ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারীর অবস্থান

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৩ মে ২০১৬

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারীর অবস্থান

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃজনশীলতার এই বিশেষ অঙ্গনটিতেও বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। জমিদারি দেখার সুবাদে তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ান। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর কালজয়ী ছোটগল্পের শুরু আর বিস্তৃতি। ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর মত ছিল অনেকটাই নিজের দেখা বাকিটা কল্পনামিশ্রিত তাঁর ছোটগল্পের সমৃদ্ধ অবয়ব। জমিদারি দেখতে গিয়ে তিনি প্রজাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার একেবারেই নিত্যসঙ্গী ছিলেন। কাছ থেকে অনুভব করেন এসব পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র জনগণের প্রতিদিনের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা এবং নিপীড়নের করুণচিত্র। সেখান থেকেই তুলে আনেন তাঁর ছোটগল্পের নানামাত্রিক রসদ। কঠিন বাস্তবের বেড়াজালে পিষ্ট গ্রাম-বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা তার ছোটগল্পে যে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে তা আজও কালের পরিবর্তনে অম্লান। নারী ভাবনা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে, মননে, সামগ্রিক জীবনবোধে, সহৃদয় অনুভূতিতে যে চিরস্থায়ী প্রভাব স্পষ্ট হয় সেখান থেকে সহজেই অনুমেয় নারীজাতির প্রতি তাঁর দরদ, সহানুভূতি এবং বিশেষভাবে দায়বদ্ধতা। নারীর অপশন, অসম্মান, অমর্যাদা কোনভাবেই তাঁর সাহিত্যে আসেনি। নারী সামাজিক জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সযতœ পরশে নারী তার আপন মহিমায় ভাস্বর থাকে। তাঁর ছোট নারীরাও সমাজ-সংস্কারের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলেও কোথাও নারীত্বে অবমাননা কখনো হয়নি। নারী তার অধিকার, স্বাধীনতা, আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সমাজে টিকে থাকার স্থানটুকু সবসময়ই শক্ত করে রাখে। ছোটগল্পের কয়েকটি নারী চরিত্র উল্লেখ করলেই এসব বিষয় আরও পরিষ্কার হবে। প্রথমেই বলা যায় শাস্তি গল্পের বন্দরা চরিত্রটি। গল্পটি খেটে খাওয়া দিনমজুর দুখিরাম, ছিদাম ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এগিয়ে যায়। একপর্যায়ে স্বামীর দেয়া অপবাদে ‘চন্দরা’ খুনীর আসামির দ্বারে এসে দাঁড়ায়। প্রথমদিকে স্বামীর এই ঘৃণ্য নালিশে সে চমকে ওঠলেও পরবর্তীতে নির্দ্বিধায় তা মেনে নেয়। এক সময় স্বামী ইচ্ছা করেও চন্দরাকে খুনের এই দায়ভার থেকে মুক্ত করতে পারেনি। ছিদাম চেয়েছিল খুনী হিসেবে নিজের ঘাড়ে সমস্ত দায়ভার নিতে। কিন্তু চন্দরার অবিচলিত দৃঢ় প্রত্যয় এবং বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কাছে স্বামীর কোন আকুতি-মিনতি আর প্রশ্রয় পায়নি। বিচারক ও বন্দরার জবানবন্দীকেই শেষ রায়ের জন্য বিবেচিত করে। গল্পটি লেখা ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেএ ‘মানভাঙনের’ নায়িকা গিরিবালার স্বামী গোপীনাথ নাটকের অভিনেত্রীদের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। স্বামীর এই স্বভাবটি তাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিত। কিন্তু নিজের যোগ্যতায় একসময় গিরিবালা নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পায়। রবীন্দ্রনাথ গল্পটি শেষ করছেন এভাবে, গিরিবালা যেদিন মঞ্চে অভিনয় করে দর্শকের স্থানে সেদিন গোপীনাথের জায়গাটুকুও হয়নি। মানবিক কবি সব সময় যে নারীর পক্ষে ছিলেন তা নয়, তিনি অন্যায়-অবিচারকে কখনো মাথা পেতে নেননি। নীরবে, নিভৃতে সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এভাবে প্রতিবাদ করেছেন। সুতরাং নারী যেখানে নিগৃহীত হয়েছে সেখানে তিনি নারী বলে তাঁর অধিকার কখনো হরণ করেননি। একইভাবে ‘দর্পহরণে’র নায়িকা নির্ঝর তার সৃজনশীলতার সমস্ত অধিকার অর্জন করে স্বামীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে যায়। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত আরেকটি ছোট গল্প ‘জীবিত ও মৃত’র নায়িকা কাদ্মবিনী। যেখানে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেন যে, কাদ্মবিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে (১৯১৪) লেখা তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি গল্প ‘হৈমন্তী’ ‘অপরাজিতা’ এবং ‘স্ত্রীর পত্রে’র মধ্যে নারীদের যে ব্যক্তিত্বের মহিমা, অধিকার সচেতনতা, মর্যাদাবোধ প্রতীয়মান হয় সেখান থেকেও বোঝা যায় নারী জাতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের সহমর্মিতা। ‘হৈমন্তী’ গল্পের প্রধান চরিত্র হৈমন্তী। তাকেও সামাজিক অভিশাপে জর্জরিত হতে হয়। স্বামী অপু স্ত্রীর জন্য বেদনার্থ হয়েও কিছু করতে পারেনি। সমাজ-সংস্কার তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। পিতার আদর্শে লালিত হৈমন্তী কখনো তার ব্যক্তিত্বের স্খলন ঘটায়নি। কখনোই মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। স্বামীগৃহে শত অপমানে ও তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। অন্যায়, অবিচারের শিকার হৈমন্তী শেষ পর্যন্ত তার আপন ঐশ্বর্যে অম্লান থাকে। ‘স্ত্রীর পত্রে’র গল্পে মৃণালের যে সীমাহীন আত্মমর্যাদাবোধ, অধিকারচেতনা তা শুরু থেকে গল্পের শেষ অবধি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সাবলীলভাবে ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। মৃণাল রূপবতী এবং বুদ্ধিমতি। কিন্তু স্বামীগৃহ তার রূপের কদর করলেও গুণের কদর কখনোই করেনি। সমাজ-সংসারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সে যখন আশ্রিতা বিন্দুকে রক্ষা করতে পারেনি তখন একদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আশ্রমে আশ্রয় নেয়। যদিও কোন স্বাধীন পেশা নয় ধর্মাশ্রিত সমাজের আশ্রমেই তার গতি হয় তবুও কঠিন কঠোর পারিবারিক বন্ধন থেকে তো সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এভাবে রবীন্দ্রনাথ নারীত্বের সম্মানকে কখনোই ধুলায় লুণ্ঠিত হতে দেননি। অত্যন্ত সচেতন ও সুনিপুণভাবে সেটা রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সবচেয়ে অপরিচিতা গল্পের নায়িকা কল্যাণীর সাহসী পদক্ষেপ, দৃঢ় মনোবল এবং নিজের জায়গা শক্ত করার যে বলিষ্ঠ চিন্তা তা আমাদের সত্যিই মুগ্ধ করে। যৌতুকের কারণে নানা বিতর্কে জড়ানো বিয়েটা কল্যাণী নিজেই ভেঙে দেয়। শুধু তাই নয়, বিয়ের আসর থেকে সে বরকে উঠে যেতে বাধ্য করে। শিক্ষকতার মতো স্বাধীন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে। এখানে রবীন্দ্রনাথ আরও অগ্রগামী। সুতরাং নারী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের যে সচেতন প্রত্যয় যা তাঁর বিভিন্ন নারী চরিত্রে বিশেষভাবে দীপ্যমানতা সমকাল কিংবা আধুনিক নয় একেবারেই চিরকালের।
×