ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সব দলের সিনিয়র নেতাদের ঐকমত্য

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ মে ২০১৬

সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সব দলের সিনিয়র নেতাদের ঐকমত্য

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে একমঞ্চে ঐকমত্য পোষণ করলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতারা। স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার বন্ধ, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নেরও দাবি ওঠে অনুষ্ঠানে। অধিকাংশ নেতাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের সূতিকাগার পাকিস্তানের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য কোনভাবেই মেনে নেয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশ হবে এমন একটা দেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক যে কোন পরিচয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মাথা উচুঁ করে বাঁচবে। এদেশে তারাই রাজনীতি করবে যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তাদের এদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার থাকতে পারে না। শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৭ দফা দাবিতে অনুষ্ঠিত এ জাতীয় সংলাপে সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সোচ্চার দাবি জানান নেতারা। একই মঞ্চে থাকা বিএনপি নেতাদের সামনে পেয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা হামাসের সঙ্গে তাদেরই এক নেতার গোপন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তাদের একহাত নেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি গোপন বৈঠকে উপস্থিত থাকা ওই নেতাকে দ্রুত বহিষ্কার করার জন্য বিএনপি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এমপির সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেনÑ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু লারমা), তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট কামাল লোহানী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল প্রমুখ। সংলাপ সঞ্চালনা করেন আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত। জাতীয় পাার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের সংলাপে উপস্থিত থাকতে না পারলেও লিখিত বার্তা পাঠিয়ে সাত দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৯৪৭ সালে দেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ ২০১১ সালে তা মাত্র দশ শতাংশে নেমে আসে। সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং জমি দখল বন্ধ না হলে একদিন হয়ত এ দেশ আদিবাসী ও সংখ্যালঘুশূন্য হয়ে যাবে। তাই জাতীয় সংসদে ২০ ভাগ হারে ৬০টি আসন সংরক্ষণ, সাংবিধানিক বৈষম্য বিলোপ, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা, স্বার্থবান্ধব আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য নিরসন, দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার সাত দফা দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মাটি থেকে এখনও শহীদের রক্তের দাগ শুকায়নি। অথচ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের দ- যখন কার্যকর করা হচ্ছে, ঠিক তখন পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তুরস্ক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিরোধিতা করছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান-তুরস্কের হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবর্জিত। তিনি বলেন, নানা অজুহাতে যারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালাচ্ছে, তারা কোন দলের প্রতিনিধি হতে পারে না। তবে এ ধরনের হামলা নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার যথেষ্ট সোচ্চার রয়েছে। নির্যাতনকারী ও দখলদারদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন করে কেউ পার পাবে না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, দেশের জনসংখ্যার অনুপাতিক হারে জাতীয় সংসদসহ সকল স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র ও প্রশাসনে সমান প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তাদের অধিকারও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, শান্তিচুক্তি যত শীঘ্রই বাস্তবায়ন হবে, ততই দেশের মঙ্গল। আর প্রত্যেক নাগরিকের সমঅধিকারের বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে। এখন শুধু সময় সে অধিকার বাস্তবায়নের। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, আমি মনে করি আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এক অস্থিরতার রাজনীতি থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে এসেছি। তবে আমরা রাষ্ট্রকে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক করতে পারিনি এবং পারছি না। এক্ষেত্রে সংবিধানে সাংঘর্ষিক বিধান বাতিল করতে হবে। আর এজন্য জাতি ঐক্যবদ্ধ না হলে এগোতে পারবে না। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তান জাতিসংঘে গেলে বাংলাদেশ নিশ্চুপ বসে থাকবে না। মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষের সমঅধিকার থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণেই আদিবাসী আর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারকে আমরা স্পষ্ট করে বলেছি বাংলাদেশ হবে এমন একটা দেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক যে কোন পরিচয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আজ নানা মতের ও নানা রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি একত্রিত করা হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে ভয়াবহ অবিচার ও অন্যায় করা হচ্ছেÑ আমরা সকলে মিলে যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে এ বিপদ দূর করা সম্ভব। আমরা রাজনীতির মতপার্থক্য সত্ত্বেও এ লক্ষ্যে এক থাকতে পারি না কেন? গণতন্ত্রের পথে দাবি করতে হলে এই নীতি মেনে নিতে হবে যে, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষই সমান অধিকার পাওয়ার অধিকার রাখে। জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, এ আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন আমি মনে করি সবাই একমত হবেন। শুধু সমালোচনা দিয়ে কি এ দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব? আমি মনে করি সেটা অসম্ভব। আমি আরও মনে করি যে জাতীয় সংলাপে আমাদের বিশেষ কিছু দেয়া হয় নাই। এতে করণীয়টা কী হতে পারে। আমরা যারা সংখ্যালঘু ও আদিবাসী তাদের পক্ষে কি জাতীয় পর্র্যায়ে আন্দোলন করার ক্ষমতা আছে? আজকে যারা ভুক্তভোগী তাদেরই এ আন্দোলন করতে হবে বলে জানান তিনি। বাসদের খালেকুজ্জমান বলেন, গোলাম আযমের যোগ্য উত্তরসূরি হলো ওলামা লীগ। ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, মরুভূমিতে যেমন গাছ বাঁচে না, তেমনি অনুকূল পরিবেশ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।
×