ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নভেরা চৌধুরী

গল্প ॥ বোধ

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ মে ২০১৬

গল্প ॥ বোধ

ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলছে। এইমাত্র ‘গুণবতী’ স্টেশন ক্রস হলো। কি অদ্ভুত জায়গাটার নাম! গুণবতী। যেন এই দেশে গুণ বলতে যা বোঝায় তা শুধু এই অঞ্চলের মেয়েদেরই আছে। আর কারো নেই। জানালার উপরের কাঠে লেখাÑ ‘গাড়ি থামাইতে শিকল টানুন অযথা টানিলে ২০০ টাকা দ-’ দু’শ’ টাকা কেন, দু’ লাখ টাকা হলেও নীলা পারলে এখনই চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে ফেলে। তার রীতিমতো অসহ্য লাগছে। ভোরের আলো ফুটে চারপাশে চকোলেটের রাংতার মতো ঝিকমিক করে রোদ ওঠা, পেছনে পড়ে যাওয়া গাছপালা, ছোট বড় নানান স্টেশন, লাকসামে এসে হুট করে নতুন ইঞ্জিন লেগে উল্টো দিকে চলা, সকালের নাস্তা, কানের কাছে রবিন ভাইয়ের বক-বকানি কোন কিছুই তার ভাল লাগেনি। বার বার খালি রফিকের কথাই মনে হয়েছে। কি হতো সঙ্গে এলে? স্টেশনে যখন এগিয়ে দিতে এসেছে, নীলা আবারও অনুনয়-বিনয় করে বলেছে, ‘প্লিজ, চলো। প্লিজ।’ নীলাকে অবাক করে দিয়ে রফিক গম্ভীর মুখে বলেছে, ‘আমি যেতে পারব না। আমার প্ল্যান আছে।’ ‘প্ল্যান আছে মানে? কিসের প্ল্যান?’ রফিক তখন আচমকা থতমত খেয়ে উত্তর দিয়েছে, ‘না, মানে আমার ক্লাস আছে। ‘এই বলে সে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। ইদানীং কি হয়েছে রফিকের? প্রায় মাসখানেক ধরেই নীলা লক্ষ্য করছে রফিক যেন কেমন বদলে গেছে। সারাক্ষণই কিছু একটা নিয়ে ভাবে। বিড় বিড় করে, কাগজে-কলমে কি সব যেন লিখে আর প্রচ- মেজাজ খারাপ করে থাকে। কিছু জানতে চাইলে বলে, ‘কিছু না। কিছু না। যাও এখান থেকে।’ ট্রেন যখন ছেড়ে দিয়েছে, তখন একটা অদ্ভুত কা- ঘটল। রফিক হঠাৎ ট্রেনের সাথে দৌড়াতে শুরু করল আর চিৎকার করে হাত নেড়ে নেড়ে কি সব যেন বলতে লাগল।ট্রেনের শব্দে নীলা কিছুই বুঝতে পারল না। এরপর থেকে সে কিছুক্ষণ পর পর রফিককে ফোন করেই যাচ্ছে। রফিকের ফোন বন্ধ। কোন মানে হয়? ‘নীলা, আমার মনে হয় তুমি খামাখা এত টেনশন করছ। আসলে টেনশন করার কোন কারণ নেই। ‘কেন আপনার এ রকম মনে হচ্ছে?’ ‘মনে হচ্ছে। কারণ, আমি জানি এরপর কি হবে।’ ‘কি হবে?’ ‘কি আবার? গিয়ে দেখব, আমাদের আগেই রফিক চিটাগাং গিয়ে বসে থাকবে। তারপর তোমাকে নিয়ে বিকেলের ট্রেনে ব্যাক করে চলে আসবে। গত মাসে কি করল মনে নেই? অনুর বিয়ের অনুষ্ঠানে সাত দিনের ছুটি নিয়ে গিয়ে বিয়ের রাতেই তোমাকে নিয়ে চলে গেল।’ ‘রবিন ভাই, আমার মনে হয় ও ইদানীং কোন একটা ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।’ ‘নীলা, কথাটা একটু ভুল বললে। ইদানীং না, বিয়ের প্রথম থেকেই ওর মধ্যে সমস্যা ছিল। আমি ধঃ ষবধংঃ সেটা লক্ষ্য করেছি। আর সমস্যাটা যে আমাকে আর তোমাকে নিয়ে সেটা তো তুমি জানোই।’ ‘ঠাট্টা করছেন?’ ‘একদম না। তুমি আজকের ঘটনাটা চিন্তা কর। স্টেশনে এসেছে, আমার সাথে একটাও কথা বলে নাই। রাগের চোটে তোমার সাথে পর্যন্ত উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো। একবার বলে প্ল্যান আছে, একবার বলে ক্লাস আছে। এখন ফোন বন্ধ।’ ‘রবিন ভাই, আমিও ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবছি, জানেন তো? আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়? কিসের প্ল্যান হতে পারে, বলেন তো?’ ‘যে চেহারা করে রেখেছিল, তাতে তো মনে হয় কাউকে খুন করার মতলব আঁটছে। হা... হা... হা!’ রবিন সমানে হেসে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর সব কথা বলে কাউকে ঘাবড়ে দেয়া, রবিনের এই বাতিকের সঙ্গে নীলা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। তাই সে কখনো চমকায় না। কিন্তু আজ সে চমকালো। ভালমতোই চমকালো। কথাটা শোনামাত্র কোন এক অজানা বিচিত্র ভয়ে তার হাত-পা ঠা-া হয়ে গেল। সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রবিনের মুখের দিকে। দুই রফিক কোথাও যায়নি। কলেজ থেকে মোটামুটি লম্বা ছুটি নিয়ে গত তিন দিন ধরে সে বাসাতেই আছে। চিটাগাং রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত সে অবশ্যি নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। মাথা গরম করে আর কোন বোকামি সে করতে চায় না। নীলা মার বাড়ি বেড়াচ্ছে, বেড়াক না। আর তো বেড়ানোর সুযোগ পাবে না। বরং ভালই হয়েছে। এই ক’দিন নিশ্চিন্তে প্ল্যান-প্রোগম করা যাবে। ফাঁকা বাড়ি। কেউ সন্দেহ করবে না। তাছাড়া, জলজ্যান্ত একটা মানুষকে সরিয়ে দেয়া তো সহজ ব্যাপার না। কয়েকটা প্ল্যান রফিক ইতোমধ্যে ঠিক করে ফেলেছে। তবে প্রত্যেকটা প্ল্যানের মধ্যেই একটা না একটা খটকা লেগে আছে। তাই আরও ভালমতো চিন্তা-ভাবনা করে যে কোন একদিক থেকে এগুতে হবে। যেমন ধরা যাক, বিষের কথা। এমন কিছু চড়রংড়হ এর নাম রফিকের জানা আছে যেগুলোর যে কোন একটা দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে একটা লোককে মেরে ফেলা যাবে। শেষ মুহূর্তে হসপিটালে নিয়েও কিছু করার আশা থাকবে না। এই ধরনের চড়রংড়হ সম্পর্কে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। নীলার ক্ষেত্রে তো নয়ই। কারণ, নীলা বাংলার ছাত্রী। কাজেই স্বভাবতই ভিসেরা পরীক্ষার পর কেমিস্ট্রির একজন লেকচারার হিসেবে সন্দেহটা রফিকের দিকেই আসবে। আর যেন-তেন ধরনের বিষ, যেমনÑ ইঁদুর মারার বিষ র‌্যাটম বা এই ধরনের বিষ এ বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই মুহূর্তে ছোট্ট একটা ভুলও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। রফিকের মতো একজন ঠা-া মাথার মানুষের পক্ষে কিছুতেই ভুল করা উচিত হবে না। ভুল যদি করার হতো, তাহলে রফিক সেটা অনেক আগেই করতে পারত। কলেজ থেকে বাসায় ফিরে রফিক প্রায় সময়ই দেখতো রবিন বসার ঘরে বসে আছে। নীলার সঙ্গে কি নিয়ে যেন গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। রফিককে দেখামাত্র তারা দুজনই থেমে যেত। কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করতো। প্রথম দিকে এরকম পরিস্থিতিতে রফিকের মাথায় রক্ত উঠে যেত। ইচ্ছা করত তক্ষুণি গিয়ে ওই রবিনের গলা চেপে ধরতে। কিন্তু রফিক তা করেনি। সে মাথা ঠা-া রেখেছে। এতেই শেষ নয়। কি দিন, কি রাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীলা যখন রবিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গেছে, রফিক তখন গলা কাটা মোরগের মতো ছটফট করেছে। এসব ঘটনা তো একদিন দুদিনের নয়। বিয়ের পর থেকে শুরু করে তাদের বিবাহিত জীবনের তিন তিনটা করে বলতে গেলে এভাবেই কেটেছে। বিয়ের প্রথম বছর নীলার চাচাত ভাই রবিন মাঝে মাঝে এলেও দ্বিতীয় বছর থেকে আসা যাওয়াটা এক রকম বেড়েই যায়। গত কয় মাস ধরে তো ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতোই ছিল। রবিন কেন ঘন ঘন বাসায় আসে, কিসের এত ফোনে কথা, কেন এত লুকোচুরিÑ রফিক অনেকবার নীলার কাছ থেকে সেগুলো জানার চেষ্টা করেছে। কোন সদুত্তর পায়নি। সবকিছু মিলিয়ে এক পর্যায়ে রফিকের সন্দেহ হলো, নীলা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর সত্যিই এমন কিছু হলে তাকে আটকানোর ক্ষমতা রফিকের নেই। তখন মাঝে মাঝেই মনে হতো, হাতের কাছের বঁটিটা দিয়ে এক কোপে নীলাকে শেষ করে দিতে। কখনো মনে হয়েছে চৌবাচ্চার পানিতে ডুবিয়ে মারে। কখনো আবার ইচ্ছা হয়েছে পুরো বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে দেই আগুন ধরিয়ে। সে সবের কোন কিছুই রফিক করেনি। মাথা সে ঠা-াই রেখেছে। চুপচাপ সবকিছু দেখে গেছে। একবারে নয়, অনেকদিনের হিসাব-নিকাশের পর অবশেষে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে বাধ্য হয়েছে। নীলাকে খুন করে নিজের কাছে আটকে ফেলার যে প্ল্যান রফিক সাজিয়েছে, তার হিসাবেও সে কোন ফাঁক-ফোকর রাখতে চায় না। সবকিছু আঁটঘাট বেঁধে তবেই সে মাঠে নামবে। প্রায় এগারো দিন পর আজ নীলা বাড়ি ফিরছে। সকাল থেকে তাই রফিক উত্তেজনায় ছটফট করছে। সমস্ত বাড়ি রফিক যতœ করে ধুয়ে মুছে সাফ করল। এতদিন সে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনেছে। আজ নীলার পছন্দের বেশ কয়েকটা আইটেম রান্না করে ফেললো। নীলা নিশ্চয়ই এসব দেখে খুব চমকে যাবে। বিকালের ট্রেনে রওনা হয়ে নীলার রাত্রে এসে পৌঁছানোর কথা। দুপুর সাড়ে তিনটার মধ্যে নীলা এসে উপস্থিত। তার সঙ্গে রবিন। সাজানো-গোছানো বাড়ি দেখে নীলা যতটা চমকালো, নীলাকে দেখে রফিক ঠিক ততটাই চমকালো। নীলা বেশ উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো, ‘সারপ্রাইজ! কেমন চমকে দিলাম।’ রফিক হাসিমুখে বললো, ‘ভালোই চমকেছো।’ ‘কি হয়েছে শোনো, আমার তো বিকালের ট্রেনে একা আসার কথা। পরে মা বলল, একা যাবি কেন, রবিন তোকে দিয়ে আসবে। কিন্তু রবিন ভাইয়ের জন্য তো টিকেটই কাটা হয়নি। তখন রবিন ভাই বলে কি, চলো নীলা। আমরা বরং বাসে চলে যাই। সকাল সকাল রওনা দিলে দুপুরেই পৌঁছে যাব। রফিককেও একটা সারপ্রাইজ দেয়া হবে। অতএব, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার প্ল্যান রবিন ভাইয়ের। উনাকে থ্যাংকস দাও।’ নীলার এই এক স্বভাব। সবকিছুতে খালি রবিন ভাই আর রবিন ভাই। আছে কি ওই রবিনের? সামান্য বিএ পাস, চাকরি-বাকরি নাই, বাপ-মা মরা ছেলে, খালার কাছে মানুষ। বিয়ে-থা করেনি। এক কথায় ভাগ্যাবন্ড ক্যারেক্টার। বলতে গেলে যার কোন যোগ্যতাই নেই। অথচ নীলার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় রবিন হলো সুপারম্যানের চেয়েও বেশি কিছু। যে কোন সমস্যার সমাধানে রফিক নয়, রবিনই হলো নীলার কাছে মানুষ। রাগে রফিকের গা জ্বলে যাচ্ছে। রবিন রফিকের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। রফিকের ইচ্ছা করছে রবিনের গালে ঠাস করে একটা চড় দিতে। তা না করে রফিকও রবিনের দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসল। রাত আটটার দিকে রবিন বিদায় হলে রফিক মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক বাবা, বাঁচা গেছে। সেই রাতেই নীলা ঘুমিয়ে পড়ার পর রফিক অনেকক্ষণ পর্যন্ত বারান্দায় জেগে বসে থাকলো এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে, আগামী মঙ্গলবার রাতে সে খুনটা করবে। তিন মঙ্গলবার। সপ্তাহের এই দিনটা ছোটবেলা থেকেই রফিকের জন্য খঁপশু ফধু। এই দিনে করা কোন কাজে তার কখনও ভুল হয়নি। আজও ভুল হবে না। মঙ্গলে মঙ্গল হবে। বিশেষ করে আজকের মঙ্গলবার হবে তার জীবনের সব থেকে ঝঢ়বপরধষ ফধু। রফিক খেয়াল করে দেখল, আজ তার নার্ভও অন্যদিনের তুলনায় বেশ শক্ত আছে। মাথাও অনেক ঠা-া, অন্যান্য দিনের মতো চাপ নেই। বেশ ফুরফুরে লাগছে। নীলার জন্য রফিকের ভালোবাসার কখনোই কমতি ছিলো না। আজ যেন আরও বেশি করে মায়া লাগছে। রফিক ঠিক করে ফেলল, আজকে সে নীলার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করবে। তাকে কোন দুঃখ দেবে না। তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুবে। অনেকদিন পর রিকশা করে ঘুরবে, খুব গল্প করবে। রাতে ডিনার শেষে তারপরে বাসায় ফিরবে। শত হোক, নীলার জন্য আজকের রাতটাই শেষ রাত। আর তো ফিরে আসবে না। আহা বেচারি! নীলার জন্য রফিকের সত্যি সত্যি চোখে পানি এসে গেল। নীলাকে নিয়ে রফিকের বেড়াতে বেরুনো হলো না। দুপুরের পর রফিক যখন নীলাকে বলল, ‘অনেক দিন আমাদের রিকশা ভ্রমণ হয় না। চলো, আজ বিকালের দিকে বেরুলে কেমন হয়?’ তখন নীলা কেমন যেন চাপা গলায় উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। তুমি যাও। ঘুরেটুরে এসো। ভল লাগবে।’ কি ব্যাপার! এরকম কাটা-কাটা ভাবে তো নীলা কখনো কথা বলে না। হয়েছে কি নীলার? রফিক লক্ষ্য করল নীলার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। সে ভুঁরু কুঁকচে জিজ্ঞেস করলো, ‘এভাবে কথা বলছো কেন? শরীর খারাপ?’ ‘শরীর ঠিক আছে।’ ‘তাহলে এরকম করছো কেন?’ ‘শোনো, আমি যাচ্ছি না। রবিন ভাই আসছে, তাই। ফোন করেছি। এখন রাস্তায় আছে।’ ‘কেন আসছে রবিন?’ ‘দরকার আছে।’ ‘কি দরকার?’ ‘আছে। জরুরি দরকার।’ নীলার কথা-বার্তার ধরনটা রফিকের একদম ভালো লাগছে না। সে কি মনে মনে কিছু আঁচ করতে পারছে! তীব্র শীতল একটি স্রোত রফিকের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। তার মনে হলো, কিছু একটা অবশ্যই ঘটতে চলেছে। সেই কিছু একটা কি? রফিক ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি দরকার? আমাকে বলা যায় না?’ ‘সময় হোক। বলবো।’ ‘কখন তোমার সময় হবে?’ ‘উফ! কেন এত প্রশ্ন করছো? আমার প্রচ- মাথা ধরেছে। তুমি প্লিজ একটু চুপ করবে?’ মুহূর্তেই রফিকের মাথার ভিতর কিছু একটা হয়ে গেল। তার মনে হলো, কেউ যেন তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘তা তো ধরবেই। আমার কতা শুনলে তো তোমার মাথাই ধরে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা যখন রবিনের সঙ্গে কথা বলো, কই? তখন তো তোমার মাথা ধরে না...’ নীলা হতভম্ভ হয়ে রফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁট কাঁপছে। করছে কি রফিক! পাগল হয়ে গেল নাকি? আর একটু হলেই তো ধরা পড়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই রফিক চট করে নিজেকে সামলে নিলো। নীলা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হতভম্ভ ভাব এখনো কাটেনি। এই কিছুক্ষণ আগে রফিক যে আচরণটা করে গেছে, সে ভেবে পাচ্ছে না, রফিক কিভাবে তার সঙ্গে এরকম আচরণ করতে পারে। যে রফিক তার সঙ্গে কখনো উঁচু গলায় একটা কথা বলেনি পর্যন্ত। আচ্ছা! রফিক কি কিছু আন্দাজ করতে পারছে? আজকের ঘটনাটা সে কোনোভাবে জেনে ফেলেনি তো! না... তা কি করে সম্ভব? নীলার মনে হলো সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারপরেও নীলার খুব টেনশন হতে লাগলো। সে বুঝতে পারছে না, রবিনকে ফোন করে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আকাশ কালো করে প্রচ- ঝড়ো বাতাস বইতে লাগলো। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙে নামলো বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। রফিক বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে সমানে তার গায়ে লাগছে। তাতে তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে কোনো রকম উনিশ-বিশ হচ্ছে না। নীলা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আকাশের অবস্থা দেখে গেছে। তাকে বড় বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে। একটু পর পর রবিনকে ফোন করছে। সম্ভবত তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। না পাওয়া গেলেই ভাল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রফিকের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। সে বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লো। তার মাথার দু’পাশের শিরা দপদপ করছে। একটু যেন শীতও লাছে। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বর এসে পড়বে। সন্ধ্যার পর পরই রবিন এসে উপস্থিত। বারান্দায় রফিককে দেখা সত্ত্বেও সে এসেই হাত ধরে টেনে নীলাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। সামনাসামনি এতটা স্পর্ধা! রফিকের কল্পনার ধারে কাছেও ছি না অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটি তার চোখের সামনেই ঘটেছে তবু স্বীকার করতে পারছে না। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। পায়ের তালু থেকে মাথার তালু পর্যন্ত সব জ্বলে যাচ্ছে। ভিতরে কি হচ্ছে, দেখা দরকার। রফিক চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ল। তার পেটের ভেতর কেমন যে দলা পাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে নাড়ীভুঁড়ি যেন উঠে আসতে চাইছে। বমি করতে পারলে ভাল হতো। রফিক ভেবে পেল না, হঠাৎ করে শরীর এতটা খারাপ লাগছে কেন? বৃষ্টিতে ভিজার কারণেই হবে হয়ত। সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত নেমেছে বেশ খানিকক্ষণ। বৃষ্টির বেগ মাঝখানে কিছু কমেছিলো, এখন আবার বাড়ছে। রফিক তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। নীলা, রবিন কি কথা বলছে, বেশির ভাগই বোঝা যাচ্ছে না। তবু ভাসা-ভাসা যেটুকু তার কানে আসছে, তাতে সে তার নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কি বলছে নীলা? ওই তো, ‘কাজী অফিস, ‘কাজী অফিস’ করে কি একটা যেন বলল। তার পর পরই রবিন বলল, ‘তুমিই যদি না যাও, তাহলে আর লাভ হলো কি?’ রফিক শোনার চেষ্টা করছে। নীলা বলছে ‘যাবো না, একবারও তো বলিনি। আপনিই তো দেরি করলেন। আর এখন মাঝখান থেকে...’ উত্তরে রবিন কি বলল শোনা গেল না। আবার নীলা কথা শোনা যাচ্ছে, ‘এতদিন ধরে এতকিছু করলাম কার জন্য? আপনার জন্যই তো?’ রবিন বলছে, ‘কি করব? ট্রেন লেট করল। এমন হবে জানলে বাসে আসতাম।’ পরবর্তী কয়েক মিনিট কিছুই শোনা গেল না। তারপর আবার রবিনের কথা শোনা যেতে লাগল। ‘আর একটু কষ্ট কর, প্লিজ। শুধু আজকের রাতটা। আমার জন্য এই রিস্কটুকু...’ ‘রবিন ভাই, শুধু এই রিস্ক না। আপনার জন্য আমি এর থেকেও বড় রিস্ক নিতে পারি। আর সেটা আপনি ভালই জানেন। কি, জানেন না?’ ‘জানি নীলা। সব জানি আমি।’ এটা কি করল নীলা! রফিকের সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে আজকে রাতেই সে চলে যাচ্ছে রবিনের হাত ধরে! ক্রমেই রফিকের মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে। সেই সঙ্গে হু হু করে গায়ের তাপ বাড়ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে শক্ত রাখতে। পারছে না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব। এ রকম শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণ কি? তার তো কোন কালেও শ্বাসকষ্ট ছিল না। নাকি ছিল? রফিক মনে করতে পারল না। অতীত বর্তমান সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রফিকের মনে হচ্ছে, তার পৃথিবীটা যেন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। সব আলো মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। ছোট্ট একটা বৃত্ত, যে বৃত্তের ভেতর সে আটকে ফেলতে চেয়েছিলো নীলাকে। আজকে সেই বৃত্তের ভেতর সে নিজেই আটকা পড়েছে। বেরিয়ে আসার কেন পথ নেই। বৃষ্টির বেগ সমানে বাড়ছে। রফিক পড়ে আছে চেয়ারে। উঠে দাঁড়ানোর এতটুকু শক্তি তার নেই। সে রীতিমতো ঠক্্ঠক্্ করে কাঁপছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, শীত যেন তার হাড়ের ভেতর গিয়ে ঢুকছে। রফিকের শ্বাসকষ্ট আরও বাড়ল। এত বাতাস পৃথিবীতে অথচ সে তার ফুসফুস ভরাবার জন্য যথেষ্ট বাতাস যেন পাচ্ছে না। রফিক বিড়বিড় করে বললো, ‘নীলা’ পাশে এসে বসো। হাত রাখো আমার বুকে।’ বলেই শব্দ করে বমি করল। আর তার পর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। নীলা বসে আছে রফিকের মাথার কাছে। এই কিছুক্ষণ আগেও সে খুব কান্নাকাটি করছিল। এখন অবশ্যি করছে না। তবে একটু পর পর চমকে চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে ঘটনার আকস্মিকতা সে এখনও সামলে উঠতে পারেনি এবং খুব সম্ভব সে আরও একবার কেঁদে ফেলবে। হঠাৎ করে রফিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় রবিনের সঙ্গে যেতে না পারার কারণে নীলার যতটা না কষ্ট হয়েছে, তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে রফিকের জন্য। রবিনের সঙ্গে তার যত বড় কাজই থাকুক না কেন, দুনিয়া ছারে-খারে গেলেও রফিককে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া তার পক্ষে কখনই সম্ভব হতো না। রফিক কিভাবে অসহায়ের মতো বারান্দায় চেয়ারে পড়েছিল, কিভাবে রবিনসহ টানাটানি করে তাকে ঘরে আনা হয়েছে, সে দৃশ্য এখনও নীলার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সে ক্রমাগত রফিকের মাথা জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিকে গভীর নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। তবু নীলা আরও একবার চমকে উঠে রফিকের মাথায় হাত রাখল। তার চোখ ভিজে উঠছে। সে আস্তে আস্তে বলতে লাগল, ‘চোখ খোল। প্লিজ, চোখ খোল। তাকাও একবার।’ চার মঙ্গল-অমঙ্গল হয়নি। শেষ পর্যন্ত জ্বর গায়ে নিয়েও যথেষ্ট ঠা-া মাথায় রফিক কাজটি শেষ করেছে। সব মিলিয়ে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় লেগেছে এবং সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতেই কাজটি হয়ে গেছে। রাত আনুমানিক পৌনে একটার দিকে রফিকের জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখতে পায় নীলা তার পাশেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঠিক তখনই রফিকের মনে হয়েছে এটাই সুযোগ। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে এবং রফিক তাই করেছে। ঘুমন্ত নীলার মুখের ওপর শক্ত হাতে বালিশ চেপে ধরেছে। ব্যাস... এখন রাত দেড়টা। রফিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে। নীল শাড়িতে নীলাকে নীল পরীর মতো লাগছে। সে উঠে গিয়ে নীলার কপালের ওপর কয়েকটা চুল এনে দিল। এখন আরও বেশি সুন্দর লাগছে। হঠাৎ রফিকের মনে পড়ল, তার হাতে এখনও অনেক কাজ বাকি। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মেঘ কেটে গিয়ে খুব সুন্দর চাঁদের আলো হয়েছে। পূর্ণিমার বোধহয় বেশি বাকি নেই। নীলা হলে বলতে পারত আর কতদিন পর পূর্ণিমা। এসব হিসাব সে সব সময় রাখে। গায়ের জ্বর কমেছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য রফিক একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে ভাল লাগছে। তার মানে জ্বর তেমন নেই। রফিক মনে মনে ভাবতে লাগল, এ অঞ্চলে মোটামুটি নির্জন একটা জঙ্গলে জায়গা আছে। তাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক। নীরার বডিটা ওখানে নিয়ে মাটিচাপা দেয়া যেত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইদানীং এ অঞ্চলে শিয়ালের উপদ্রব বেড়েছে। শিয়াল যদি লাশের সন্ধান পায় এবং লাশ মুখে নিয়ে বেরিয়ে আসে তাহলে আম, ছালা সব যাবে। তাই অন্য পদ্ধতিতে যেতে হবে। আর তাছাড়া রফিক এত ভাবছে কেন? তার তো সবকিছু ঠিক করাই আছে। সে হাতের আধ খাওয়া সিগারেটটা দুরে ছুড়ে ফেলল। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। আর মাত্র দুই তিন ঘণ্টা সময় হাতে আছে। যা করার এক্ষুণি শুরু করতে হবে। নীলার ফোন বাজছে। রফিক ঘরে ফিরে এসে ফোন হাতে নিল। রবিনের ফোন। তার পরই হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধিটা এলো। সে ফোন কেটে দিয়ে একটা মেসেজ লিখল। মেসেজটি এ রকম রবিন ভাই, আগামী কয়েকদিনের বাসায় আসবেন না। খুব ঝামেলায় আছি। পরে কথা হবে। মেসেজটি রবিনকে পাঠিয়ে রফিক ফোনটা বন্ধ করে দিল। মনে মনে হাসল। ভালই হয়েছে এই ক’দিন রবিন না এলে নীলার ব্যাপারটাও চাপা থাকল, ভাবতে ভাবতে রফিক আরও একবার মুগ্ধ চোখে নীলার দিকে তাকাল। আচ্ছা লাইটা অফ করে দেখা যাক, চাঁদের আলোয় নীলাকে কেমন লাগে? রফিক লাইট অব করে নীলার কাছে এসে বলল। তারপর বলতে লাগল, ‘আমি যা করেছি, একদম ঠিক করেছি। কোন ভুল আমি করিনি। কি বলছি, বুঝতে পারছ নীলা? তোমার মতো একজন রূপবতী মেয়েকে আমি ধরে রাখতে পারব না, এই ভয় আমার সব সময় ছিল। যখনই তোমার পাশে রবিনকে দেখতাম, নিজেকে অযোগ্য মনে হতো। কষ্ট হতো। রাগ হতো। একই সাথে প্যারালালভাবে তুমি দুটো সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলে, এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা ছিল না। তাই তোমাকে মেরে ফেলেছি। আর তার ওপর, সে আজকে যে অন্যায়টা করেছ, তার জন্য আমি এখনও তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি না। এখনও আমার রাগ হচ্ছে! অল্প রাগ না। বেশি রাগ। রবিনকে লুকিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে বলে তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, অনেক বড় ভুল করেছ। সময় খুব দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। রফিক নীলার হাত ছেড়ে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বাতি জ্বালাল। ঘড়ি দেখল। তিনটা বেজে গেছে প্রায়। অথচ এখনও কিছুই করা হয়নি। যতবারই নীলার দিকে চোখ পড়ছে ততবারই সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। একবার নীলার হাত ধরে বসে পড়লে তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এভাবে তো শেষটায় সব প্লান প্রোগ্রাম ভেস্তে যাবে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করতে হবে। তবে তার আগে একটা বড় চাদর দিয়ে নীলাকে ঢেকে ফেলতে হবে যাতে আর তার দিকে চোখ না যায়। আলমারিতে চাদর খুঁজতে গিয়ে একটা খুব অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি এসে পড়ল রফিকের হাতে। আর ডায়েরি এটা? নীলার? নীলার ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল নাকি? কখনও বলেনি তো! অবশ্যি কত কিছুই তো নীলা বলেনি। রফিক ডায়েরির পাতা ওল্টাতে লাগল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নীলা নিয়মিত লিখত না। হাতেগোনা কয়েক পাতা লিখেছে মাত্র। সব লেখাই খুব