ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিহাব ছিল আনসারুল্লাহ স্লিপার সেলের অস্ত্র সরবরাহকারী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৭ মে ২০১৬

শিহাব ছিল আনসারুল্লাহ স্লিপার সেলের অস্ত্র সরবরাহকারী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শুধু কলাবাগানে নয়, ঢাকায় ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার বেশিরভাগ চক্রান্ত হয় মৌলভীবাজার থেকে। সেখানকার এক মাদ্রাসার শিক্ষক এসব হত্যার নেপথ্য কারিগর। ওই শিক্ষকের বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটায়। প্রতিটি হত্যাকা-ের আগে কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনায় আটক শরিফুল ইসলাম শিহাব জানত। তার সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হাইকমান্ডের যোগাযোগ রয়েছে। দলের নির্দেশ অনুযায়ী শিহাবের প্রধান কাজ ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সিøপার সেলকে অস্ত্রগোলাবারুদ সরবরাহ করা। কলাবাগানে জোড়াখুনের ঘটনায় উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে একটি শিহাবের সরবরাহ করা। ঢাকায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটির বেশ কয়েকটি সিøপার সেল ছদ্মবেশে অবস্থান করছে। তিন দিনের রিমান্ডে থাকা শিহাবকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শিহাবের (৩৬) বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে। তারা দুই ভাই এক বোন। শিহাবের বড় ভাই একটি ওষুধ কোম্পানিকে কাজ করেন। শিহাব আর তার একমাত্র বোন যমজ। বড় ভাই শিহাবের চেয়ে দুই বছরের বড়। অনেক আগেই বাবা মারা গেছে। পিতার মৃত্যুর পর শিহাবদের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় শিহাব স্কুলে পড়াশুনা করত। স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। বাবার মৃত্যুর পর অত্যন্ত দূরন্ত প্রকৃতির শিহাবের আর কলেজে পড়া হয়নি। তাকে ভর্তি করা হয় মাদ্রাসায়। বড় ভাই দুই ভাইবোনের পড়া লেখার খরচ চালাতেন। মাদ্রাসায় পড়ার এক পর্যায়ে শিহাব চলে যায় মৌলভীবাজারের একটি মাদ্রাসায়। সেখানেই শিহাব এক মাদ্রাসার শিক্ষকের মাধ্যমে উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালে কাজ শুরু করলেও ২০০০ সালে শিহাব উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজির হয়ে পুরোদমে কাজ করা শুরু করে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত পুরোদস্তুর হুজির হয়ে কাজ করে। পরে ওই শিক্ষকের অনুপ্রেরণা আর বয়ানে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিহাব মারাত্মক উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। পুরোপুরি শিহাব ধর্মীয় জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয়। ২০১৫ সালে ওই মাদ্রাসা শিক্ষকের কথামতো এবং ওই শিক্ষকের এক ঘনিষ্ঠ অনুসারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সেই ঘনিষ্ঠতার সুবাদে শিহাব নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে। এরপর শিহাব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মৌলভীবাজার ও কুষ্টিয়া জেলার হয়ে কাজ করতে থাকে। ঘন ঘন যাতায়াত করতে থাকে কুষ্টিয়া আর মৌলভীবাজারে। এদিকে শিহাব উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের দাখিল পাস করে। এরপর আর শিহাবের পড়াশুনা হয়নি। শিহাবের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হাইকমান্ডের। হাইকমান্ডের নির্দেশ মোতাবেক শিহাবের মূল দায়িত্ব পড়ে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সিøপার সেলের কাছে সরবরাহ করা। কুষ্টিয়া বাড়ি হওয়ার কারণে শিহাব এ দায়িত্ব পায়। দলের নির্দেশ মোতাবেক শিহাব সীমান্ত এলাকায় তৈরি এবং পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্রগোলাবারুদ সংগ্রহের কাজটি করতে থাকে। সংগৃহীত অস্ত্রের মধ্যে কোনটি কোন সেলের কাছে যাচ্ছে তার হিসাবও রাখে শিহাব। অস্ত্র সরবরাহের সুবাদে কোন সেল কোন অপারেশনের জন্য কোথায় অবস্থান করছে, টার্গেটকৃত ব্যক্তি কে এসব নানা বিষয় জানত শিহাব। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ঢাকায় ব্লগার, প্রকাশক ও লেখকসহ যত হত্যাকা- ঘটেছে তার প্রতিটি ঘটনাই ঘটিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এর অধিকাংশ ঘটনা ঘটার আগে শিহাব জানত। এমনকি অনেক অপারেশনে ব্যবহৃত অস্ত্র শিহাব সরবরাহ করে। কলাবাগানে জোড়া খুনের পরিকল্পনা হয় অনেক আগে। আর দুই মাস আগে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে মোতাবেক অপারেশনে অংশ নেয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পড়ে শিহাবের। হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারীদের একেকজন একেক জেলার। শিহাব তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা ও ম্যাসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। এছাড়া বেশ কয়েকবার শিহাব হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সরাসরি দেখাসাক্ষাতও করে। হত্যাকারীরা ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করে। এরপর তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে শিহাব। কলাবাগানে দুইজনকে হত্যার পর পালানোর সময় পুলিশ একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সেই ব্যাগে একটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের রিভলভার ও একটি শাটারগান উদ্ধার করে। সীমান্ত এলাকার একটি কারখানায় তৈরি শাটারগানটি শিহাব নিজে উপস্থিত থেকে কিনে নেয়। আর রিভলভারটি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিনে। জিজ্ঞাসাবাদে কলাবাগানের হত্যাকা-ে কারা কারা উপস্থিত ছিল, তা জানিয়েছে শিহাব। তবে নিজে উপস্থিত ছিল না বলে দাবি করেছে। শুধু কলাবাগানে নয়, ঢাকার কোন অপারেশনেই শিহাব উপস্থিত ছিল না বলে দাবি করেছে। তবে ঢাকায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কারা অপারেশন চালিয়েছে, তা শিহাবের জানা। অপারেশনের আগে তারা শিহাবের সঙ্গে অস্ত্রের জন্য যোগাযোগ করেছে। এমনকি ঢাকায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বেশ কয়েকটি সিøপার সেলের সদস্যরা ছদ্মবেশে অবস্থান করছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, শিহাব রিমান্ডে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। অনেকের নাম প্রকাশ করেছে শিহাব। ঢাকায় ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যাকা-ের বিষয়েও শিহাবের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেসব তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে যাচাইবাছাই চলছে। প্রসঙ্গত, গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন ৩৫ নম্বর আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলায় নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে বাসায় ঢুকে চাপাতি দ্বারা কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত থাকা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়।
×