ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৯ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) জিয়া খুব গম্ভীর মুখে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামলেন। জুমার নামাজ পড়তে যাবেন। কারো সঙ্গে কোন কথা বললেন না। এবার কমিশনার তার গাড়িতে উঠলেন। পরে কমিশনার জানিয়েছিলেন, গাড়িতেও রাষ্ট্রপতি কোন কথা বলেননি। জুমা থেকে ফিরে কমিশনার জানালেন রাষ্ট্রপতি ডিআইজি, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। বৈঠকে কমিশনার ও ডিসি থাকবেন। কর্মকর্তারা সন্ধ্যা সাতটায় এসে দেখেন ওপরতলায় জোর কদমে আলোচনা চলছে। বয়-বেয়ারারা জানাল, দুপুরের খাবারের পর মিটিং শুরু হয়েছে এবং এখনও চলছে। আটটার দিকে রাষ্ট্রপতি জানালেন রাতের খাবার খাবেন। এর ভার ডিসির ওপর। চিটাগাং ক্লাবে বলে রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ক্লাবের খাওয়া পছন্দ করতেন। খেয়ে আবার বৈঠক শুরু করলেন। কর্মকর্তাদের যে তিনি দেখা করতে বলেছিলেন তা খুব সম্ভব ভুলে গিয়েছিলেন। ১০টার দিকে মরিয়া হয়ে কমিশনার ওপরে উঠলেন জানতে যে মিটিং হবে কিনা। দ্রুত ফিরে এসে জানালেন মিটিং হবে না। কর্মকর্তারা দ্রুত বাড়ি ফিরলেন। সাইফুউদ্দিন সস্ত্রীক তার বন্ধুর বাড়িতে নৈশভোজ সেরে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরলেন। ॥ তিন ॥ ভোর চারটার দিকে হাঁকডাকে ঘুম ভাঙল জিয়াউদ্দিনের। তার পাহারাদার তাকে ডাকছেনÑ ‘স্যার সার্কিট হাউস এ্যাটাক করা হয়েছে।’ জিয়াউদ্দিন বারান্দায় গেলেন। সেখান থেকে সার্কিট হাউস চোখে পড়ে। কিছু গুলির শব্দ কানে এলো। তার নৈশ প্রহরীরা জানালেন, ঘণ্টাখানেক ধরে মেশিনগান আর গুলির শব্দ তারা শুনেছেন। প্রথমেই জিয়াউদ্দিন ছুটে যেতে চেয়েছিলেন সার্কিট হাউসে। পরে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার পর ফোনের কাছে গেলেন। সার্কিট হাউসে ফোন করলেন, কেউ ধরল না। তারপর ফোন করলেন পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যা এক মাইল দূরে। ফোন যিনি ধরলেন তিনি জানালেন, গুলিগালার শব্দ তারাও শুনেছেন কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানেন না। তিনি ফোন করলেন বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনারকে। কেউই কিছু জানেন না। তবে কমিশনার সাইফুউদ্দিন জানালেন তিনি রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব লে. কর্নেল মাহফুজকে ফোন করে ঘটনা জানার চেষ্টা করবেন। জিয়াউদ্দিন বিকল্প পথে খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন। সার্কিট হাউসের পাশে জেলা ট্রান্সপোর্ট পুল। সেখানে ফোন করলেন। যদি কেউ ধরে এবং ধরলেন। যিনি ধরলেন তিনি তারই সহকারী প্রটোকল অফিসার। সার্কিট হাউসে তার রাতের ডিউটি ছিল। বোঝা গেল তরুণটি বিপর্যস্ত। পুরো কাহিনী তখন প্রটোকল অফিসার জানালেন ডিসিকে। মাঝরাতের কিছু আগে ম্যারাথন মিটিং শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি নিজের ঘরে গেলেন ঘুমোতে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যারা এসেছিলেন ঢাকা থেকে তারাও যার যার ঘরে চলে গেলেন। সবাই চলে গেলে সহকারী প্রটোকল অফিসার রিসেপশনের একটি লম্বা সোফা ছিল সেখানে শুতে গেলেন। রাষ্ট্রপতির দরজার দুই পাশে ছিল রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন। সার্কিট হাউসের বাইরে প্রহরায় ছিল পুলিশ। ভোর চারটার দিকে বিকট এক আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রটোকল অফিসারের। কিছু বোঝার আগেই দেখেন তার সামনের বারান্দার কিছু অংশ ঝুলে পড়েছে। খুব সম্ভব কোন শেল আঘাত করেছে। খাবার ঘরের জানালা দিয়ে তিনি দেখলেন, সার্কিট হাউসের গেট দিয়ে সামরিক বাহিনীর যান ঢুকছে। সেখান থেকে লাফিয়ে নামছে সৈন্যরা এবং গুলি করছে পুলিশদের লক্ষ্য করে। পুলিশ কোন প্রতিরোধ করেনি। কারণ, প্রতিরোধ বৃথা তা তারা বুঝেছিল। প্রটোকল অফিসার পাশের ডাইনিং রুমের টেবিলের নিচে ঢুকে পড়লেন। সেখান থেকে শুনলেন দোতলায় রাষ্ট্রপতির ঘরের দিকে যাওয়া বুটের শব্দ। আরও চিৎকার, গুলির শব্দ। প্রটোকল অফিসারের ভাগ্য ভাল যে, কেউ খাবার ঘরে ঢোকেনি। প্রায় এক ঘণ্টা এই তাণ্ডব চলার পর প্রটোকল অফিসারের মতে, গাড়িগুলো সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যায়। তিনি খাবার ঘর থকে উঁকি মেরে দেখেন, সামনে পড়ে আছে রাষ্ট্রপতির গার্ডের একজনের মৃতদেহ। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন, রক্ত। পেছনের দরজা দিয়ে ভয়ে তিনি পালিয়ে চলে আসেন ট্রান্সপোর্ট পুলের গ্যারেজে। সার্কিট হাউসে এখনও আক্রমণকারীরা আছেন কিনা তিনি জানেন না। বা রাষ্ট্রপতির অবস্থা কী। সাইফুউদ্দিন বললেন, প্রটোকল অফিসার যদি পারে তবে সার্কিট হাউসে চলে যেতে। তিনিও ড্রাইভার পাওয়া মাত্র সার্কিট হাউসে চলে যাবেন। (চলবে)
×