ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

কৃষিপণ্যটি সমৃদ্ধ করতে পারে অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৬ মে ২০১৬

কৃষিপণ্যটি সমৃদ্ধ করতে পারে অর্থনীতি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালে সারাদেশে ফুলকপি উৎপাদনের ওপর একটি নমুনা জরিপ সম্পন্ন করে। দেশব্যাপী যে সব গৃহস্থালি ন্যূনপক্ষে এক শতাংশ জমিতে ফুলকপি উৎপাদন করে তাদের মধ্য থেকে প্রাথমিক নমুনা ইউনিট হিসেবে ১৭০টি গৃহস্থালিকে নির্বাচিত করে এই জরিপ সম্পন্ন হয়। যে সব গৃহস্থালি ১ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি জমিতে ফুলকপি আবাদ করে তারা তা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে বলে ধরা হয়েছে। সাধারণত ফুলকপি আমাদের দেশে শীতকালে উৎপন্ন হয়। এর রোপণ থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ বা বাজারজাতকরণের সময় আড়াই থেকে ৩ মাস। আমাদের দেশে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফুলকপি উৎপন্ন হয়। অধুনা রোপণের সময় আগে নিয়ে গিয়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ফুলকপির চাষ শুরু হয় এবং কতিপয় এলাকায় সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত দুই দফায় ফুলকপির উৎপাদন দেখা যায়। ফুলকপি সাধারণত ১৫-২০ ডিগ্রি সে. তাপে আর্দ্রতাসম্পন্ন আবহাওয়ায় ভাল জন্মায়। রোপণ থেকে শুরু করে ফসল তোলার সময় উপযুক্ততা ৯০ থেকে ১০০ দিন। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিমাগার স্থাপিত হওয়ায় ফুলকপি এখন বাংলাদেশে বছরে ১২ মাসের মধ্যে ৯ মাস ধরে পাওয়া যায়। ওয়াকিফহাল কৃষিবিদরা বলেছেন, আবহাওয়া সহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন ও বিতরণ করে কিংবা পলিথিন আচ্ছাদনের ভিতরে চাষ করে ফুলকপি এদেশে সারা বছরই উৎপাদন করা সম্ভব। জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে সর্বমোট ২১৪৭২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলকপির চাষ হয়। বাণিজ্যিক চাষের বাইরে গৃহস্থালির আনাচে কানাচে পারিবারিক ভোগের জন্য ফুলকপি উৎপন্ন হয়। এসব উৎপাদন হিসেবে নিলে এদেশে প্রায় ৪৩ হাজার একর জমিতে ফুলকপির চাষ হয় বলা চলে। বাণিজ্যিকভাবে ফুলকপি চাষের এই জমির মধ্যে প্রায় ৭০% জমি চাষীর নিজের। ইজারা নিয়ে কপি চাষ করা হয় শতকরা প্রায় ২০ ভাগ জমিতে। ভাগ চাষে চাষ করা হয় শতকরা ৪ ভাগ জমিতে। আর শতকরা ৭ ভাগ জমি চাষীরা বন্ধককৃত জমিতে চাষ করে থাকেন। সারাদেশে কপি চাষে প্রযুক্ত সকল জমির শতকরা প্রায় ৬১ ভাগ খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে এবং শতকরা প্রায় ৩৯ ভাগ বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে অবস্থিত। সারাদেশে কপি চাষে প্রযুক্ত প্রায় ১৭ ভাগ জমিতে স্থানীয় জাতের কপি উৎপন্ন হয়। হাইব্রিড জাতের কপি উৎপাদনে প্রযুক্ত জমির শতকরা প্রায় ৮১ ভাগ। হাইব্রিড জাতের কপির চাষ শুরু হয়েছে ১০/১২ বছর আগে। এর মধ্যে শতকরা ৮৬ ভাগ জমিতে একক সবজি হিসেবে ফুলকপি উৎপন্ন হয়। শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ জমিতে কপি উৎপাদিত হয় মিশ্র ফসল হিসেবে। এতে প্রতিভাত হচ্ছে যে, মিশ্র ফসল হিসেবে ফুলকপির উৎপন্ন তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয়। দৃশ্যত মিশ্র ফসল হিসেবে উৎপাদনের চাষে প্রযুক্ত জমির বার্ষিক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রয়োজনীয় গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ করা সঙ্গত। জরিপে দেখা গেছে শীতের মৌসুমে ফুলকপি চাষে প্রযুক্ত জমির শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগে ফুলকপি উৎপন্ন হয়। ফুলকপি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হওয়ার আগে একই জমিতে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ জমিতে বাঁধাকপির চাষ করা হয়। শীত মৌসুমের আগে চাহিদা অনুযায়ী ফুলকপির চাষ সম্প্রসারণ করা কৃষকের জন্য লাভজনক এবং সমাজের জন্য হিতকর। এ দিকেও প্রায়োগিক গবেষণা প্রযুক্ত করা প্রয়োজন। জরিপের ফল অনুযায়ী দেখা যায়, ১ একর জমিতে ফুলকপি উৎপাদনের জন্য ৮৬ জন মজুর (৮৬ জনদিবস) প্রয়োজন হয়। এই জনদিবসের মধ্যে ২৪ জনদিবস প্রয়োজন হয় চারা রোপণে, ৩৫ জনদিবস প্রযুক্ত হয় আগাছা নিড়ানিতে এবং ফসল তুলতে লাগে ২৭ জনদিবস। উন্নত দেশে ফুলকপি চাষে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যক জনবল কমানো ও লাভের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। বর্তমানে জমি চাষের বাইরে কপি উৎপাদনে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় না। ফুলকপি চাষে ব্যবহার্য জমির বার্ষিক ইজারা মূল্য একর প্রতি ৭৭৫২ টাকা। অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই ধরনের জমি থেকে প্রাপ্ত ইজারা মূল্য প্রান্তিকভাবে বেশি। এতদসত্ত্বেও জমির মালিক ফুলকপি চাষে জমি কেন ইজারায় দেন তা এই জরিপে প্রতিভাত হয়নি। এক একর জমিতে এক মৌসুমে স্থানীয় জাতের ফুলকপি উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ৬৫৯৮২ টাকা। আর হাইব্রিড জাতীয় কপি উৎপাদনে একর ও মৌসুম প্রতি খরচ হয় ৬৪১৭৬ টাকা। স্থানীয় জাতের কপির তুলনায় হাইব্রিড জাতীয় কপি উৎপাদনের নি¤œতর ব্যয় হাইব্রিড কপি দিয়ে স্থানীয় জাতের কপি চাষকে দ্রুত বিকল্পায়িত করছে বলে মনে হয়। ধারণা করা যায়Ñ হাইব্রিড কপি চাষে আপেক্ষিকভাবে অধিকতর সার ও কীটনাশকাদি ব্যবহার করা হয়। কীটনাশকের ব্যবহার যাতে পরিমিত থাকে এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিষের উপকরণ হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নজর দেয়া প্রয়োজন। জরিপে পাওয়া গেছে যে, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর বিভাগে একর ও মৌসুম প্রতি ফুলকপি উৎপাদনের খরচ ৬৩১২৭ টাকা। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে এই খরচের পরিমাণ বেশি, ৬৭০০১ টাকা। সারাদেশে একর ও মৌসুম প্রতি গড় খরচ ৬৪৬৫০ টাকা। এই খরচের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭ ভাগ প্রযুক্ত হয় জমি তৈরি করণে। শতকরা ২৬ ভাগ লাগে বীজ চারা রোপণে। শতকরা ১২ ভাগ প্রয়োজন হয় নিড়ানিতে, ৬ ভাগ সেচে। প্রায় ৭ ভাগ কীটনাশকাদি প্রয়োগে, শতকরা ২১ ভাগ লাগে সার আহরণ ও প্রয়োগে; ফসল তোলার জন্য প্রয়োজন হয় শতকরা প্রায় ৮.৫ ভাগ। সারাদেশে একর ও মৌসুম প্রতি উৎপাদন হয় ১৩০৬৮ কেজি ফুলকপি। এর মধ্যে খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে স্থানীয় জাতের ফুলকপির একর প্রতি উৎপাদন ১০৯৬৫ কেজি এবং হাইব্রিড জাতের একর প্রতি উৎপাদন ১৩৫৭৫ কেজি। জরিপে আরও দেখা গেছে যে, শীতের মৌসুম শুরু হওয়ার আগে কপি চাষ করলে তার একর প্রতি উৎপাদন হয় ৯৯৪২ কেজি। আর প্রথামাফিক সময়ে একর প্রতি উৎপাদন হয় বেশি, ১৪১৩৩ কেজি। বলা চলে শীতের প্রথাগত সময়ের আগে উৎপাদিত কপি অধিকতর মূল্যে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হয়। এর আলোকে বলা যায় প্রথাগত মৌসুমের আগে বা পরে একর প্রতি ফুলকপির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অধিকতর লাগসই বীজ ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বিশেষত উত্তরবঙ্গের প্রলম্বিত শীতের জেলাসমূহের জমির প্রকার ভেদে কপির সময়ান্তর চাষ ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে লাগসই প্রায়োগিক গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করা লাভজনক হবে বলে মনে হয়। জরিপে দেখা গেছে, সারাদেশে একর প্রতি উৎপাদিত ফুলকপির মূল্য ১৩১৭৯৯ টাকা। এর মধ্যে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর জেলায় একর প্রতি উৎপাদন মূল্য হিসাব করা হয়েছে ১৩৩৫৩৮ টাকা। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে একর প্রতি উৎপাদনের মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ১৩৪২০২ টাকা। এই দামে ফুলকপির পাতা ও কা- স্থান পায়নি, যা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। স্পষ্টত আঞ্চলিকভাবে একর প্রতি উৎপাদন মূল্যের তেমন কোন তারতম্য দৃষ্ট হয় না। সম্ভবত দেশব্যাপী বিস্তৃতভাবে সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে এ ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে স্থানীয় বীজে উৎপাদিত ফুলকপির একর প্রতি উৎপাদন মূল্য ১২২২৫৭ টাকা। আর হাইব্রিড বীজে উৎপাদিত একর প্রতি উৎপাদন মূল্য ১৩৬৫৮৪ টাকা। হাইব্রিড জাতের একর প্রতি উৎপাদন বেশি বলেই এই তারতম্য হয়েছে বলে মনে হয়। বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে স্থানীয় ও হাইব্রিড বীজের ফুলকপির গুণগত ব্যবধান খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না বলে ধারণা করা যায়। অন্য কথায় ভোক্তা পর্যায়ে দেশী ও হাইব্রিড কপির দামে কোন পার্থক্য নেই। এর অর্থ হাইব্রিড ফুলকপির উৎপাদন দেশী ফুলকপির আপেক্ষিকতায় তাৎপর্যমূলকভাবে বেশি হলেই হাইব্রিড ফুলকপির চাষ দ্রুত বাড়বে। জরিপে দেখা গেছে মৌসুম-পূর্ব উৎপাদনের ক্ষেত্রে একর প্রতি উৎপাদন মূল্য ১৪৮০৭৬ টাকা। এর বিপরীতে মৌসুম বা প্রথাগত সময়ে উৎপাদিত ফুলকপির একর প্রতি উৎপাদন মূল্য ১২৮৯৩৪ টাকা। এতে মনে হয় যে, প্রথাগত মৌসুমের আগে বা পরে কপির চাষ বিস্তৃত করলে চাষীরা লাভবান হবেন। জরিপের নির্যাস হিসেবে দেখা গেছেÑ দেশে ফুলকপি চাষের একর প্রতি গড় উপযোগ-ব্যয় হার তথা উৎপাদনশীলতা ২.০৬। স্থানীয় বীজ উৎসারিত কপির ক্ষেত্রে এই উৎপাদনশীলতা ১.৮৫। আর হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ২.১২। খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে উৎপাদনশীলতা ২.১২ এবং বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বিদিত হয়েছে ২.৩-এ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সারাদেশে ফুলকপি উৎপাদন লাভজনক। ১ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩ মাসে ২ টাকার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এ লাভজনক অবস্থা হাইব্রিড বীজ উৎসারিত ফুলকপির ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি। ১ টাকা বিনিয়োগে এর বিপরীতে ৩ মাসে ২ টাকা ১২ পয়সা পাওয়া যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দেশে ফুলকপির চাহিদা ব্যাপক এবং এর উৎপাদনশীলতার বিবেচনায় উৎপাদনের মৌসুম প্রথাগত মৌসুমের আগে ও পরে বিস্তৃত করা লাভজনকতার নিরিখে ঈপ্সিত। এদিকে প্রায়োগিক গবেষণা ও উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা এবং একই সঙ্গে ফুলকপি সংরক্ষিত করার জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন করা বিধেয়। সমকালে বিদেশে ফুলকপি রফতানির পরিমাণ তেমন বেশি নয়। দেশ থেকে বাঁধাকপি ও ফুলকপির বার্ষিক রফতানি প্রায় ২৯৩৩০ কেজি ও রফতানি আয় ২৮৮০২৩৬ টাকা। প্রয়োজনীয় পরিবহন সুবিধা ও বিদেশী বাজার বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে ফুলকপি রফতানি বাড়ানো যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপীয় দেশসমূহ এর জন্য সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচ্য। এর বাইরে দেশে ফুলকপির জন্য বিশেষায়িত হিমাগার প্রতিষ্ঠিত করে এবং অধুনা উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে শুকনো সবজি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে এর চাহিদা বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও জাপানে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করা লক্ষ্যানুগ হবে। লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য
×