ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে আইনটি বাস্তবায়নের আশা এনবিআরের

মূসক আইন সংশোধনে সবুজ সঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৮ মে ২০১৬

মূসক আইন সংশোধনে সবুজ সঙ্কেত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন সংশোধনে সবুজ সঙ্কেত পেতে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলবার এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। মতিঝিলের এফবিসিসিআই ভবনের কনফারেন্স রুমে ‘কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স অব মেডিসিনাল প্লান্টস এ্যান্ড হারবাল প্রোডাক্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের সংশোধন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছি। তাই এবার কাজ হয়ে যাবে। মূসক আইন সংশোধনের জন্য গত রবিবার এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ওই চিঠির সঙ্গে বেশকিছু সংশোধনী প্রস্তাব যুক্ত করে এফবিসিসিআই তা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন চেয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মূসক আইন বিষয়ে তিন দফা চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি। গত ২৪ এপ্রিল পাঠানো প্রথম চিঠিতে মূসক আইনের সংশোধনী চাওয়া হয়েছিল। পরের চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, নতুন চিঠিতে এফবিসিসিআই সব পর্যায়ে কর মুক্তির সীমা ২৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা করতে মূসক আইনের ২(৪৮) ধারা এবং ৩৬ লাখ টাকা থেকে দেড় কোটি টাকা লেনদেন পর্যন্ত ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপের জন্য ২(৫৭) ধারার সংশোধন চেয়েছে। এ দুটি ক্ষেত্রে ‘উল্লেখিত টাকার সীমা’ শব্দগুলো যোগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে। অনাদায়ী করের জন্য করদাতার সব আত্মীয়কে দায়ী করার বিষয়টি বাতিল করার দাবি করা হয়েছে এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবে। এজন্য ২(৯৭) ধারার ‘ক’ উপধারা থেকে ‘ব্যক্তির কোন আত্মীয়’ কথাটি বাদ দেয়ার দাবিসহ বেশকিছু প্রস্তাব করা হয়েছে চিঠিতে। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বর্তমানে রাজস্ব আদায়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশে বর্তমানে আয়করের পরই ভ্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। নিকট ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হবে ভ্যাট। এ লক্ষ্যে সরকার চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন ২০১২ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন স্তরের পরিবর্তে সব পণ্য ও সেবায় শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল থাকছে। এনবিআর থেকে প্রাপ্ত এক হিসাবে দেখা যায়, নতুন আইন বাস্তবায়িত হলে আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়বে। তবে রাজস্ব বাড়ার সুখবর থাকলেও নতুন আইন নিয়ে বর্তমানে ব্যবসায়ী ও সরকার মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ব্যবসায়ী ফোরাম আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রীও এ নিয়ে দফায় দফায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ফলে সমস্যা সমাধানে এনবিআর অর্থমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনটি ২০১২ সালে পাস হলেও চার বছর পর তা কার্যকর হতে যাচ্ছে। নতুন আইনে ছোট-বড় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সমান হারে ভ্যাট দেয়ার বিধান রেখে বাতিল করা হবে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা। থাকছে না প্যাকেজ পদ্ধতি কিংবা ট্র্যাঙ্কেটেড (ট্যারিফ মূল্য) ব্যবস্থাও। এসব জটিলতা নিরসনে ও ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে দুই বছর আগে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। এনবিআরের প্রাক্তন সদস্য আলী আহমেদকে চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সহসভাপতি জসীম উদ্দিনকে কো-চেয়ারম্যান করে ওই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গত বছরের জানুয়ারিতে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কমিটির সুপারিশে বাংলাদেশের বাস্তবতায় হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট রাখা ও প্যাকেজ প্রথা বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়। এফবিসিসিআই ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভ্যাট আইন সংশোধনের পক্ষে ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, ভ্যাট আইন সংশোধন করে সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুই দফা চিঠি পাঠিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তবে ব্যবসায়ী মহলের ওই দাবিকে আপাতত আমলে না নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল থাকছে। তবে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের পরে ভ্যাটে ভিন্ন স্তর নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। এরই মধ্যে নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন না করে বাস্তবায়ন করলে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের দাবি, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য ও সেবার মূল্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ পরোক্ষ কর হিসেবে ভ্যাটের ভার সব ধরনের ক্রেতার ওপরই আসবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু ধারা সংশোধন না করে ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে অল্প কিছু খাত ছাড়া ১৫ শতাংশ হারে প্রায় সব পর্যায়ে ভ্যাট পরিশোধ বাধ্যতামূলক হবে। আর এতে পণ্যের দাম বাড়বে। যেমন নতুন ভ্যাট আইন অনুসারে ছোট মাপের একটি খাবারের দোকানিকেও এই হারে ভ্যাট দিতে হবে। ১০০ টাকার তরকারি ১১৫ টাকায় কিনতে হবে ক্রেতাকে। বিপাকে পড়তে হবে অনলাইন ক্রেতাদেরও। বর্তমানে অনলাইন পণ্য ও সেবায় ৪ শতাংশ ভ্যাট আরোপ থাকলেও ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হতে যাচ্ছে। স্থাবর সম্পত্তি, ইজারা, যে কোন লাইন্সেস, পারমিটসহ আমদানি, উৎপাদন, ব্যবসায়ী পর্যায়ে পণ্য ও সেবার অন্তত ৫৩৬টি খাতে ভ্যাট আরোপ রয়েছে। ব্যতিক্রমী অল্প কিছু খাত ছাড়া সব খাতেই ভ্যাট আরোপ হবে। ভ্যাট আইনানুসারে সম্পূরক শুল্ক কমানোর ফলে আসছে অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে আনুমানিক ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানোর ফলে ক্ষতি পুষিয়েও বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু নিত্যপণ্যের ওপর প্রায় সব খাতেই দাম বাড়ছে। অন্যদিকে নতুন ভ্যাট আইনে ১ জুলাই থেকে প্যাকেজ ভ্যাটের বিধান বাতিল হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন বলে দাবি করছেন। তারা বলছেন, তাদের পক্ষে উপকরণ ক্রয় এবং ওই উপকরণ দিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির হিসাব রাখা সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে ফিক্সড ভ্যাট বা প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে প্যাকেজ ভ্যাটের পরিমাণ বাড়াতে পারে। এরই মধ্যে এফবিসিসিআই প্যাকেজ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে প্যাকেজ ভ্যাট অনুসারে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৪ হাজার, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে ১০ হাজার, জেলা শহরের পৌর এলাকায় ৭ হাজার ২০০ ও দেশের অন্যান্য এলাকায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এনবিআর থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও রাজস্ব আদায়, ভোক্তা পর্যায়ে ও দেশীয় শিল্পে কী প্রভাব পড়তে পারে, এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পরিস্থিতিপত্র পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতিপত্রে নতুন আইন বাস্তবায়নে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার বিলোপ, সম্পূরক শুল্কের আয়তন সংকোচন, ট্যারিফ মূল্যের বিলুপ্তি, সংকুচিত মূল্যভিত্তির বিলুপ্তি ও প্যাকেজ ভ্যাট বিলুপ্তির বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দিকনির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে। পরিস্থিতিপত্রে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে ১ হাজার ৮৭৪টি পণ্য ও সেবাকে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা, স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যের ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য ও ২০টি সেবার ক্ষেত্রে সংকুচিত ভিত্তিমূল্য বলবৎ রয়েছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ভ্যাট নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে এনবিআরের আলোচনায় যেসব প্রস্তাব বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছিল, তার কোনটিই নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়নি। এ আইন নিয়ে আলোচনার সময় এনবিআর এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে সাতটি প্রস্তাব নিয়ে একমত হয়ে সই করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো আইনে এর কোন প্রতিফলনই ঘটেনি। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, ভ্যাটের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানেন। আশা করি এ বিষয়ে কোন সমস্যা হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মন্ত্রীর দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে আমি আশা করব শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভালভাবে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে আইনটি বাস্তবায়নে সক্ষম হব।
×