছে জানতে চায় বিষয়টি সম্পর্কে। পিটি আই বিবিসিকে জানিয়েছে তাদের রিপোর্টিং সঠিক। জাতীয় একটি সংস্থা যখন এ বক্তব্য দেয় তখন বুঝতে হবে তাদের কাছে রেকর্ড আছে দেখেই তারা এভাবে বলতে পারে। রানাদা যদি মনে করেন তার কথা ঠিক তাহলে ভারতেই তার প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল। সময় এখনও ফুরোয়নি। তিনি একজন আইনজীবী। পিটিআই রিপোর্টার যদি ভুল রিপোর্টিং করে থাকে এবং তা স্বীকার না করে তা’হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে মানহানি ও মিথ্যা খবর প্রচারের মামলা করা উচিত। রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের অনেক দিনের। তাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি, এই ব্যবস্থা না নিলে তিনি আর তার পুরনো আসন ফিরে পাবেন না। বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। ফলে যে সব সংগঠনের তিনি নেতৃত্বে আছেন সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের এক সঙ্গে পথচলার লোক এমনিতেই কম। স্বদেশ রায় তার লেখায় জানিয়েছেন, রানা দাশগুপ্ত মোদির সাহায্য চেয়েছেন। তার এবং আরও অনেকের বিশ্বাসের কারণ, রানা দাশগুপ্ত আগে এত মারাত্মক না হোক, কাছাকাছি অনেক মন্তব্য করেছেন। রানা দাশগুপ্ত যদি এ ধরনের কোন বক্তব্য দিয়েও থাকেন তাহলে কতটা বুঝে দিয়েছেন বলতে পারব না। যদি বলে থাকেন, আবেগে বলেছেন। সেটি বাদ দিই, তিনি বলেছেন, মোদি তাদের অবস্থা জানতে ডেকে পাঠিয়েছেন। মোদি যখন এখানে এসেছেন তখন তাদের সঙ্গে কথা বললে তেমন প্রতিক্রিয়া হতো না। কিন্তু মোদি হঠাৎ তাদের ডেকে পাঠাবেন কেন, আমন্ত্রণ না চাইলে রাজনীতির কথা এ কারণেই আসে। আর মোদি ডাকলেই তারা চলে যাবেন তাদের অবস্থা জানাতে? তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ধর্ণা দেয় বিদেশীদের কাছে তার নিন্দা আমরা করি কেন? অন্যদিকে এটিও বিবেচ্য, মোদি সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সুসম্পর্ক থাকার পরও যখন মোদি গোপনে তাদের আমন্ত্রণ জানান ও তারা গোপনে যান সেটি শেখ হাসিনা বা সরকারের পক্ষে খুব সম্মানজনক নয়। রানা দাশগুপ্ত তো এখন সরকারী কর্মকর্তা, সরকারী নিরাপত্তায় রক্ষিত, তিনি কি সরকারের অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন যে এ ধরনের এক গোপন প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। এ ঘটনা কিছুটা হলেও দু’দেশের সম্পর্কে অভিঘাত সৃষ্টি করবে। এ কথা বলার পরও বলব রানা বা পীযূষের [তারা অস্বীকার করেছেন] ঐ ধরনের মন্তব্য করার অধিকার আছে। কিন্তু স্বদেশ রায় যে মূল প্রশ্নটি করেছেন, ‘সম্প্রদায়ের নামে বিভেদ ছড়ানো’ সেটিই মৌল বিষয়। পরিস্থিতি এত বিষাক্ত, বিস্বাদ ও অনিরাপদ হলে রানা দাশগুপ্ত বা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যে অবস্থানে আছেন সে অবস্থানে থাকতে পারতেন না, আসতেও পারতেন না। তারা দু’জনই আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু, কখনও তারা আমাদের অসদাচরণের সম্মুখীন হয়েছেন বলে আমাদের মনে হয় না। তারা যা বলেছেন বা বলেননি বা অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ইদানীং যা বলছেন তা অন্যভাবে বলা যেত, যেতে পারে। কিন্তু তারা যে পথে এগোচ্ছেন, স্বদেশ রায়ের মতো আমিও মনে করি, তা সঠিক পথ নয়। তারা নিজেদের শুধু নয়, আমরা যারা এতদিন, যে সেক্যুলার আদর্শের জন্য লড়ছি তাকেও দুর্বল করে দিচ্ছেন। ॥ ৩ ॥ প্রথমেই একটি কথা বলে নেয়া ভাল। সংখ্যালঘিষ্ঠরা সব দেশেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণা করা হয়। গত শতকের আশির দশকে আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে এই জ্ঞান অর্জন করি। লন্ডনে আছি তখন, সেখানে সেই সময় বর্ণ বিদ্বেষটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাটে ট্রেনে ‘পাকি’ বলে বিয়ার বা কোকের ক্যান ছুড়ে মারছে, টিটকারি দিচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতা কাকে বলে তখন অনুধাবন করেছি। একদিন বিকেলে টয়েনবী হলে কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে দেখা করতে গেছি। কথায় কথায় রাত হয়ে গেছে। তেমন রাত নয়, আট কী সাড়ে আট। বাড়ি ফিরব বলে বেরুলাম। তখন দেখি কবি ছুটে আসছেন। বললেন, ‘মুনতাসীর আজ টিউবে যাওয়া যাবে না। রাত হয়ে গেছে, তাছাড়া আজ ফুটবল খেলা ছিল।’ তিনি বাঙালী এক ক্যাব চালককে ফোনে ডেকে আমাকে তুলে দিলেন। সুতরাং সংখ্যালঘু সব দেশেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। একই সময় আবার দেখেছি, বাঙালী যারা থাকতে এসেছেন, তারা এসব পরোয়া করছেন না। আমার নিরাপত্তাহীনতার চিন্তায় তারা বেশ মজা পান। রাত বিরেতে ঘুরে বেড়ান। পরে বিষয়টা অনুধাবন করলাম, তারা লন্ডনে থাকতে এসেছেন, যেতে নয়। আমি থাকতে আসিনি, চলে যাব। দুটোর মধ্যে অনেক তফাত। যিনি থাকতে এসেছেন, তাকে কিছুই স্পর্শ করছে না। আতঙ্কিতও হচ্ছেন না, প্রয়োজনে বিবাদ এড়িয়ে চলেন, পারলে প্রতিরোধ করেন। (চলবে)
×