ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়া নগরীর বিরল দুই বৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৪ মে ২০১৬

বগুড়া নগরীর বিরল দুই বৃক্ষ

সমুদ্র হক ॥ নগরীর শোভাবর্ধনকারী ও ঔষধি বিরল প্রজাতির দুই বৃক্ষ জয়তুন ও কর্পূর। মানব সৃষ্ট দুর্যোগে মহামূল্যবান বৃক্ষ দু’টি টিকবে কি না তা আগামী দিনগুলোই বলে দেবে। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে মাত্র দেড়শ’ মিটার পূর্বে ঐতিহ্যের নওয়াব প্যালেসের মধ্যে বিরল এই দুই বৃক্ষের অবস্থান। প্রায় দুইশ’ বছর আগে নওয়াব পরিবারের পূর্বসুরি বহুবর্ষজীবী দ্বিবীজপত্রী দীর্ঘ এই দুই বৃক্ষের চারা সংগ্রহ করেন ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। জয়তুন বৃক্ষের কথা পবিত্র কোরআন শরিফে বর্ণিত আছে। দেশ-বিদেশের পর্যটক বগুড়া সফরের সময় নওয়াব প্যালেসের ভেতরে অবস্থিত বৃক্ষ দু’টি দেখে বিস্মিত হতেন। কারণ এই জয়তুন ও কর্পূর বৃক্ষ সহজে চোখে পড়ে না। বগুড়ার ঐতিহ্যের সঙ্গে বৃক্ষ দু’টি সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। প্রশ্নবিদ্ধ দুই পক্ষের পাকে পড়ে বৃক্ষ দু’টির এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ । নওয়াব বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বগুড়ার যে ধনকুবেররা প্যালেসের অবকাঠামোসহ যে ১ দশমিক ৫৫ একর ভূমি কিনেছে এর মধ্যেই পড়েছে ওই দুই বৃক্ষ। আরেকদিকে বিক্রির পরই সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক আদেশে বগুড়ার ঐতিহ্যের এই নওয়াব বাড়ি সংরক্ষণ করেছে। যারা কিনেছে তারা ইতোমধ্যে ওই সম্পত্তি ক্রয় মূল্যে যাদের তাদের নাম লিখে একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছে। তারা বলেছে, এই বৃক্ষ কেটে সেখানে গড়ে তুলবে বহুতল কমপ্লেক্স। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সূত্র জানায় সরকারী নির্দেশ পাওয়ামাত্র তারা সংরক্ষিত এলাকায় সাইনবোর্ড দেবে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বিভাগীয় অফিসের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা সোমবার (৯ মে) এই প্রতিবেদককে জানান, সংরক্ষণ করার গেজেটের কপি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর হাতে পাওয়ার পরই নিয়মানুযায়ী পুরাকীর্তি সংরক্ষণের নীল রঙের নোটিস বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেবে। আশা করা হচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যে এই গেজেট নোটিফিকেশন চলে আসবে। তারপর অবকাঠামোসহ সরকার কতটুকু জায়গা সংরক্ষণ করবে তা নির্ধারণের পর ওই দুই বৃক্ষ সংরক্ষিত স্থানের মধ্যে পড়লে তাও সংরক্ষণ করা হবে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সূত্র জানায় যারা এই জায়গা কিনেছে তারা যত বড় সাইনবোর্ডই এঁটে দিক সংরক্ষিত এলাকার কোন কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না। দুই বৃক্ষ সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে তাও কাটা যাবে না। এই বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগত কোন জায়গার কোন বৃক্ষ কেটে ফেলা হলে তাদের কিছু করার নেই। তারা শুধু অনুরোধ করতে পারে। বিরল প্রজাতির বৃক্ষ হলে এবং তা রিজেনারেশন করার অবস্থা হলে বিশেষ ব্যবস্থায় সংগ্রহ করে কোন উদ্যানে অথবা নির্দিষ্ট কোন জায়গায় রোপণ করা যায়। আবার সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে এই গাছ থাকলে তা বন বিভাগ দেখভাল করার অধিকার রাখে এবং বৃক্ষ নিধন রোধ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত নওয়াব প্যালেসের বিরল এই বৃক্ষ দু’টির কি অবস্থা হবে এ নিয়ে বৃক্ষপ্রেমীরা চিন্তিত। বগুড়ার এই নওয়াব প্যালেস নিয়ে মানুষের কৗতূহলের অন্ত নেই। উল্লেখ করা যায় তদানীন্তন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর বাড়ি এই প্যালেস। তার চার পুরুষ আগের পূর্বসূরি বিদেশ থেকে জয়তুন ও কর্পূর বৃক্ষের চারা এনে রোপণ করেন। ওই পরিবারের পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি কেউই এই বৃক্ষ নিধন করেননি। তবে মোহাম্মদ আলীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দুই ছেলে হাম্মাদ আলী ও হামদে আলী নির্দয়ভাবে বৃক্ষসহ ভূমি বিক্রি করে দেয় গেল এপ্রিল মাসে। যা কিনে নেয় তিন বগুড়ার তিন ব্যবসায়ী। এই প্রতিবেদক তিন ক্রেতার একজন মাহমুদ হাসান জুয়েলের সঙ্গে বৃক্ষ রক্ষা করা হবে কি না জানতে চাইলে বলেন ‘বৃক্ষ রক্ষা পরের বিষয়। বহুতল ভবন হলে বৃক্ষ থাকবে কি করে! তা ছাড়া তিন ক্রেতা একমত না হলে তো গাছ কেটেই ফেলতে হবে।’ আরেকদিকে মোহাম্মদ আলীর দ্বিতীয় পক্ষের লেবাননী স্ত্রীর ছেলে মেয়ে মাহমুদ আলী ও মাহমুদা বেগমসহ তাদের ভাইপোরা বৃক্ষসহ প্যালেস রক্ষায় অবস্থান নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বগুড়ার সর্বস্তরের মানুষ। সকলেই চায় বৃক্ষসহ এই প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা হোক। এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক জানান, ঐতিহ্যের কোন স্থাপনা বিক্রি হওয়ার পরও সরকার ইচ্ছে করলে তা অধিগ্রহণ করতে পারে। ইতোমধ্যে সরকার বগুড়ার ঐতিহ্যের এই স্থাপনা সংরক্ষিত করার আদেশ দিয়েছে। বিরল এই বৃক্ষ দু’টি সম্পর্কে বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আজিজ জানান, কর্পূর বৃক্ষটি সিনামৌনা গোত্রের। যার বিজ্ঞান নাম ক্যানথোরা। পাতা থেকে রস সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যবস্থায় পাপল করলে ক্রিস্টাল বা স্ফটিক আকারে মেলে। চীন জাপানসহ বিশ্বের নানা দেশে কর্পূর উপকারী ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিরল প্রজাতির জয়তুন গাছের গোত্র ডায়রোটার্টা। এই বৃক্ষের অরিজিন দক্ষিণ আমেরিকা। উঁচু এই বৃক্ষের কথা পবিত্র কোরআন শরিফে বর্ণিত আছে।
×