ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২১ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(গতকালের পর) নির্দিষ্ট দিনে জনসভা ছেড়ে জিয়া গেলেন পীরের বাসায়। রাজনীতিক ও পীরের খাদেমরা দোতলার খাস ঘরে নিয়ে গেলেন তাকে। কোথাও পীরের চিহ্ন নেই। জিয়া পিএসকে জিজ্ঞেস করলেন। পিএসও অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে। পীর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অথচ পীর নেই। ডিসি নিচে নামলেন। খোঁজখরব নিতে লাগলেন। মুরিদরা জানালেন তিনি জিকিরে বসেছেন। জিকির ছেড়ে আসবেন না। জিয়াউদ্দিন বুঝলেন যে, পীর দেখাতে চান, রাষ্ট্রপতিকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ক্রুদ্ধভাবে এক চেলাকে বললেন, যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পীরকে ওপরে না দেখা যায় তা হলে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে যাবেন। পাঁচ মিনিটের আগেই পীরকে দেখা গেল রাষ্ট্রপতির পাশে। জিয়া আমলের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সেনা তোষামোদ। সেনারা যা খুশি করতে পারতেন। সেনা কর্মকর্তারা মন্ত্রীদের কোন পাত্তা দিতেন না। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, জিয়া যখন চট্টগ্রাম আসতেন জেনারেল মনজুর শুধু তার সঙ্গে হাত মেলাতেন। কোন মন্ত্রীকে কুশলও জিজ্ঞেস করতেন না। তার সহকর্মীরাও একই ধরনের আচরণ করতেন। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, আমি ডিসি থাকাকালীন মিলিটারি ক্যাডেটদের পাসিং আউট প্যারেডে জিয়া ছাড়া কখনও কোন মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জিয়া তার মন্ত্রীদের দেখতেন as trite and totally dispensable humans’ বাংলায় বলতে পারি বর্জ্য হিসেবে। জিয়াউদ্দিন উদাহরণ হিসেবে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শাহ আজিজ এসেছেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে চাটগাঁয়। বেসামরিক কর্মকর্তারা এসেছেন সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। জিওসি না এসে তার একজন স্টাফ অফিসারকে পাঠিয়েছেন। রাতে ডিসি টেলিফোন পেলেন রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব থেকে। শাহ আজিজ সারাদিন কী করেছেন তিনি তার রিপোর্ট নিলেন। তিনি ডিসিকে জানালেন, তিনি যেন শাহ আজিজের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রেখে তাকে জানান। জিয়াউদ্দিন ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, তিনি তা পারবেন না। পুলিশ থেকে যেন তিনি রিপোর্ট নিয়ে নেন। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। শাহ আজিজ গভীর রাতে হোটেলে ফিরে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হাউস থেকে বার বার ফোন এসেছে শাহ আজিজের গতিবিধি জানার জন্য। কক্সবাজারে রাষ্ট্রপতি যাবেন। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জিয়াউদ্দিন যেদিন কক্সবাজার রওনা হবেন সেদিন কক্সবাজারের এসডিও তাকে ফোন করে অসহায়ভাবে জানালেন, ঢাকা থেকে জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজসহ আরও কয়েক মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আসবেন। এখন তিনি তাদের থাকার বন্দোবস্ত করবেন কোথায়? কারণ, সামরিক অফিসাররা সব দখল করে নিয়েছেন। ডিসি বললেন, তাদের অনুরোধ করতে যাতে কয়েকটি কক্ষ তারা ছেড়ে দেন। এসডিও জানালেন, তিনি তাদের অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু রূঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ডিসি চাটগাঁর কোন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন না। ঢাকায় সেনাসদরে যোগাযোগ করলেন। ডিসি পুরো বিষয়টি বললেন এবং প্রস্তাব করলেন, সার্কিট হাউসে চারটি রুম আছে। তার একটি