ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুসান্না সাজ্জিল

বার্লিন আর মস্কোর সঙ্গে সমঝোতার পথে নেই

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১১ মে ২০১৬

বার্লিন আর মস্কোর সঙ্গে সমঝোতার পথে নেই

জার্মান সরকার একদা রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার নীতিতে বিশ্বাস করত। এখন আর করছে না। তাতে রুশ প্রশাসনের চটে যাবারই কথা। এর প্রতিফলন পাওয়া যাবে রাশিয়ার সরকারী প্রচার মাধ্যমের সুরে। সম্প্রতি সেখানকার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তা থেকেই এটা স্পষ্ট। তাকে কাপুরুষ আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভ-ামি ও দুই মুখো নীতির প্রতিমূর্তি বলা হয়েছে। তাঁর বহির্গমন নীতির কারণে জার্মান ফ্যাসিস্ট দক্ষিণপন্থীদের হাত শক্তিশালী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিউনিস্ট শাসন পরবর্তী রুশ প্রচারযন্ত্রে আর কোন জার্মান নেতার এত শাণিত সমালোচনা করা হয়নি। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও রুশরা জার্মানদের নিকটতম মিত্রদের অন্যতম হিসেবে দেখত। জনমত সমীক্ষায় দেখা যায় তারা এখন জার্মানদের উত্তরোত্তর শত্রু হিসেবে দেখছে। কারণ মার্কেল ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তাই যতখানি সম্ভব মার্কেলের রাজনৈতিক ক্ষতিসাধনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ক্রেমলিন। বার্লিনের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিএপির রুশ বিশেষজ্ঞ স্টিফান মিস্টারের ভাষায় ‘পুতিন মার্কেনকে হটানোর জন্য জানপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর হাতে প্রচুর অস্ত্রও আছে। এমনি একটি অস্ত্র হলো টেলিভিশন যার লক্ষ্য দেশীয় দর্শকশ্রোতাই শুধু নয় উপরন্তু বিদেশের রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীও। উল্লেখ্য, জার্মানিতেই রুশ ভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। গত জানুয়ারিতে রাশিয়ার চ্যানেল ওয়ান টিভিতে এক কাহিনী পরিবেশিত হয় যে বার্লিনে একদল অভিবাসীর হাতে ১৩ বছরের এক রুশ-জার্মান বালিকা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। খবরটিকে কেন্দ্র করে জার্মানিতে রুশ বংশোদ্ভূত জার্মানরা বড় ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরে জানা যায় কাহিনীটা ছিল মিথ্যা। তৎসত্ত্বেও রুশ টিভিতে তা প্রচারিত হতেই থাকে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনও অভিযোগ করে বসেন যে জার্মানরা ঘটনাটা ধামাচাপা দিচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচার কৌশল রুশরা ইতোপূর্বে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। কিন্তু জার্মানির বিরুদ্ধে কখনও করেনি। এতে করে জার্মান এস্টাবলিশমেন্ট রাশিয়ার ওপর বিগড়ে গেছে। মার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (সিডিইউ) এমপি রোডেরিক ডাইসওয়াটার বলেন, রাশিয়া এখন এক মস্ত শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সরকারের ছোট শরিক দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) যারা বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার নীতির প্রবক্তা তাদেরও অনেকে রাশিয়ার ওপর চটেছে। বার্লিনের জার্মান-রাশান ফোরামের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার রাহরের মতো রুশ দরদী ব্যক্তিও যুদ্ধের ব্যাপারে তার দেশের সুগভীর আতঙ্ক ব্যক্ত করে বলেছেন যে, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ইস্যু ইউক্রেন নয় বরং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো। রাশিয়া ভেবেছিল যে জার্মানির সঙ্গে বাণিজ্যের কারণেই এ দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক অটুট থাকবে। কিন্তু তারা হিসাবে ভুল করেছে। জার্মানির বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে রাশিয়ার স্থান চেক প্রজাতন্ত্রেরও নিচে। ইউক্রেন সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের আগে জার্মানির বাণিজ্যের ৪ শতাংশ হতো রাশিয়ার সঙ্গে। সেটা এখন ২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। জার্মানির কঠোর ভূমিকার মুখে রাশিয়া অন্য কৌশলও অবলম্বন করেছে। জার্মানির শাসক কোয়ালিশনে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য এসপিডি নেতা সিগমার গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে খায়খাতির জমানোর চেষ্টা করেছে। গ্যাব্রিয়েল গত শরতে মস্কোয় গেলে স্বয়ং পুতিন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এসব কিছুর উদ্দেশ্য তাঁকে নর্ড স্ট্রিম ২ নামে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনে রাজি করানো। এই পাইপলাইন ইউক্রেন ও বাল্টিক রাজ্যগুলোকে ঘিরে যাওয়ার কথা। এই সংক্রান্ত কোন চুক্তি হতে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে বাধা আসার কথা। এমনকি ঘরোয়াভাবে চ্যান্সেলর মার্কেলও খুশি হবেন যদি চুক্তিটা না হয়। তবে এগুলোর চেয়েও বড় কথা রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ আগামী জুলাই মাসেও অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কিনা। অবরোধ উঠিয়ে দেয়াতে পারলে তা হবে পুতিনের বিজয় এবং মার্কেলের পরাজয়। কিন্তু এসপিডি এমন অবরোধের পক্ষপাতী নয়। কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এসপিডির সদস্য ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টিইনমেইয়ার রাশিয়ার সঙ্গে অধিকতর কূটনৈতিক সহযোগিতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে রুশদের বাদ দিয়ে কোন বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বিরোধের নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। এখানেই শেষ নয়, পুতিন জার্মানির চরম দক্ষিণপন্থী ও চরম বামপন্থী উভয় দলের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তার এমন একটি মিত্র দল হলো দক্ষিণপন্থী এএফডি পার্টি। অন্যটি প্রাক্তন কমিউনিস্ট পার্টি ডাই লিংক। বিদেশী বিদ্বেষী পেগিডা আন্দোলনও পুতিন সমর্থক। গত বছর ড্রেসডেনে অভিবাসীবিরোধী এক সমাবেশে রাশিয়ার পতাকা নাড়ানো হয় এবং সেøাগান ওঠে ‘পুতিন আমাদের সাহায্য কর।’ মিসেস মার্কেল অবশ্য এসব বিষয়কে তেমন আমলে নেন না। তিনি তাঁর প্রতি পুতিনের এই বিরোধিতাকে দুর্বলতারই পরিচায়ক মনে করেনÑ শক্তির নয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×