ছোট ছোট। কোন লেখা দু’তিন লাইনের মধ্যেই শেষ আবার কোনটা খুব বেশি হলে দশ-পনেরো লাইন। যেমন এক জায়গায় লেখাÑ দেখতে দেখতে তিন বছর সময় কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি রবিন ভাইয়ের। সেদিন যখন বললাম একটা কিছু করেন, রবিন ভাই। অন্তত ছোট একটা চাকরি হওে যোগাড় করেন। এভাবে তো সংসার চালাতে পারবেন না। শেষটায় দেখা যাবে, সংসারের স্বপ্ন আপনার স্বপ্নই থেকে যাবে। শুনে রবিন ভাই আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমার খুব মায়া হলো। বেচারার ভাগ্যটা আসলেই খারাপ। কত জায়গায় কত চেষ্টা করলেন। কিছুই করতে পারলেন না। আবার সেই রবিন ভাই! বিরক্তিকে রফিকের ভ্রু কুচকে উঠল। আরেক পাতার লেখাÑ কাল রাতেও বেশ কয়েকবার রবিন ভাই আমাকে ফোন করেছেন। এই মুহূর্তে রবিন ভাই যতটা টেনশনে আছেন, আমিও ঠিক ততটাই টেনশনে আছি। কি হবে বুঝতে পারছি না। রফিক সবকিছু জানার পর কি করবে তাও বুঝতে পারছি না। এদিকে সময়ও খুব দ্রুত কমে আসছে। রফিক মনে মনে হাসল। তার তো সবকিছু জানা হয়েই গেছে। জানার কি আর কিছু বাকি আছে? আবার একটি পাতায় নীলা লিখেছেÑ আজ একটা খুব অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। রফিক বিকেল বেলা বাসায় এসে আমার হাতে একটা প্যাকেট দিল। খুলে দেখি এক ডজন চুড়ি। টকটকে লাল এবং গাঢ় কচু পাতা রঙের চুড়িগুলো কি যে সুন্দর! আমি হাত ভর্তি চুড়ি পরতে ভালবাসি, রফিকের সেটা ঠিক মনে রেখেছে। কিন্তু পরতে গিয়ে দেখলাম চুড়িগুলো আমার হাতের মাপে হচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে কেনার কারণে এমনটা হয়েছে। তীথি আমার চুড়িগুলো খুব পছন্দ করল। দেখলাম তার হাতে চমৎকার মানিয়েছে। আমি তখন তাকে সেগুলো দিয়ে দিলাম। এত ভালবেসে আনা একটা জিনিস অথচ আমি পরতে পারলাম না। এই নিয়ে রফিক মনমরা হয়ে রইল। লেখাটি পড়ে রফিক ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, কত কিছুই তো আমাকে দিতে পারিনি, নীলা!’ অন্যান্য লেখাগুলো প্রায় একই ধরনের শেষের পাতায় এসে রফিকের চোখ আটকে গেল। এই লেখাটি বেশ দীর্ঘ। তারিখ দেখে বোঝা যায়, গত পরশুদিন এটি নীলা লিখেছে। লেখাটি এ রকম। বিয়ের আর একদিন বাকি আয়োজনের বিয়ে না। গোপন বিয়ে অল্প কয়েকজন জানে। আমি, রবিন ভাই, তীথি, রবিন ভাইয়ের দু’জন বন্ধু। এইতো, এই ক’জন শুধু। আর কেউ জানে না। বিয়েটা হচ্ছে এখানকার একটা কাজী অফিসে। আমরা সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি। রবিন ভাই উনার দুই বন্ধুকে নিয়ে আসবেন চিটাগাং থেকে। তারা কাজী অফিসের সামনে অপেক্ষা করবে। রবিন ভাই এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। আর বাকি রইল তীথি। ‘মেহের’ স্টেশন ধরে এখানে এসে পৌঁছতে তীথির সময় লাগবে বড়জোর এক ঘণ্টা। তীথি বাড়ি থেকে কি বলে বেরুবে সেটাও ঠিক করা আছে। আমি তীথিকে সব বুঝিয়ে বলেছি। বলেছি বাড়ি থেকে বেরুবার সময় মাকে বলবি-মা, ফিরতে দেরি হবে। বিকেল চারটার দিকে একটা ইমপরটেন্ট ক্লাস আছে। তাছাড়া আজকে আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন। ছুটির পর সরাসরি ওখানে চলে যাবে। আর তখন শুরু হবে চরম অশান্তি। দুটো পরিবারের ওপর নেমে আসবে এক প্রচ- ঝড়। আর এই সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর যে মানুষটা সব থেকে বেশি কষ্ট পাবে সে হচ্ছে রফিক। আমি বুঝতে পারছি, আমি খুব বড় ধরনের অন্যায় করছি। রফিককে ঠকাচ্ছি। ঠকাচ্ছি। বাধ্য হয়ে। তার কারণ, সবটা জানার পর রফিক কখনোই মেনে নেবে না। ‘রবিন ভাই এবং তীথির এই বিয়ে। শুধু রফিক কোন, ভাগ্যাবন্ড পাত্রের সঙ্গে নিজের একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে কোন ভাইয়ের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তার ওপর এমনিতেও রবিন ভাইকে রফিক খুব একটা ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু আমি তো জানি রবিন ভাই কেমন। রবিন ভাই এমন একজন মানুষ, যিনি সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তীথিকে সুখী করবেন। আর এতদিনের সম্পর্কে তীথিও ব্যাপারটা বুঝে গেছে তীথি কখনই পারবে না অন্য কারুর সাথে