ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র হক

নদীও নারীর মতো কথা কয়

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২০ মে ২০১৬

নদীও নারীর মতো কথা কয়

দশটি ছোট গল্পে সংকলিত ‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’ প্রকাশনাটিকে গল্পের একটি মেইল বক্স বলা যায়। একটি গল্প আরেকটি থেকে আলাদা। প্রতিটি গল্পেই কথা শৈলীর ফ্লেভারে একাধিক মেসেজ দেয়া হয়েছে। কোথাও আমাদের সমাজ জীবনের মোড়ল মাতবরদের শঠতা কপটতার চিত্রসহ সমাজের মানুষের নানা বর্ণনা কোথাও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রথম গল্পের নাম নদীও নারীর মতো কথা কয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে এসেছে আশনাই বিবির আখেরি খায়েস, সোনার পাথরবাটি, ব্লাকহোলের বাদুর, সমন্যামবুলিস্ট, দুজন দুজনার, অপদেবতা, ডিজিটাল ডনজুয়ান, কুমারী মাতা ও আঁধারের কান্না। প্রথম গল্প নদীও নারীর মতো কথা কয় গল্পকার বাসের যাত্রীকে নিয়ে বর্ণনামূলক ধারায় শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। যদিও ‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’ বাক্যটি আবু জাফর ও ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গাওয়া দেশাত্মবোধক একটি গানের কথার মধ্যে আছে। তার পরও গল্পের সঙ্গে মিল থাকায় নামটি সার্থকতা পেয়েছে। আশনাই বিবির আখেরি খায়েস গল্পে গ্রামীণ পটভূমিতে পিতার অপকর্মের বোঝা পুত্রের কাঁধে কি ভাবে বর্তায় তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। ব্লাকহোলের বাদুর গল্পে একটি দুর্ঘটনা আমলাতন্ত্রের মধ্যে কতভাবে প্রতিক্রিয়া ফেলে এবং কি পরিণতি বয়ে আনে তা তুলে ধরা হয়েছে গল্পের বুনন শৈলীতে। সমন্যামবুলিস্ট গল্পটিতে গল্পের চরিত্রকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে নস্টালজিক হয়ে যাওয়া পর্ব, তার মধ্যেই গরিব শোষণের হাত থেকে রক্ষার নামে আরও শোষণের প্রাতিষ্ঠানিক পথকে মসৃণ করা, দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে গজিয়ে ওঠা এনজিওর বিষয়গুলো তৃতীয় বিশ্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এমন বিষয়গুলোকে কমপ্যাক্ট করতে গিয়ে গল্প সাজানোর পথে মাঝে মধ্যেই খেই হারিয়ে গিয়েছে। এই অসঙ্গতিটুকু না থাকলে গল্পের নির্যাস পরিস্ফুটিত হতো। তার পরও বলা যায় লেখক হোসনে আরা মণি কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার চেষ্টা করেছেন। সোনার পাথরবাটি গল্পটি সম্পর্কে বলা যায় ‘দেয়ার আর মোর থিংগস ইন হেভেন এ্যান্ড আর্থ, গল্পকার কি এই ধারণা নিয়ে গল্পটিকে সাজিয়েছেন! ব্লাকহোলের বাদুর গল্পটির থিম এসেছে দেশে ঘটে যাওয়া সমসাময়িক ঘটনা থেকে। এই গল্পে লেখক কথার নিপুণ বুনননিতে আমলাতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচনে সার্থক হয়েছেন। বিশেষ করে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বর্ণনা ও আমলার মানসিক অবস্থা সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। দুজনে দুজনার গল্পে উত্তরাঞ্চলের একটি এলাকার গ্রামীণ জীবন এমনভাবে তুলে এনেছেন যা পাঠ করে প্রবীণরা ফিরে যেতে পারেন তাদের তারুণ্যের জীবনালখ্যে। আর বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারবে কেমন ছিল তাদের পূর্বসূরিরা। এই গল্পে আঞ্চলিক কথার সংলাপগুলো একেবারে যথাযথ হয়েছে, যা ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। অপদেবতা গল্পটির কয়েকটি অংশে লেখক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ডিজিটাল ডনজুয়ান গল্পটির সূচনা হয়েছে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের অধ্যায় দিয়ে। যা গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই গল্পে লেখক প্রমাণ করেছেন কোন ছোট্ট ঘটনার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়ে ছোটগল্পে পরিণত করা যায়। কুমারী মাতা গল্পে আছে বর্তমানের আবহে অনেকগুলো বার্তা। যা গল্পের ওজন বাড়িয়েছে। আঁধারের কান্না গল্পটি পাঠ করে মনে হয়েছে লেখক হোসনে আরা মণি টুকরো ঘটনাগুলো অঙ্কের কম্বিনেশনের মতো করে সাজিয়ে সুন্দর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন। যেখানে একটি পরিবারের পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির ঘটনাকে টেনে এনে এলাকার উন্নয়নের চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন অসঙ্গতি ছাড়া বইটি এক টানে পড়া যায়। গল্পের ওজন অনুযায়ী প্রচ্ছদটি বেমানান ঠেকেছে। বিমূর্ত হলে আকর্ষণীয় হতে পারত। দুটি গল্পের নামকরণে কঠিন শব্দ ব্যবহার না করে সুন্দর বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে ভালা হতো। তবে কঠিন শব্দ ব্যবহারে লেখকেরও কথা থাকতে পারে।
×