ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ রিজার্ভ চুরি, পাকিস্তানী হ্যাকার ও একাত্তরের যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১৫ মে ২০১৬

একুশ শতক ॥ রিজার্ভ চুরি, পাকিস্তানী হ্যাকার ও একাত্তরের যুদ্ধ

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা কমে গিয়েছিল। প্রথমদিকে যেভাবে আমরা ঘটনাটিকে পোস্টমর্টেম করেছি এখন তার লেশমাত্র নেই। কিন্তু এই একটি ঘটনা একদিকে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তায় দেশটির অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের আজন্ম শত্রু পাকিস্তানের নোংরামি ও ষড়যন্ত্র প্রকাশ করেছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এটি কেবল চুরি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের চরম শত্রুতার আরও একটি দৃষ্টান্ত। রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশের তিনটি ব্যাংকের ডাটা চুরি এবং পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই)সহ তিনটি হ্যাকার গ্রুপ কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নজর রাখার খবরে আবার আমরা আলোচনায় সরব হয়েছি। এখন সম্ভবত আর সন্দেহ করার প্রয়োজন নেই যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সঙ্গে যুক্ত। এমনকি তুরস্কের হ্যাকাররাও এর সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের সম্ভবত এখন একটু ভাল করে পুরো বিষয়টির পোস্টমর্টেম করা দরকার। ডিজিটাল অসহায়ত্ব : ডিজিটাল যুগে আমরা ভয়ঙ্করভাবে অরক্ষিত। বিষয়টি হয়ত অনেকের কাছে ভয়ঙ্কর মনে হবে। কেউ কেউ একে শঙ্কা তৈরির মতো বাক্য বলেও মনে করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ডিজিটাল যুগে পা দেয়ার পরও এই যুগে ব্যক্তি, শিল্প-বাণিজ্য বা অর্থ খাত যেমনি নিরাপত্তাহীন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবেও অরক্ষিত। আমি বহুবার একথা বলেছি যে, ডিজিটাল যুগে প্রচলিত সমাজ, বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইনকানুন, বিচার-তদন্ত এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ নতুন রূপ পরিগ্রহ করবে। ২০২১ সালের ধারণা করতে পারলেও ২০৪১ সালের রূপটি এখনও সম্ভবত কল্পনাও করতে পারি না। সেই কারণেই ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়টি উপলব্ধি না করতে পারলে কারও পক্ষেই এমনটি অনুভব করা সম্ভব হবে না। আমাদের যেটি স্বাভাবিক ভাবনা তাতে একেবারে হাতের কাছে বা সম্প্রতি যা ঘটে গেল তা নিয়েই বেশি আলোচনা করে থাকি। এখন যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে কথা বলছি। অথচ ২০০৯ সাল থেকেই আমরা যখন ব্যাপকভাবে ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে ধাবিত হই তখন বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের তেমন ভাবনা ছিল না। বলা যেতে পারে, সামনের দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমাদের খুবই কম। পুরো রাষ্ট্রে হয়ত কয়েকজন মানুষ আছেন যারা সামনেরটা দেখেন, তারা হাতে আগুন লাগার জন্য তাপ অনুভব করতে অপেক্ষা করেন না। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম বলে আমরা যথাসময়ে সঠিক কাজটি করতে পারি না। কেউ কেউ স্মরণ করতে পারবেন যে, আমি বহুদিন আগে থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আসছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে সিরিজ আকারে লিখেছি, বলার সুযোগ পেলে সেখানেও বলেছি। সেই কারণে আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম তখনই এর নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু সেই কাজটি আমরা তেমনভাবে এখনও করিনি। এখন দেখছি মিডিয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত। চেম্বার-ফেডারেশন ও সমিতি ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে চিৎকার করছে। সবাই এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন কি আছে, দেশে