সুখী হতে। এই রকম একটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমার এই ছোট্ট ননদ এবং অসহায় ভাইটির পাশে দাঁড়ানোর মতো আমি ছ্ড়াা কেউ নেই। তাই রফিকের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্যায়টা জেনে বুঝে আমাকে করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর বেশি দিন নয়। আমি ঠিক করে রেখেছি, সবকিছু মিটে গেলে ধীরে সুস্থে পরে রফিককে সব জানাব। কোন কিছুই লুকাব না। কারণ, এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী মানুষটাকে আমি খুব ভালবাসি। আমি চাই না, আমার কোন কারণে সে কষ্ট পাক। ভোর চারটা। রফিক কাঁপছে। সে কিছুই করতে পারেনি। ডেডবডি সরানোর আর কোন প্রয়োজনও বোধহয় নেই। কারণ রফিক পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পেরেছে যে নীলাকে খুন করে সে বিরাট বড় ভুল করেছে। যে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। ভোর পাঁচটা। বাইরের প্রকৃতিতে আস্তে আস্তে আলো ফুটছে। রফিক বসে আছে মুর্তির মতো। তার চোখে কোন পানি নেই। তার সামনে শুয়ে থাকা নীলা এখন শুধুই একটা লাশ। ব্লাড সার্কুলেশন অনেকক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর শুরু হবে অটোলাইসিস প্রক্রিয়া। সমস্ত ঈড়সঢ়বহংধঃড়ৎু সধপযধহরংস কলান্স হওয়ার ফলে চঁঃবৎভুরহম’ ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাস এর বৃদ্ধিতে ডেডবডি পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে আর এই পচন প্রক্রিয়া বন্ধ করে পুরো বডিকে করে দিতে পারে ফরমালিন। রফিক খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নীলাকে নিজের কাছে ধরে রাখার একটা শেষ চেষ্টা করবেই। চিরকালের মতো নীলা হারিয়ে যাবে, এটা হতে দেয়া যায় না। কিছুতেই না। দুপুর বারোটা। যে রকম ঝামেলা হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সে রকম ঝামেলা ছাড়াই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় হয়ে গেল। রফিক বাড়িতেই কোন রকমে ফরমালিনে ডেডবডি চুবিয়ে রাখার মাধ্যমে প্রিসারভেশন এর কাজটা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলো এবং তার পর পরই কাঁদতে শুরু করল। তার কাছে মনে হতে লাগল, নীলা যেন আরও বেশি দূরে চলে গেছে। তাকে খালি হাতে ধরা যাবে না। চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। তার ঘরে খালি চোখে ঢোকা যাবে না। চোখ জ্বালা করবে। তার শরীরের ঘ্রাণ আর কোন দিন পাওয়া যাবে না। তার বদলে নাকে ঢুকবে কড়া কেমিক্যালের গন্ধ। আহা কি কষ্ট! কি কষ্ট! পাঁচ নীলা, তুমি চলে যাওয়ার পর কতদিন পার হয়েছে, জানো? মাত্র তিন দিন। কিন্তু এই তিন দিন আমার কাছে তিন শ’ বছরের মতো কেটেছে। নিজেকে কচ্ছপের মতো মনে হয়েছে। কত অপেক্ষা করেছি, তোমার কোন বন্ধ-বান্ধব আসবে। কোন আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত যে কেউ। কিংবা পুলিশ। আর আমি ধরা পড়ব। কেউ আসেনি নীলা, তোমার খোঁজ নিতে। এমনকি রবিনও না। আর আসবেই বা কি করে? আমি নিজেই তো সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছি। নিজে থেকে গিয়ে যে ধরা দেব, সে সাহসও আমার নেই। আমি সত্যিই ভীত। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। অনেক বড় ভুল। জানো নীলা, তুমি চলে যাওয়ার পর একমাত্র ওই সিলিং ফ্যানটাকেই আমার আপন মনে হয়েছে। যতবার ওই সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়েছি, চুম্বকের মতো ফ্যানটা আমাকে আকর্ষণ করেছে। তোমার মতো আমারও বোধহয় সময় শেষ হয়ে এসেছে, নীলা। এ পর্যন্ত লিখে রফিক বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলো আর রাস্তার পাশের সোডিয়াম লাইটের মিরে অদ্ভুত এক আলো তৈরি হয়েছে। তার পরও রফিকের মনে হলো, চারদিক অদ্ভুত অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। রফিক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। দক্ষিণের ঘরের সিলিং ফ্যানটা তাকে প্রবলভাবে টানছে। রফিক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে আছে চাঁদের আলো আর সোডিয়াম লাইটের আলো। কি অদ্ভুত রহস্যময় সে আলো!
×