অন্তত প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হোক। তারা জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা তাদের অতিথি নয় সুতরাং এ বিষয়ে কিছু করার নেই। সার্কিট হাউসে থাকতেন তিন বাহিনীপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি। ডিসি শহরের প্রান্তে এক রেস্ট হাউসে প্রধানমন্ত্রী ও পর্যটন হোটেলে মন্ত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। রাষ্ট্রপতি কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামলেন। সেখানে তিন বাহিনীপ্রধান, সামরিক কর্মকর্তা ও ডিসি ছিলেন। রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর জেনারেল এরশাদসহ তার গাড়িতে উঠলেন। অন্য কর্মকর্তারাও সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের জন্য কেউ অপেক্ষাও করলেন না। ডিসিকেও যেতে হলো সার্কিট হাউসে। শাহ আজিজ ক্রুদ্ধ হয়ে এসডিওকে বললেন, তাকে কেন সার্কিট হাউসে নেয়া হচ্ছে না। আমতা আমতা করে এসডিও ব্যাপারটা জানালেন। ক্ষোভ দেখানো ছাড়া শাহ আজিজের আর করার কিছু ছিল না। শুধু তাই নয়, রাতে সেনাপ্রধান যে নৈশভোজের আয়োজন করলেন সেখানে সিভিলিয়ান দূরে থাকুক, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সেনা মহড়ার সময় সামনের সারিতে বাহিনী প্রধান ও গ্যারিসন প্রধানদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি বসলেন। দ্বিতীয় সারিতে শাহ আজিজ ও অন্যান্য মন্ত্রী। তৃতীয় সারিতে ডিসি। তিনি লিখেছেন, মন্ত্রীদের মুখে কোন ক্রোধের চিহ্ন দেখলাম না। রাষ্ট্রপতি মাঝে মাঝে পেছনে বসা শাহ আজিজকে দু’এক কথা বলছিলেন। শাহ আজিজ গদগদভাবে তা শুনছিলেন। এসডিওকে যে মেজাজ দেখিয়েছিলেন তার কোন চিহ্ন নেই। মহড়া শেষে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি চলে গেলেন। শাহ আজিজ কোথায় ছিলেন তা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না। ক্স জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, যাদের রাজকীয়ভাবে জিয়া রেখেছিলেন, তাদের হাতেই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর তিনি বেঁচে আছেন তার সিভিলিয়ান শিষ্যদের কারণে, সেনাবাহিনীর কারণে নয়। একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের পরিহাস। জিয়াউদ্দিনের ভাষায়— “But the irony of the cox’sbazar incident would be that while Zia tried his best to keep his armed forces out of polities, treated them royally, and even put them in a pedestal higher than his cabinet ministers, his life would finally end in the hands of the forces that he coddled all along. It is his political acolytes, who would later carry his name and legacy, not the Armed Forces.” সামরিক-বেসামরিক আমলারা জিয়ার আমলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন মুজিব আমল থেকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে নিজের দল বিএনপিকে সবচেয়ে বড় দলে পরিণত করছিলেন জিয়া। তার জনপ্রিয়তা তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। অন্তত তিনি তাই মনে করতেন। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, জীবনের শেষ দুই বছর এই জনপ্রিয়তা তাকে ড়নংবংংবফ করে তুলেছিল। তার জনসভাগুলোকে তিনি আর লোকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ভাবতেন না, বরং ভাবটা দেখাতেন পোপের আশীর্বাদের মতো। তার গাড়িবহরের পেছনে লোকজন ছুটছে এই দৃশ্য তাকে উন্মাতাল করত। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসছিলেন। রেলের পেছনে দুর্ঘটনার আশঙ্কা সত্ত্বেও লোকজন ও শিশু-কিশোররা ছুটছিল। এ দেখে জিয়া যেন পাগল হয়ে উঠলেন, হাত দিয়ে ইশারা করে চড়া গলায় বলছিলেন ‘আয় আয়’। (চলবে)
×