বিশেষজ্ঞ আছে কিনা বা আমাদের কোন্ কোন্ খাতে কতটা দুর্বলতা কাজ করে সেইসব আলোচনায় ব্যস্ত। মিলিয়ন ডলার না হারিয়ে আমাদের সেই বোধশক্তি জাগেনি। প্রসঙ্গত আমি এটি বলতে চাই যে, আর্থিক দিক নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি আমাদের অন্য বিষয়গুলোর দিকেও তাকাতে হবে। খুব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের টাকা চুরি যতটা আলোচিত হয়েছে তথ্য চুরি তার ভগ্নাংশও আলোচিত হয়নি। অথচ আমি নিজে মনে করি টাকা চুরির চাইতে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে তথ্য চুরিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য চুরি হওয়ার মানেই হচ্ছে পুরো জাতির বিপন্ন হওয়া। ক’দিন আগে এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির পর আমরা সেটি নিয়ে বেশ আলোচনা করেছি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে ধন্যবাদ যে, তারা খুব দ্রুতই বিদেশীসহ এটিএম বুথের চুরির দায়ে অভিযুক্তদের আটক করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এটিএম বুথের চুরির ঘটনার সময়কালেই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল অপরাধটি সংঘটিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের ডিজিটাল অপরাধের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১০১ কোটি ডলার ডিজিটাল পদ্ধতিতে চুরি হওয়া। ঘটনার নানা বিবরণ থেকে জানা যায়, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৬ রাত সাড়ে দশটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট পদ্ধতি ব্যবহার করে ৩৫টি পরিশোধ নির্দেশনার মাধ্যমে মোট ১০১ কোটি ডলার চুরি করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়, যার মধ্যে ৫টি নির্দেশনার বিপরীতে ১০ কোটি ডলারের ২ কোটি শ্রীলঙ্কায় এবং বাকি ৮১ কোটি ডলার ফিলিপিন্সে পাচার হয়। নির্দেশনার ভুল শনাক্ত করে শ্রীলঙ্কা টাকাটা আটকে ফেলে ও বাংলাদেশ টাকাটা ফেরত পায়। ফিলিপিন্সের রিজার্ভ ব্যাংকের একটি শাখা এই পাচারে জড়িত থাকায় সেটি নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। খবরে বলা হয়েছে যে, ৩৫টি নির্দেশনায় শত কোটি ডলার পাচারের নির্দেশনা ছিল। তবে নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবধানতায় নাকি পাচারের ৯০ ভাগ অর্থ স্থানান্তরিত হতে পারেনি। যেটুকু পাচার হয়েছে সেটিও যে রিজার্ভ ব্যাংকের অসাবধানতায় সেটিও সম্ভবত বলা দরকার। তবে আমার মতে টাকা পাচারের চাইতে ভয়াবহ তথ্যটি সম্ভবত এই যে, ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য চুরি হয়েছে বা মুছে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন জানি যে, ফিলিপিন্সের সিনেট বিষয়টির তদন্ত করেছে। ফিলিপিন্স সরকার দেশটির ৪৮টি হিসাব জব্দ করেছে। নজরদারি, আটক ও রিমান্ড মিলে ফিলিপিন্স পুরো বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি। এটি বেশ মজার যে, দেশটির মিডিয়াই প্রথম দুনিয়াকে এই অপরাধের তথ্য জানায় এবং এখনও বাংলাদেশের মিডিয়ার খবরের উৎস ফিলিপিনো মিডিয়া। বাংলাদেশে খবরটি এক মাসেরও বেশি সময় গোপন রাখার পর সম্প্রতি কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বিষয়টিতে মামলা হয়েছে। র‌্যাব তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন ধারণা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা কেউ না কেউ জড়িত ছিল। ঘটনাটি লুকিয়ে রাখা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল না থাকা, দীর্ঘ সময়জুড়ে কোন পদক্ষেপ না নেয়া ইত্যাদি ছাড়াও প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার যন্ত্রে ইউএসবি পোর্ট ব্যবহার করার আলামত পাওয়ায় ঘটনাটির কেন্দ্র যে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি প্রায় নিশ্চিত হতে যাচ্ছে। এরই মাঝে তদন্ত কাজে যুক্ত থাকা জোহা অপহƒত হয়ে ফেরত এসেছেন এবং ভারতীয় বিশেষজ্ঞ নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে, ফিলিপিন্সের