ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রূপকথার আরেক নাম লিচেস্টার সিটি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১১ মে ২০১৬

রূপকথার আরেক নাম লিচেস্টার সিটি

কোন প্রশংসাবাণীই যথেষ্ট নয়! লিচেস্টার সিটি রূপকথার যে সার্থক মঞ্চায়ন করেছে সে বর্ণনা লেখার ভাষা কারোরই হয়ত নেই। এরপরও বিশ্বজুড়ে চলছে দলটির অবিশ্বাস্য সাফল্যের নান্দনিক গল্প। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা আর নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়ে ২০১৫-১৬ মৌসুমে প্রত্যাশিতভাবেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে শিরোপা জিতে নিয়েছে লিচেস্টার। গত ২ মে লন্ডনের বিখ্যাত স্টামফোর্ড ব্রিজে স্বাগতিক চেলসির সঙ্গে পয়েন্ট তালিকার দুইয়ে থাকা টটেনহ্যাম হটস্পার ২-২ গোলে ড্র করলে দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইপিএলের শিরোপা নিশ্চিত হয় ক্লাউডিও রানিয়েরির দলের। ১৮৮৪ সালে জন্ম নেয়ার পর ১৩২ বছরের ইতিহাসে এটি প্রথম শিরোপা লিচেস্টারের। সঙ্গতকারণেই এখন উৎসব-আনন্দে ভাসছে দ্য ফক্সেস খ্যাত ক্লাবটি। ৩৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছে ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট। অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে নটিংহাম ফরেস্টের নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লীগ। এর আগে ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে থেকে প্রিমিয়ার লীগ শেষ করেছিল লিচেস্টার। সেটাই ছিল ক্লাবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্জন। এছাড়া ২০০০ সালে লীগ কাপে শিরোপা জিতেছিল রূপকথার গল্প লেখা ক্লাবটি। এবার সব সাফল্যই ছাপিয়ে গেছে তারা। শুধু তাই নয়, ক্রীড়াবিশ্বের সেরা সাফল্যগুলোর মধ্যেও জায়গা হয়েছে লিচেস্টারের রূপকথা অথচ মৌসুমের শুরুতে শিরোপা লড়াইয়ে লিচেস্টারের পক্ষে বাজির দর ছিল ৫০০০:১। ফুটবল বিশেষজ্ঞ আর বাজিকরদের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে সেই ‘পুঁচকে’ দলই বসেছে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। ফুটবলের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছে অন্যতম সেরা এক অঘটনের। থাইল্যান্ডের কোটিপতি ব্যবসায়ী ভিচাই শ্রিবধানাপ্রভার মালিকানাধীন লিচেস্টার এবারের লীগে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি ম্যাচে হেরেছে। একটি ঘরের মাঠে, দুটি প্রতিপক্ষের মাঠে। ২০১৫ সালে অবনমন থেকে বাঁচার জন্য লড়া একটি দলের মৌসুমজুড়ে এমন অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা, দুর্দান্ত পারফর্মেন্স ক্রীড়া ইতিহাসের অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। চেলসি-টটেনহ্যাম দ্বৈরথের আগেই নিশ্চিত হয়, ম্যাচটিতে স্পার্সরা পয়েন্ট খোয়ালেই শিরোপা নিশ্চিত হবে লিচেস্টারের। অনুমিতভাবে সেটিই হয়েছে। এ জন্য লিচেস্টার কোচ ক্লডিও রানিয়েরি ইডেন হ্যাজার্ডকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন। ম্যাচের বিরতির সময় যখন টটেনহ্যাম ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল, মনে হয়েছিল লিচেস্টারের অপেক্ষাটা আরেকটু বাড়ল। কিন্তু লিচেস্টারের রূপকথার জন্ম দিতে যেন ব্লুজরা দ্বিতীয়ার্ধে নয়নজুড়ানো ফুটবল খেলতে থাকেন! ম্যাচের ৫৮ মিনিটে গ্যারি কাহিলের গোলে ব্যবধান কমানোর পর ৮৩ মিনিটে হ্যাজার্ডের দুর্দান্ত গোলে সমতা ফেরায় গত আসরের চ্যাম্পিয়ন চেলসি। গত বছর এই বেলজিক তারকার গোলেই ইংলিশ লীগ নিশ্চিত করেছিল ব্লুজরা। এবার সেই হ্যাজার্ডই গোল করে লিচেস্টারের ইতিহাস গড়ার অংশীদার হলেন। একেবারেই কম বাজেটের, তারকাবিহীন দলটি গত