ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে যেসব সতর্কতা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১৫ মে ২০১৬

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে যেসব সতর্কতা প্রয়োজন

দেশের সব ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গত কয়েকদিনের একটি ভয়াবহ খবর হলো- ১২ ও ১৩ মে তারিখে আগের দিন ৫১ জন, পরের দিন ১৭ জনসহ সারাদেশে মোট ৬৮ জন বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছে। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক। যেসব জেলায় এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে- রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ২ জন, পাবনায় ৬ জন, কিশোরগঞ্জে ৪ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, নরসিংদীতে ৪ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ জন, নাটোরে ৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ১ জন, দিনাজপুরে ১ জন, হবিগঞ্জে ১ জন, নেত্রকোনায় ২ জন, পিরোজপুরে ১ জন, গাজীপুরে ২ জন, নওগাঁয় ৩ জন, সিরাজগঞ্জে ৫ জন, রাজবাড়ীতে ৫ জন, গাইবান্ধায় ২ জন, টাঙ্গাইলে ২ জন, সুনামগঞ্জে ২ জন, নড়াইলে ২ জন, জয়পুরহাট ৩ জন, যশোরে ২ জন ও মাগুরায় ১ জনসহ মোট ৬৮ জন। ১২ ও ১৩ মে তারিখ দুপুর থেকে শুরু করে রাত ন’টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসব আহত-নিহতের ঘটনা ঘটেছে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, কর্মজীবী, শিশু, নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিতসহ সকল ধরনের শ্রেণী-পেশার মানুষই রয়েছেন এসব মৃত্যুর মিছিলে। স্মরণাতীতকালে একদিনে বা দুইদিনে এত পরিমাণ মানুষ বজ্রপাতে মারা যেতে শোনা যায়নি। এটি নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক ও বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এ দুর্ঘটনা এখন রীতিমতো একটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এখন জানা দরকার কীভাবে হয় এসব বজ্রপাত। আবার কীভাবেই বা এ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই দেশে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, গত বছর (২০১৫) মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাস সময়ে দেশে বজ্রপাতে ১৮০ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। গবেষকরা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ বার বজ্রপাত সংঘটিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে প্রতি মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০ বার বজ্রপাত হয়। বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশকে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুন নতুন গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, বিশ্বে যে হারে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বজ্রপাতের হার বাড়বে বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও মেঘের প্লাবতা পরিমাপের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এ অবস্থায় বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেলে মানুষের হতাহত হওয়ার ঝুঁকি তো বাড়বেই, পাশাপাশি শুষ্ক বনাঞ্চলে দাবানলের আশঙ্কা আরও বাড়বে। তখন সেখানে শুধু মানুষ নয় পাখিসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা রকম প্রাণীর প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে আমাদের ঝুঁকি ও শঙ্কা সঙ্গত কারণেই বেশি। এ দেশে এমনিতেই আমরা বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, নদীভাঙ্গন, ঝড়, ভূমিকম্প মোকাবেলা করতেই হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর প্রাক-বর্ষা মৌসুমে এ বজ্রপাত আতঙ্ক আবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ঋতু পরিক্রমায় বর্ষকালেই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে থাকে। এলাকাভেদে গ্রামীণ পরিভাষায় এ বজ্রপাতকে ‘বাজ কিংবা ঠাটা’ বলা হয়ে থাকে। বর্ষাকালের মধ্যে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ-এ দুই মাস সবচেয়ে বেশি বাজ পড়তে দেখা যায়। আকাশ যখন ঘনকালো অন্ধকার হয়ে চারদিকে মেঘ ঢাকঢাক গুড়গুড় করতে দেখা যায় এবং বায়ুম-লে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এমনকি উর্ধাকাশে বায়ু চলাচল কম থাকলে, একটি গুমট আবহাওয়া সৃষ্টি হলে, সেখানে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। আকাশে