ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নৌকা-গরুর গাড়ির বদলে বধূরা এখন ইজিবাইকে

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৪ মে ২০১৬

নৌকা-গরুর গাড়ির বদলে বধূরা এখন ইজিবাইকে

শ্যামল সবুজ উত্তর জনপদে বন বাগানে দোয়েল শ্যামা আর কোকিলের কুহু-কুহু ডাক আজও হারিয়ে যায়নি। সেই সঙ্গে হারায়নি মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিদের জন্য নাইওরের আমন্ত্রণ। আম, জাম, কাঁঠাল আর লিচুর সঙ্গে আছে মুড়ি দুধ কাঁঠাল ও পান্তা ভাতের সঙ্গে পাকা কাঁঠালের ভিন্ন স্বাদের খাবার। আছে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে পুঁটি মাছের ঝোল। ফল উৎসবের নাইওরে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে এখন আর গরুর গাড়ি নেই। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত রিক্সা ভ্যান, কেউবা ট্রেনে কেউবা বাসে করে ছুটে যায় নাইওরে। কাঠফাটা রোদ আর প্রাণ আইঢাই করা গরম। রোদের তাপে জ্যৈষ্ঠকে শুধুই নিন্দা দেয়ার কথা। কিন্তু ঘটনাটি উল্টো ঘটে বাহারী ফলের রসালো আয়োজন। বর্ণময় ফলের কোনটি গোল, কোনটিবা লম্বা, কোনটির গায়ে কাঁটা রয়েছে। মোহনীয় ঘ্রাণের এসব ফলের মিষ্টি-মধুর রসে পাগলপারা হয় মাছি-মৌমাছি। সঙ্গত কারণেই এদেশের রসনা বিলাসীসহ কবি-সাহিত্যিকদের ভাষায় জ্যৈষ্ঠের পোশাকী নাম মধুমাস। বৈশাখ বিদায় নিচ্ছে, রবিবার পহেলা জ্যৈষ্ঠ। মধ্যবয়সী গ্রীষ্ম বার্ধক্যের সিঁড়িতে পা রাখছে খর মধুর আমেজের মধ্য দিয়ে। তাপদাহের ধকল কাটিয়ে উঠতে, একটু স্বস্তি পেতে মানুষ গাছের ছায়ায় মাদুর পেতে শ্রান্ত-ঘর্মাক্ত দেহ এলিয়ে দেয়। দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল নদী-পুকুর কিংবা খাল-লেকের পানিতে স্বস্তি খোঁজে। এ মাসের বৈশিষ্ট্য হলো, একদিকে প্রকৃতি তেতে ওঠে, গরমে কাতর হয় প্রাণী। অন্যদিকে উদার প্রকৃতি মানুষের জন্য নানারকমের পসরা সাজিয়ে রাখে। জ্যৈষ্ঠের প্রকৃতি আগে-ভাগেই ডালি সাজিয়ে রেখেছে রসালো ও সুস্বাদু আম, লিচু, কাঁঠাল, কালো জাম, আনারস, করমচা, জামরুল, আতা, তরমুজ, ফুটি, বাঙ্গি, বেল, খেজুর ইত্যাদি দিয়ে। গ্রামীণ কৃষক বলি আর শহুরে নাগরিক, বাঙালীর কাছে এসব ফলের কদর ভিন্নমাত্রার। এখন ফলে ফলে ভরে আছে তরু শাখা থেকে বিপণি বিতান পর্যন্ত। উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে রংপুর বিভাগের আট জেলায় নাইওর হয় দুই ভাবে। একটি হয় জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে মেয়ে তার জামাই ও সন্তানদের নিয়ে ছোটে বাপের বাড়ি। অপরটি হয় ভাদ্র মাসে। ভাদ্র মাসের নাইওরের ভিন্নতা হলো প্রথম সপ্তাহে স্বামী-স্ত্রী পর¯পরের মুখ দেখবে না। উত্তর জনপদে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট এই ৯ জেলায় ভাদরকাটানি উৎসব চলে। আবহমান গ্রাম বাংলার চিরায়ত উৎসবের মতো স্বামীর মঙ্গল কামনায় পহেলা ভাদ্র হতে শুরু হয় ভাদর কাটানী উৎসব। দলে দলে বধূরা শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওরে বাপের বাড়ি যায়। এই এলাকার রীতি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের প্রথম ৩/৭ দিন স্বামী বধূর মুখ দর্শন করলে চোখ অন্ধ হয়ে যায়, স্বামীর অকল্যাণ হয়। তবে এর কোন প্রমাণ না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই এলাকার মানুষ এসব আচার-অনুষ্ঠান মেনে আসছে। মধুমাস জৈষ্ঠ্যের নাইওরে রয়েছে ফল উৎসব। এখানে মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি কিংবা পুতিদের বাড়ির গাছের টাটকা ফল খাওয়াতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় মেয়ের বাবা। শুধু যে ফলের আমন্ত্রণ তা নয়। সেই সঙ্গে নতুন বোরো ধানের গরম ভাত। সঙ্গে পুঁটি মাছের ঝোল। পিঠার উৎসবও হয়ে থাকে। শিশুরা নানার বাড়ি যাওয়ার জন্য উম্মাদ। Ñতাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×