ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১১ মে ২০১৬

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়া

শংকর কুমার দে ॥ যেভাবে একজনের ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয় তার পদ্ধতি প্রক্রিয়ার কথা জানা গেছে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। ফাঁসি কার্যকরের প্রত্যক্ষদর্শী থাকেন জল্লাদ, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার ও কারা কর্মকর্তারা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল¬া ও কামারুজ্জামানকে ফাঁসি কার্যকর করেছেন এমন প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা বলেছেন, ফাঁসি কার্যকরের আগে অনুষ্ঠিত হয় ফাঁসি দেয়ার মহড়াও। ফাঁসির মঞ্চের সামনে বসানো হয় ইলেকট্রিক কেবল, উচ্চ ভোল্টের বাল্ব ও সার্চ লাইট। লাইটের আলো কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকার ভেদ করে বাইরে এসে সার্চ লাইটের তীব্র আলো ছড়ায়। ফাঁসির দ-প্রাপ্তকে ফাঁসির মঞ্চের সামনে দাঁড় করানো হয়। দুই হাত পেছন দিক দিয়ে থাকে পিছমোড়া বাঁধা। বেঁধে দেয়া হয় দুই পা-ও। মুখম-লে জম টুপি পরানো হয়। সতর্ক তীক্ষè দৃষ্টি সবার। জেল সুপারের হাতে থাকে লাল রুমাল। জেল সুপার হাত থেকে লাল রুমাল ফেলে দিলেন। অমনি কপিকলের গিয়ারে টান দিলেন জল্লাদ। গর্তের ওপরে থাকা পাটাতনের কাঠ সরে গেল। এভাবেই ফাঁসিতে ঝুলে গেল ফাঁসির আসামি। ফাঁসি কার্যকর করায় অংশগ্রহণকারী কারা কর্মকর্তা, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান কারাভ্যন্তরের ফাঁসি কার্যকর করার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। ফাঁসি দেয়ার আগে ফাঁসির আসামির কাছে জানতে চাওয়া হয় শেষ ইচ্ছার কথা। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ডাক্তার রক্তচাপসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন ফাঁসির আসামির। ফাঁসি দেয়ার আগে গোসল করানো হয়। নিয়মনীতি অনুযায়ী ফাঁসির কয়েদীকে মৌলভী এনে তওবা করানো হয়। ফাঁসি দেয়ার আগে প্রথমে কনডেম সেলে গিয়ে পড়ানো হয় কালেমা ও তওবা। সামনেই থাকেন একজন ইমাম। কালেমা ও তওবা পড়ানোর পর মাথায় কালো রংয়ের জমটুপি পরিয়ে দেয়া হয়। জমটুপি এমনভাবে পরানো হয় যেন ঢেকে যায় মুখম-ল। দু’হাত ও পা বাঁধা অবস্থায় কনডেম সেলের সামনের খালি জায়গা দিয়ে হেঁটে জল্লাদরা নিয়ে আসেন ফাঁসির আসামিকে। জল্লাদ তাকে ধরে, ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে, নিয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চে। ফঁাঁসির মঞ্চে ওঠানোর পর যে গর্তটি থাকে তা কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। এই ফাঁসির মঞ্চেই দাঁড় করানো হয় ফাঁসির আসামিকে। ফাঁসির মঞ্চের সামনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আদেশ দানের অপেক্ষায় থাকেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ কারা কর্মকর্তারা। ঘড়ি দেখে নির্দিষ্ট সময়ে ইশারা দিতেই, কারা কর্মকর্তার হাতের লাল রুমাল পড়ে যায়। অমনি জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের কপিকলের দড়িতে টান দেয়। ফাঁসির রশিতে ঝুলে কূপের ভেতরে পড়ে গিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে থাকে ফাঁসির আসামি। কারা কর্মকর্তাসহ কর্তব্যরত উপস্থিতদের দৃষ্টি থাকে ঘড়ির দিকেই। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ফাঁসির মঞ্চের গর্তের ভেতরে ঝুলতে থাকা ফাঁসির আসামির কাছে যান জল্লাদরা। ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেল। তারপর মরদেহ ফাঁসির মঞ্চের গর্ত থেকে উঠানো হয় ফাঁসির মঞ্চের সামনে। তারপর দড়ি খুলে মরদেহ রাখা হয় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সামনের টেবিলে। ফাঁসি কার্যকর করার দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করেন ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, কারা কর্মকর্তা, পুলিশ, জল্লাদসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা। নিয়ম নীতি অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের আগে মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। কারণ ফাঁসি কার্যকরের সময়ে যাতে কোন বাধা বিপত্তি না দেখা দেয় সেজন্য ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতির অংশ এটা। ফাঁসি যার কার্যকর করা হবে তার যেমন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ডাক্তার। তেমন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় জল্লাদেরও। ফাঁসির আসামির গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝোলানোর জন্য আনা হয় ম্যানিলা রোপ (দড়ি)। ম্যানিলা রশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন উর্ধতন কারা কর্মকর্তারাও। রশিতে মাখানো হয় তেল আর পাকা কলা। এই দড়িটি পিচ্ছিল করেন জল্লাদরা। যে পাটাতনটির ওপর কয়েদিকে দাঁড় করানো হবে সেই পাটাতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় কয়েক দফায়। পাটাতন ও রশির কপিকলগুলোতে দেয়া হয় বিশেষ ধরনের তেল। ফাঁসি কার্যকর করার সময় বিশেষ ইঙ্গিত বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় বিশেষ লাল রুমাল। এটা থাকে জেল সুপারের হাতে। লাল রুমাল ফেলে দিতেই জলাদ কপিকলের গিয়ারে টান দিয়ে দ-িত কয়েদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে-এই নির্দেশ দেয়া হয়। কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কোনার দিকে রয়েছে ফাঁসির মূল মঞ্চ। ফাঁসির মঞ্চের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট ও প্রস্থ সাড়ে ৪ ফুট। পাশাপাশি দু’জন দ-প্রাপ্তের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ব্যবস্থা রয়েছে ফাঁসির মঞ্চে। মঞ্চের ওপরে যে ফাঁসির কাষ্ঠ তার উচ্চতা ৮ ফুট। আর মঞ্চ থেকে নিচের দিকে যে গর্ত আছে তা ১২ ফুট গভীর। গর্তটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। ফাঁসি কাষ্ঠের লাগোয়া উত্তর দিকে আছে কপিকলের গিয়ার। এই কপিকলের সঙ্গে ফাঁসির দড়ি লাগানো থাকে একপ্রান্তে। আরেক প্রান্তে থাকে ফাঁসির কাষ্টের যেই দড়ি দিয়ে ঝুলানো হবে সেটা। কপিকলের গিয়ারের দায়িত্ব থাকেন একজন। তার পাশে পূর্ব দিকে অবস্থান নেন আরও তিনজন। মূল মঞ্চসহ পুরো ফাঁসির মঞ্চটি আরও বড়। মূল মঞ্চের পূর্ব দিকে রয়েছে ৩টি কনডেম সেল। দক্ষিণে একটি লম্বা টেবিল আছে, যার পাশে বসতে পারেন অন্তত ১০ জন। তার সামনে আরেকটি টেবিল থাকে, যাতে ফাঁসি কার্যকর করার পর রাখা হয় মৃতদেহ। ফাঁসি কার্যকর করার সময় সতর্ক প্রহরায় অবস্থান নেয় অন্তত ১০ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। সবার হাতে থাকে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। একটি ফাঁসির দ-িত কার্যকর করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মূল ফাঁসির মঞ্চে সময় নেয় ১৭ মিনিট। মূল ফাঁসির মঞ্চের কাছেই আছে তিনটি কনডেম সেল। ফাঁসি দেয়ার আগে দ-প্রাপ্ত আসামিকে রাখা হয় এই সেলেই। সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দূরত্ব ৫০ গজেরও কম। জল্লাদরা সেল থেকে দ-িত কয়েদীকে হাঁটিয়ে আনেন মূল ফাঁসির মঞ্চে। মঞ্চের কপিকলের গিয়ারের কাছে অবস্থান নেয়া প্রস্তুত হন কর্তব্যরত ও উপস্থিতরা। জল্লাদরা ফাঁসির রজ্জু পরিয়ে দেয় দ-িত কয়েদীকে। কনডেম সেল থেকে মঞ্চ পর্যন্ত এসব আনুষ্ঠানিতা সম্পন্ন করে একজন কয়েদীকে নিতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মিনিট। ১৭ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর নিচের দিকে থাকা গর্তের গেট দিয়ে গর্তেও ভেতরে প্রবেশ করেন জলাদরা। মরদেহ আবার গর্ত থেকে টেনে মঞ্চে ওঠানো হয়। তারপর মরদেহের দড়ি খুলে দেয়া হয়। লাশ নেয়া হয় পাশের মর্গে। স্পাইনাল কর্ড ও হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে মাত্র আধা ঘণ্টায় শেষ হয় মৃত্যুদ- কার্যকরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা। এভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল¬া ও কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- এভাবেই কার্যকর করা হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে। সর্বোচ্চ আদালতে অপর মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার প্রক্রিয়াও এভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।
×