ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

টেকসই উন্নয়ন- প্রত্যয় ও দর্শন

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২১ মে ২০১৬

টেকসই উন্নয়ন- প্রত্যয় ও দর্শন

সম্প্রতি টেকসই উন্নয়নের প্রত্যয় পৃথিবীব্যাপী গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন, আয় বণ্টনে সমতার সূত্র অনুসরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু সময়ান্তরিক ব্যবহার এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায়, জনগণের কণ্ঠের স্থান দেয়া এবং অংশগ্রহণ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের প্রাথমিক ভিত্তি ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে বিদিত হয়েছে। এই ঘোষণা পত্রের নির্যাস অনুযায়ী এটিকে জাতিসংঘের নৈতিক চার্টার বলে বিবৃত করা যেতে পারে এবং এই প্রেক্ষিতে এটিকে জাতিসংঘের নৈতিক হৃদয় ও প্রাণ হিসেবে বিবেচনীয়। এই ঘোষণার ২২ অনুচ্ছেদে সকল জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, ২৩ অনুচ্ছেদে প্রত্যেকের জন্য কর্মের অধিকার এবং তার ভিত্তিতে জীবন ধারণের জন্য মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সামাজিক দায়িত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে। ২৪ অনুচ্ছেদে যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম ও অবকাশ, ২৫ অনুচ্ছেদে মানসম্মত জীবন যাপনের অধিকার, ২৬ অনুচ্ছেদে প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে এবং ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে পৃথিবীর সকল মানুষ এই ঘোষণাপত্রে যে সব অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বিবৃত হয়েছে সে সব পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থার দাবিদার। ১৯৪৮ সালের এই ঘোষণার অনুগমন করে ১৯৬৬ সালে সুশীল ও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত দুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র বা কভেনান্ট ঘোষণা করা হয়। এ দুটি ঘোষণায় মানব অধিকারের ৫টি প্রধান উপকরণকে সুস্পষ্টভাবে স্থান দেয়া হয়। সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত অঙ্গীকারপত্রে সকল রাষ্ট্রের নাগরিকদের নাগরিকত্ব এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতনের প্রতিকূলে প্রতিরক্ষণের অধিকার দেয়া হয়। উদাহরণত, অনুচ্ছেদ-৬ এ বলা হয় যে আইন দ্বারা সকলের জীবনের অধিকার প্রতিরক্ষা করা হবে। অনুচ্ছেদ ৭-এ নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ দেয়া হয়, অনুচ্ছেদ ৮ এ দাসত্বকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অনুচ্ছেদ-৯ এ প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার অলঙ্ঘনীয়ভাবে স্বীকার করা হয়। অনুচ্ছেদ-১৬তে সকল জনগণের নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করা হয়। অনুচ্ছেদ-১৮তে চিন্তার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং অনুচ্ছেদ-২৪ এ শিশুদের প্রতিরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় এবং অনুচ্ছেদ-২৬ এ আইনের আওতায় বৈষম্যহীন সম্পত্তি রক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত অঙ্গীকারপত্রে কর্মের অধিকার (অনুচ্ছেদ-৬) ন্যায্য ও অনুকূল কর্মের শর্ত, নিরাপদ কাজের পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন পরিতোষিক (অনুচ্ছেদ-৭), সকল শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও যোগ দেয়া (অনুচ্ছেদ-৮), সামাজিক নিরাপত্তার (অনুচ্ছেদ-৯) এবং যথোপযুক্ত জীবনের মানের ভিত্তিতে জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর অধিকার (অনুচ্ছেদ-১১) উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় (অনুচ্ছেদ-১৩) সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার স্বীকার করার আহ্বান জানানো হয়। এর পরে ২০০০ সালে জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিশ্চয়তা গ্রহণ করে সকল ক্ষেত্রে জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজন এর ওপর সকল রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। এই লক্ষ্য নিশ্চয়তার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বিশ্বের সকলকে চরম দারিদ্র্য ও অভাব থেকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পৃথিবীর ১০৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে ৮টি লক্ষ্য সুনির্দিষ্টভাবে অর্জনের জন্য নির্ধারণ করেন। এর মধ্যে (১) চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি, (২) সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান, (৩) লিঙ্গ সমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়ন, (৪) শিশু মৃত্যুর হার কমানো, (৫) মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, (৬) এইচআইভি ও এইডস্, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য ঘাতকব্যাধি নিরোধমূলক পরিবেশের সংরক্ষণ এবং (৭) উন্নয়নের জন্য গোলকায়িত বা বিশ্বজনীন অংশীদারিত্ব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী সহস্রাব্দ উন্নয়ন ও লক্ষ্য নিশ্চয়তা অনুসরণ করার জন্য সকল সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যথা ঈপ্সিত পদক্ষেপ নেয়নি। বিশেষত আফ্রিকার দেশসমূহ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তাদের তরফ থেকে যে সঞ্চয় বৃদ্ধি ও সুশাসন প্রবর্তনের দায়িত্ব নেয়া হয়েছিল তা পূর্ণাঙ্গভাবে পরিপূরণ করতে সমর্থ হয়নি। উন্নত দেশসমূহের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তা বাড়ানোর এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণমূলক যে পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূরণ করা হয়নি। বাংলাদেশের তরফ থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিশ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল এবং তারপরে ২০০৯-২০১৫ সাল পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের মোড়কে অর্জন করা হয়। দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ে, বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অতিক্রম করে, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা আশানুরূপভাবে কমে যায় এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রভৃত উন্নতি সাধিত হয়। দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে উঠে আসে। শিশুমৃত্যুর হার যথা ঈপ্সিত হারে কমে আসে ও প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তৃত হয়। নারী পুরুষ বৈষম্য আশানুরূপভাবে কমে যায় এবং দেশ সার্বিকভাবে ক্ষুধা থেকে মুক্তি পায়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিচয়ের অর্জন সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়নের পর ২০১২ সালে রিও (ডি-জেনেরিও) ধরিত্রী সম্মেলনে আরও পরিব্যপ্ত অবয়বে পৃথিবীব্যাপী টেকসই উন্নয়নের সূত্র ও লক্ষ্য নিচয় গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘের আওতায় পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্রপ্রধান টেকসই উন্নয়নের মোড়কে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য সর্বমোট ১৭টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। এই ১৭টি লক্ষ্য নি¤েœ সংক্ষিপ্ত অবয়বে উল্লিখিত হলো : (১) সর্বপ্রকার দারিদ্র্যের সর্বস্থান থেকে অপসারণ; (২) ক্ষুধা থেকে মুক্তি অর্জন, খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, উন্নততর পুষ্টি অর্জন এবং টেকসই কৃষি প্রসারণ; (৩) সকলের জন্য সুস্বাস্থ্যিক জীবন নিশ্চিতকরণ; (৪) সকলের জন্য সাম্যভিত্তিক গুণগত উৎকর্ষ বিশিষ্ট শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং আজীবন শিক্ষার সুযোগ প্রসারণ; (৫) লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন অর্জন; (৬) সকলের জন্য টেকসই পানির সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; (৭) সকলের জন্য নিশ্চিত, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানির অভিগম্যতা অর্জন; (৮) অন্তর্ভুক্তিয় ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং পরিচ্ছন্ন কর্মের পরিধি সম্প্রসারণ; (৯) সদা কার্যক্ষম অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিয় ও টেকসই শিল্পায়ন প্রসারণ এবং উদ্ভাবন উৎসাহিত করণ; (১০) আন্তঃ ও অন্তদেশ অসমতা কমানো; (১১) নগর ও জনবসতিসমূহকে (সকলের) অন্তর্ভুক্তিয় ও নিরাপদ, সদা কার্যক্ষম ও টেকসই প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরণ; (১২) টেকসই ভোগ ও উৎপাদন প্যাটার্ন নিশ্চিতকরণ; (১৩) জলবায়ু পরিবর্তন ও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিহতকরণ; (১৪) টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে মহাসাগর, সাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদসমূহের টেকসই উন্নয়ন; (১৫) ধরিত্রীর পরিবেশ ব্যবস্থার টেকসই প্রসারণ, পুনর্¯’াপন ও সংরক্ষণ, বনসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, মরুকরণ ও ভূমিক্ষয় রোধকরণ এবং জীব বৈচিত্র্যের ক্ষয় বন্ধকরণ; (১৬) টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও (সকলের) অন্তর্ভুক্তিয় সমাজ প্রসারণ, সকলের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাকরণ এবং সর্বপর্যায়ে কর্মক্ষম, দায়িত্বশীল ও অন্তর্ভুক্তিয় সংগঠন প্রতিষ্ঠাকরণ এবং (১৭) টেকসই উন্নয়নের জন্য সকল পন্থা শক্তিশালীকরণ এবং বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব পূর্ণমাত্রায় ফলপ্রসূকরণ। এসব লক্ষ্য নিশ্চয়কে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে (২০১২) কর্মভিত্তিক, সংক্ষিপ্ত, সহজে জ্ঞাত, উচ্চাভিলাষী, বিশ্বব্যাপী এবং সর্বজনীনভাবে সকল দেশের জাতীয় বাস্তবতা, পরিবর্তন ক্ষমতা এবং উন্নয়ন পর্যায়ের ভিন্নতা বিবেচনায় নিয়ে প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। সহস্রাদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ যা মূলত দরিদ্র দেশসমূহের প্রতি প্রযোজ্য ছিল, তার আপেক্ষিকতায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিচয় সকল দেশের প্রতি প্রযোজ্য। এসব লক্ষ্য নিচয় অর্জনের সময় ব্যাপ্তি দীর্ঘ। এদের বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করতে বেশ সময় লাগবে। এবং এসব লক্ষ্য নিশ্চয় অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী, উন্নত ও অনুন্নত দেশসমূহের প্রচেষ্টা সমন্বিতভাবে প্রযোজিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী একটি যৌথ কর্মসম্পাদনীয় প্রতিষ্ঠান বা নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। এই নেটওয়ার্কের প্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফরী সাকস কে নিযুক্তি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান, ব্যবসা, সুশীল সমাজ ও নীতি নির্ধারকদের নিয়ে একটি বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। এই কাউন্সিলের নেতৃত্বে জাতিসংঘ ও এর সংশ্লিষ্ট অঙ্গপ্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলীর সমন্নয় করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত পশ্চাৎদর্শিতা (বা ইধপশপধংঃরহম) এর