ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিজার্ভ চুরিতে তিন দেশের সংশ্লিষ্টতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১২ মে ২০১৬

রিজার্ভ চুরিতে তিন দেশের সংশ্লিষ্টতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা তিনটি হ্যাকার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছেন। বিশ্বজুড়ে আলোচিত সাইবার আক্রমণের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, যার মধ্যে একটি গ্রুপ পাকিস্তানের। বাংলাদেশে নিয়োজিত সিলিকন ভ্যালির সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআই’র ফরেনসিক পরীক্ষায় এ তথ্য মিলেছে বলে বিশ্বের বাণিজ্য সংবাদ বিষয়ক অন্যতম শীর্ষ সংস্থা ব্লুমবার্গ জানিয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং পাকিস্তানের কূটনীতিকদের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের মধ্যে এ সংবাদ প্রকাশ করল সংবাদমাধ্যমটি। দ্বিতীয় গ্রুপটি উত্তর কোরিয়ার হলেও অন্য হ্যাকার গ্রুপটি কারা এবং কোন দেশের, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ারআই’র তদন্তকারীরা। এদিকে সুইজারল্যান্ডের বাসেল বৈঠকে অর্থ উদ্ধার ও দোষীদের আইনের আওতায় আনতে একসঙ্গে কাজ করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, ব্যাংক লেনদেনের আন্তর্জাতিক মাধ্যম সুইফটের মাধ্যমে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে চুরি যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ফায়ারআইকে ফরেনসিক তদন্তের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ। এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় বড় সাইবার চুরির ঘটনাগুলোর বেশ কয়েকটির তদন্ত করেছে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানি ফায়ারআই। রিজার্ভ জালিয়াতির তদন্ত এখনও শেষ না হলেও ফায়ারআইয়ের তদন্তকারীরা এ চুরিতে পাকিস্তানী একটি হ্যাকার গ্রুপের জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে। ফায়ারআই’র দুইজন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ার দুটি হ্যাকার গ্রুপ এ সাইবার চুরিতে জড়িত থাকার ফরেনসিক পরীক্ষায় তথ্য মিলেছে। তবে অন্য হ্যাকার গ্রুপটি কারা এবং কোন দেশের, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ারআই’র তদন্তকারীরা। হ্যাকিংয়ের বিষয়ে কথা বলতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছিল ব্লুমবার্গ। তবে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়া মিশনের কর্মকর্তাদের টেলিফোন এবং ইমেইল করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বলে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আর্থিক খাতের কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সাইবার আক্রমণের অভিযোগ বহু দিন থেকে করা হচ্ছে। তবে পিয়ংইয়ং বরাবর তা নাকচ করে আসছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ যে দুটি দেশে সরানো হয়েছিল, তার একটি ফিলিপিন্সের তদন্তকারীরা এ সাইবার আক্রমণের জন্য চীনের হ্যাকারদের দুষলেও পেইচিং তা নাকচ করে আসছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন ফোকর গলে তিনটি হ্যাকার গ্রুপ সুযোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ারআই কর্মকর্তারা। এক কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে হয়ত ম্যালওয়্যার বসানো হয়। হতে পারে এতে ব্যাংকের ভেতর থেকে কেউ সহায়তা করেছে। রিজার্ভ চুরির এ ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারী কমিটির প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ইতোমধ্যে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রযুক্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতার অভাব ধরা পড়লেও সচেতনভাবে কোন কর্মকর্তা জড়িত বলে প্রমাণ পাননি তারা। এ ঘটনায় করা বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির কর্মকর্তারাও একই কথা বলছেন। তারা আবার সুইফটের দায়িত্বহীনতার দিকে অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যেই এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মঙ্গলবার জানায়, রিজার্ভ চুরির এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরকার কেউ সহায়তা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তা এতে জড়িত বলে তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। অন্য কয়েকজন হতে পারে সহায়তাকারী। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে একযোগে কাজ করার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বা নিউইয়র্ক ফেড ও আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট। মঙ্গলবার রাতে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে নিউইয়র্ক ফেডের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে। বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বা নিউইয়র্ক ফেডের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ডাডলি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির এবং সুইফট প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত সবপক্ষই রিজার্ভের অর্থ চুরি ও অর্থ উদ্ধারÑ এ দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার এবং অন্যান্য কাঠামোগত নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নিউইয়র্ক ফেডের যৌথ বিবৃতিতে পরস্পরের মধ্যে তথ্যবিনিময়, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধার এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে তিনপক্ষই একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। এদিকে বুধবার এক জরুরী সংবাদ সম্মেলেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় পরিলক্ষিত সাইবার ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে একসঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট। একই সঙ্গে এ তিন প্রতিষ্ঠান চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধার ও জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। শুভঙ্কর সাহা বলেন, সভায় জালিয়াতকৃত পুরো অর্থ উদ্ধারপূর্বক জড়িতদের উপযুক্ত বিচারের আওতায় আনা ও বিশ্ব অর্থনীতিকে সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষায় একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত রবিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এক প্রতিবেদনে জানায়, সুইফট টেকনিশিয়ানদের অবহেলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভার অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। এরপর নিজেদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করে সুইফট দাবি করেÑ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাদের নয়, বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সুইফট ব্যবহারকারী অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতোই পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সব ব্যাংকিং পদ্ধতির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকেরই ছিল বলে সুইফটের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
×