ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনরোষ থেকে বাঁচাতে ওই প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়েছি ॥ সেলিম ওসমান

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৭ মে ২০১৬

জনরোষ থেকে বাঁচাতে ওই প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়েছি ॥ সেলিম ওসমান

নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ, ১৬ মে ॥ নারায়ণগঞ্জ বন্দরে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে গণপিটুনি ও পরে স্থানীয় এমপির সামনে কান ধরে উঠবস করার ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এদিকে আহত ওই প্রধান শিক্ষক নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যার হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। শুক্রবার ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করে মন্তব্য করার অভিযোগে ও এক ছাত্রকে প্রহার করার ঘটনায় বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত জনরোষের শিকার হন ও পরে উত্তেজিত জনতার হাতে গণপিটুনিতে আহত হন। পরে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান একই অভিযোগে তাকে কান ধরে ওঠবস করিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। এ বিষয়ে এমপি সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের জানান, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পরে কমিটির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি জানতে পারি যে, ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে মারধর করা হচ্ছে। খবর পেয়ে আমি সেখানে পুলিশ পাঠাই। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু পুলিশ তাকে বাইরে নিয়ে আসতে পারছিল না। কয়েক হাজার উত্তেজিত জনতা তাদের ঘিরে রেখেছিল। খবর পেয়ে আমি সেখানে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করিয়ে তাকে উদ্ধার করি। এছাড়া তাকে জনরোষের হাত থেকে উদ্ধার করা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। প্রধান শিক্ষকের শাস্তির পরে বিক্ষুব্ধ জনতা শান্ত হলে তাকে থানায় নিয়ে নিরাপত্তা হেফাজতের ব্যবস্থা করি। তিনি বর্তমানে হাসপাতালে নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন। আহত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম তার বোন পারভীন আক্তারকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে বসানোর জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে আসছিলেন। তিনি এ স্কুলের প্রায় সতেরো বছর ধরে প্রধান শিক্ষক। টিনশেড ভবন থেকে স্কুলকে এখন পাকা ভবনে এনেছেন তিনি। তাই তিনি রাজি হচ্ছিলেন না স্কুলের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে। এছাড়া ম্যানেজিং কমিটির বিভিন্ন অপকর্মে তিনি বাধা দিচ্ছিলেন। এজন্য পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার জন্য ধর্মীয় অবমাননার গুজব ছড়ানো হয়েছে। বন্দর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মৌসুমী হাবিব জানান, ঘটনাটি তদন্তে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আ খ ম নূরুল আলমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আ খ ম নূরুল আলম জানান, ঘটনাটির তদন্তে কাজ চলছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হবে। পরে বিস্তারিত জানতে পারবেন। বন্দর থানার ওসি জানান, কেউ মামলা করতে আসেননি। ওই শিক্ষক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দিয়েছি। হাসপাতালে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ॥ এদিকে, উক্ত প্রধান শিক্ষক শ্যামল চন্দ্র ভক্ত লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন মহলে জোর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ শহরের খানপুরে ৩শ’ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে ওই শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে সমবেদনা জানান। এ সময় শিক্ষক শ্যামল চন্দ্র ভক্ত সেদিনের ওই ঘটনায় তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার বলে সুশীল সমাজের নেতাদের কাছে অভিযোগ করেন। পাশাপাশি তিনি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাকে সান্ত¡না দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, মহিলা পরিষদের শহর কমিটির সভানেত্রী শাহানারা বেগম। নেতৃবৃন্দ পরে সাংবাদিকদের কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। নাগরিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ এর আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, একজন প্রধান শিক্ষকের গায়ে হাত তুলে সারাদেশের শিক্ষক সমাজকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর যথাযথ বিচারের দাবি জানান তিনি। শিক্ষামন্ত্রীর নিন্দা ॥ ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে এমপির উপস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জে এক শিক্ষককে পেটানোর পর কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ঘটনার তদন্ত করে করণীয় ঠিক করা হবে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটার খবর নিয়েছি, এটা খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে আরও তথ্য নেব। প্রয়োজনে আরও তদন্ত করে এই বিষয়ে যা যা করণীয় সম্ভব সেটা করব। সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর এগে শুক্রবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কথিত অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে পিটিয়ে জখম করে স্থানীয় একটি চক্র। এক পর্যায়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান তাকে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করেন। ওই শিক্ষকের অভিযোগ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যদের ‘অনৈতিক অবদার’ না রাখায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ধর্মীয় অবমাননার কথা বলে এলাকাবাসীকে জড়ো করে তার উপর হামলা চালানো হয়। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যদি তিনি (শিক্ষক) কোন অপরাধ বা ভুল করে থাকেন তাহলে নিয়ম কানুন আছে, রীতি-রেওয়াজ আছে। এটাকে (কান ধরে উঠবস) গ্রহণযোগ্য মনে করি না, এটার জন্য আমরা বিব্রত। আমরা এই ধরনের ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। একজন শিক্ষককে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করা কিংবা তার প্রতি এই ধরনের আচরণ করা কখনই কাম্য হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষা পরিবারে বিপুল সংখ্যক মানুষ আছে। এর মূল শক্তি শিক্ষক। তারা না থাকলে আমরা শিক্ষার্থীদের যে লক্ষে নিতে চাই, তা পারব না। শিক্ষকদের কাছেও সেটাই বলি, আপনারাও আরও ভাল করে পড়াবেন, ভাল আচরণ করবেন। যাতে আপনাদের জীবনাচরণ ছাত্ররা অনুসরণ করে। সেই হিসেবে শিক্ষকদের কাছে আমাদের কাম্য, শিক্ষার্থীদের বর্তমান যুগোপযোগী করে তুলবেন। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করতে পারবেন না। কারণ এর প্রতিক্রিয়াটা খারাপ হয়, শিক্ষার্থী তখন প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। সে জন্য স্নেহ ভালবাসা মমতা দিয়ে তাদের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। শুক্রবারের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণদী গ্রামের এ ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে একটি কমিটি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে কোন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হয়নি। এদিকে ঢাকা কমার্স কলেজে ভালবাসার প্রস্তাবে শিক্ষার্থী বহিষ্কার নিয়ে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। ভালবাসার প্রস্তাব দেয়ার ভিডিও প্রকাশের পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ঢাকা কমার্স কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও ৯ জনের ভর্তি বাতল ঘটনার বিষয়ে পুরো তথ্য জানা নেই বলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি শিক্ষামন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না এই জন্য যে, বিষয়টা সম্পর্কে তথ্য জানা হচ্ছে। কমার্স কলেজে ঘটনা হয়েছে- সেটাকেও আমরা খোঁজ খবর নিতে বলব। কমার্স কলেজের ব্যাপারে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।
×