সূত্র অনুযায়ী ভবিষ্যতে অর্জনীয় স্থির লক্ষ্যের আলোকে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আগের সময়ে বা এখন থেকে কি করণীয় তা শনাক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির পথ নকশায়ন বা রোডম্যাপিং করে তার অভিগম্যতা বিস্তৃত করার কার্যক্রম নীতিগতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের বাহকের ভূমিকায় যে বিলিয়ন গুণ আকারের তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, তাকে ভিত্তি করে এই পথ নকশা প্রণয়ন যুগোপযোগী ও সকলের জন্য লভ্য রাখার প্রয়োজন স্বীকৃতি পেয়েছে। সহস্রাব্দ লক্ষ্য নিশ্চয়ের তুলনায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যাদি বিশ্লেষণ করলে ৩টি ক্ষেত্রে অধিকতর ও ব্যাপকতর কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যুক্তিযুক্ত মনে হয়: (১) টেকসই উন্নয়নের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের তুলনায় উন্নত দেশসমূহকে অধিকতর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একটি শান্তি ও প্রগতিশীল বিশ্ব বিনির্মাণ ও সংরক্ষণে এ দায়িত্ব পালনে তাদেরকে অনুন্নত দেশসমূহের মতই দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে বলা হয়েছে। কার্যকরণ সূত্র অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অবকাঠামো সৃষ্টি, মুক্তবাণিজ্য প্রসারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রগতির ও উদ্ভাবনের লভ্যতা অনুন্নত দেশের অনুকূলে বাড়ানোয় উন্নত দেশসমূহ যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন বলে টেকসই উন্নয়নের প্রবক্তারা বিভিন্নভাবে দাবি জানিয়েছেন। (২) উন্নয়ন, বিশেষত শিল্পায়নের ফলে এখনকার উন্নত দেশসমূহ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ও জলবায়ুতে প্রতিকূলতা এনেছে। জলবায়ুর উষ্ণায়ন, পৃথিবীব্যাপী সামুদ্রিক জলের উচ্চতা বৃদ্ধি, বনরাজির বিনাশ ও বায়ুম-লে অঙ্গার বা কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্র ও বিষয়ে যথা প্রয়োজন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য টেকসই উন্নয়নের প্রত্যয় ও দর্শন সম্প্রসারিত। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘের আওতায় ইতোমধ্যে উন্নত দেশসমূহকে বিশেষ সম্মেলনের মাধ্যমে আহ্বান জানানো এবং দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। (৩) পৃথিবীব্যাপী মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারকে কার্যশীল স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত করা হয়েছে যে এই সব অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণে গণতান্ত্রিকতা ও জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, শাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারিত করতে হবে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অযৌক্তিকভাবে গুরুত্বপ্রাপ্ত ¯œায়ুযুদ্ধের বিকল্পে এই প্রত্যয় ও লক্ষ্য নিশ্চয় সারা বিশ্বকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ সৃষ্টিকরণ ও প্রসারণে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করেছে। বস্তুত জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে শাসন প্রতিষ্ঠাকরণে এবং জনগণের অধিকার সংবলিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই দায়িত্ব সংঘাতবিহীন নতুন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার দ্যোতক। এই প্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী অধিকতর নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার বক্তৃতায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সফলতার আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি এই ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে, টেকসই উন্নয়ন অর্জনে উন্নত দেশসমূহের অধিকতর কর্মশীল সহযোগিতা দাবি করেন। তিনি এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অনুকূল কার্যক্রমের উল্লেখ করেন। একই অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন করে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার সরকারের প্রচেষ্টা প্রযোজিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। আমরা আশা করি কেবল দারিদ্র্য বিমোচন বা প্রবৃদ্ধি অর্জনই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন ও অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণে টেকসই উন্নয়নের প্রত্যয় ও দর্শন কার্যশীল থাকবে। ইতোমধ্যে স্বীকৃত হয়েছে যে এই প্রক্রিয়ায় সকল সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে (১) সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; (২) সরকার ও সকল সংগঠনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; এবং (৩) সকল নাগরিক ও রাষ্ট্রের কার্যক্রমে স্বার্থ সংবলিত সংগঠন ও ব্যক্তিসমূহের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই পথে ও প্রক্রিয়ায় ১৯৬৩ সালের ১০ জুন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেয়া তার বিখ্যাত শান্তি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মানুষের ভাগ্য বিবর্তনের কোন সমস্যাই মানুষের ক্ষমতার বাইরে নয়। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে আমরা সবাই একই পৃথিবীর অধিবাসী।’ তার বক্তৃতায় বিবৃত দর্শন ছয় দশকের পরেও এই সময়ে টেকসই উন্নয়নের প্রত্যয় ও দর্শনের আলোকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণীয় ও অনুসরণীয়। লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য
×