থাকা চলন্ত মেঘরাশি যখন এদিকে ওদিকে চলাচল করতে থাকে তখন একটির সঙ্গে আরেকটি ধাক্কা বা ঘর্ষণ খেতে থাকে। এভাবে পাশাপাশি দুই বা ততোধিক মেঘের ধাক্কা খাওয়ার ঘর্ষণের ফলে সেস্থান বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। সেই বিদ্যুতের জন্যই আমরা আকাশে তাৎক্ষণিক আলো জ্বলতে দেখি। তখন সেটার দূরত্বের ওপর নির্ভর করে শব্দটা আমাদের কানে চলে আসে। কাছে হলে শব্দ আগে এবং দূরে হলে শব্দ অপেক্ষাকৃত বেশি সময় পরে শোনা যায়। কারণ আমরা জানি শব্দের গতির চেয়ে আলোর গতি অনেক বেশি, সে জন্য আলো দেখার অনেক পরে আমরা এর শব্দ শুনতে পাই। বজ্রপাতের সময় দেখা যাবে যে, বজ্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শব্দও চলে আসছে, তখন বুঝতে হবে বজ্রপাত খুব কাছের কোন স্থানে হচ্ছে। সে জন্য সবাইকে তখনই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এটিও একটি নিয়ন্ত্রণহীন দুর্যোগ। কাজেই এ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া হয়ত কখনই সম্ভব নয়। তারপরও কিছু বৈজ্ঞানিক সতর্কতামূলক পন্থা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করলে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যেতে পারে। ১. বর্ণিত গুমোট আবহাওয়ার দিনে পারতপক্ষে বাড়ি-ঘর থেকে বের না হওয়া। কারণ ঘরের ভেতরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এমন উদাহরণ খুবই কম। ২. প্রত্যেকের বাড়ি-ঘর বৈজ্ঞানিক উপায়ে বজ্রপাত প্রতিরোধী হিসেবে তৈরি করা। দুইভাবে বাড়ি-ঘরকে বজ্রপাত প্রতিরোধী করা যেতে পারে। ক. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিশেষ করে- ইস্ত্রি, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, এসি, মোবাইল সেট, ওভেনসহ ঘরের বিদ্যুত ব্যবস্থাকে সুরক্ষাকরণের জন্য ইলেক্ট্রিক্যাল আর্থিং করা খ. সুউচ্চ গগনচুম্বী দালানকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য পুরো দালানকে আর্থিং করা। ৩. খোলা আকাশের নিচে যে কোন উঁচু জিনিসের প্রতি বজ্রবিদ্যুতের চার্জ ডিসচার্জ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেখানে লম্বা গাছ (তাল, সুপারি), বিদ্যুত ও টেলিফোনের খাম্বা/খুঁটি, মোবাইল টাওয়ারসহ যে কোন ধরনের ধাতব এমনকি বিদ্যুত অপরিবাহী/কুপরিবাহী জিনিসই বজ্রের বিদ্যুতকে আকর্ষণ করে। সে জন্য বজ্রপাতের সময় এগুলোর নিচে থাকা যাবে না । ৪. খোলা আকাশের নিচে কিংবা খোলা মাঠে বজ্রপাতের সময় লম্বা শিক/লাঠিযুক্ত ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটা যাবে না, তাহলে ছাতার মাধ্যমে চার্জিত হতে পারে। ৫. খোলা আকাশের নিচে থাকলে বজ্রপাতের সময় সম্ভব হলে কোন আশপাশের ঘরে আশ্রয় নিতে হবে, না পারলে মাটিতে তাৎক্ষণিক শুয়ে পড়তে হবে। ৬. নৌকার মধ্যে থাকলে এর লম্বা ছই বা মাস্তুল থেকে দূরে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে ৭. বজ্রপাতের বিদ্যুত থেকে প্রায় ১০,০০০ এ্যাম্পিয়ার বিদ্যুত উৎপন্ন হয় এবং তা থেকে ৫০,০০০ কেলভিন তাপশক্তি রিলিজ হয় মাত্র শতভাগের এক ভাগ মিলি সেকেন্ড সময়ের মধ্যে। সে জন্যই বজ্রপাতে নিমিষেই বুঝে ওঠার আগেই মানুষের শরীর পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ৮. যেসব স্থানে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে দেখা গেছে যে, এগুলোর বেশিরভাগই নিম্নœ আয় ও খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। সে জন্য সরকারের তরফে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় হতে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আহতদের দ্রুত সুচিকিৎসা এবং নিহতের পরিবারের পাশে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে যেতে হবে অতি দ্রুত। ৯. এটিকে একটি দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সময় এসেছে এখন। কাজেই একে দুর্যোগ মেনে নিয়ে তদনুযায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে এবং ১০. সর্বোপরি অন্যান্য যে কোন সময়ের তুলনায় এ বর্ষা মৌসুমে উপরোক্ত সতর্কতাগুলো একটু গুরুত্বের সঙ্গে মেনে চলতে চেষ্টা করা। এসব সতর্কতা নিলেও দুর্ঘটনা ঘটবে না এমনটি বলা মুশকিল; তার পরও বিপদ থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি যার যার ধর্মমতে দোয়া-দরুদ, মন্ত্র-প্রার্থনার মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে হবে এবং তাঁর নিকটই জীবন সমর্পণ করতে হবে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×