সিনেট বিষয়টির তদন্ত করলেও বাংলাদেশের সংসদ এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবেনি। যেভাবেই হোক একটি বড় ধরনের অপরাধের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি উপস্থাপিত হওয়ায় আমাদের সার্বিক বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের আইনগত কাঠামো, তদন্ত ও বিচারসহ সার্বিক বিষয়াদি খতিয়ে দেখতে হবে। ডিজিটাল চুরির দায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জনপ্রিয় গবর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ এখন অনেক পুরনো ঘটনা। নতুন গবর্নর নিয়োগ ও নাজনীন সুলতানাসহ দুজন ডেপুটি গবর্নরকে বরখাস্ত করাও বাসি হয়ে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। ব্যাংকের নানা পদে পরিবর্তন হয়েছে। তবে ভয়ঙ্করতম প্রশাসনিক দুর্বলতার বিবরণ জানা যাচ্ছে প্রতিদিন। মিডিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাকাররা প্রবেশ করে জানুয়ারিতে (কেউ বলেন ১৪, কেউ বলেন ২৪)। কেউ বলেন ১৪ তারিখে সফটওয়্যার ইন্সটল হয়েছে এবং ২৪ তারিখে সেই সফটওয়্যার রান করা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৬ রাত সাড়ে বারোটায় নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে এবং ৩৫টির মাঝে ৫টি নির্দেশনা কাজে লাগানো হয়েছে। এতেই ১০১ কোটি ডলার পাচার হয়ে যায়। বিষয়টিকে হ্যাকিং বলে চিহ্নিত করে ডিজিটাল অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে আমার নিজের মনে হয়েছে হ্যাকিং হোক বা না হোক এতে প্রচুর পরিমাণ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে। কোন ডিজিটাল নেটওয়ার্কে ম্যালওয়্যার বা হ্যাকিংয়ের সফটওয়্যার ১৫/২০ দিন বসবাস করার পরও তা শনাক্ত করতে না পারার নজির বিরল। কম্পিউটার রুমের সিসি ক্যামেরা বিকল থাকায় দেশীয় চক্রের জড়িত থাকার ইঙ্গিত প্রদান করে। ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি অবধি আমেরিকার কলে রেসপন্স করার জন্য কাউকে না পাওয়া পুরোটাই রহস্যজনক। এর সঙ্গে পুরো ঘটনাটি ৩৫ দিন গোপন রাখার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে পদত্যাগী গবর্নর বলেছেন, তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না ণ্ডে তারা কি করবেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি জানার পরপরই তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বলে বিদায়ী গবর্নর ড. আতিউর স্বীকার করেছেন। ‘এটা একটা সাইবার আক্রমণ। অনেকটা সন্ত্রাসী হামলার মতো। কোন্ দিকে আক্রমণ আসছিল আমরা বুঝতে পারছিলাম না। ওই একই সময়ে এটিএম বুথগুলোতেও আক্রমণ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপরেই নাকি আঘাত আনা হয়। এটা ছিল অনেকটা ভূমিকম্পের মতো। হয়ত কিছুক্ষণ পর আরও একটা আক্রমণ আসতে পারে।’ পদত্যাগী গবর্নর এই বিষয়ে ব্যাংক কি করেছে তা জানতে গিয়ে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হয়েছে। বিশেষ বাহিনী র‌্যাবকে ডেকে আনা হয়েছে। আর এসব করতে করতেই তাদের সময় চলে গেছে। মি. রহমান বলেছেন, ‘আমরা যদি আগেই এটা প্রকাশ করে দিতাম তাহলে হ্যাকাররা যে টাকাটা নিয়ে পালিয়েছিল সেটা ধরা পড়ত না।’ তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই তারা এই ঘটনা প্রকাশের ব্যাপারে কিছুটা সময় নিয়েছেন। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরেই সরকারকে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. রহমান। বিবিসির সঙ্গে দেয়া সাক্ষাৎকারটি থেকে এটি উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ স্তরেও ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা কাজ করছিল না। এখন তো দেখছি কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অনেক নামী-দামী বাণিজ্যিক ব্যাংকও অসহায়। এমনকি অসহায় সুইফট সিস্টেম। (চলবে) ঢাকা, ১৩ মে, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×