মৌসুমে কোনরকমে অবনমন থেকে রক্ষা পেয়েছিল অথচ এবার চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনালের মতো পরাশক্তিদের পেছনে ফেলে তারাই ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন! তাও আবার পুরো মৌসুমে দাপট দেখিয়ে। আগের ম্যাচে ম্যানইউকে হারাতে পারলে শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যেত লিচেস্টারের। কিন্তু ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র করায় অপেক্ষা বাড়ে ইংল্যান্ডের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত ছোট্ট শহরটির নাগরিকদের। তবে মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য। তার পরের ম্যাচেই ছোট্ট শহরটির মানুষদের আনন্দে ভাসানোর উপলক্ষ হয়ে আসে চেলসি-টটেনহ্যাম ম্যাচ ড্র হলে। শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো লিচেস্টার। শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার পর লিচেস্টারের অধিনায়ক ওয়েস মরগ্যান বলেন, খেলোয়াড়দের মধ্যে এই ধরনের স্পিরিট আমি আগে কখনই দেখিনি। আমরা একেবারে একে অপরের ভাইয়ের মতো সম্পর্ক গড়েছিলাম। লিচেস্টারের সাবেক স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকারও এই অর্জনকে অসম্ভব বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ক্লাবের ইতিহাসে এই ধরনের অর্জন আমি কখন চিন্তাও করিনি। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। লিচেস্টারের রেকর্ডগড়া সাফল্যের রূপকার কোচ ক্লাউডিও রানিয়েরি। গোটা ফুটবলবিশ্ব তাই ইতালিয়ান এই কোচকে স্যালুট জানাচ্ছে। ট্রফি নিশ্চিত হওয়ার পর রাস্তায় নেমে আসেন লিচেস্টারবাসী। কেউ কেউ রানিয়েরির নাম ধরে চিৎকার করেন, কেউ কেউ ভার্ডি, আবার কেউ কেউ সেøাগান দেন রিয়াদ মাহরেজের নামে। নীল-সাদা জার্সি পরে সবাই তখন আবেগে কাঁপছে, কেউ কেউ ভেঙ্গে পড়েছে কান্নায়। রূপকথার গল্পটা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে, লিচেস্টার সিটি সমর্থকরা হয়ত কোনদিনও ভাবতে পারেননি! ক্লাবের নীল-সাদা পতাকা উড়িয়ে, নেচে-গেয়ে শিরোপা উদ্যাপন করেছেন ভক্ত-সমর্থকরা। সবার মুখেই কোচ রানিয়েরির নামে জয়ধ্বনি। ইতিহাস গড়তে পেরে রানিয়েরি নিজেও আবেগাপ্লুত। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দারুণ গর্বিত। আমি আমার সব খেলোয়াড়, চেয়ারম্যান, ক্লাবের কর্মকর্তা, সমর্থক আর লিজেস্টার সম্প্রদায়ের জন্য খুবই খুশি। খেলোয়াড়রা ছিল এককথায় দুর্দান্ত। তাদের দৃঢ়তা, অবিচল মানসিকতা, সাহসিকতা সব কিছুর জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেক ম্যাচে তারা একে অন্যের জন্য লড়াই করেছে। তারাই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য। রূপকথার গল্প লেখাটা আগেই সম্পন্ন হয়। তবে নিজেদের ম্যাচ না থাকায় উৎসবটা ঠিকমতো করতে পারেনি লিচেস্টার সিটি। অবশেষে আনুষ্ঠানিক শিরোপা উৎসব করেছে ইংলিশ ফুটবলে চমক দেখানো ক্লাবটি। ১৩২ বছরের ক্লাব ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জয়ের পর ৭ মে রাতে লিচেস্টারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ইপিএলের ট্রফি। নিজেদের মাঠ কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে এভারটনের বিরুদ্ধে ম্যাচটা ছিল লিচেস্টারের শিরোপা জয়ের উৎসবে মেতে ওঠার উপলক্ষ। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামের দলটির দায়িত্ব নেয়ার আগে রানিয়েরি এর আগে পালন করেছেন এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, চেলসি, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলানের মতো বড় বড় ক্লাবের। কিন্তু কোনখানেই তিনি জিততে পারেননি লীগ শিরোপা। শেষ পর্যন্ত লিচেস্টার সিটির মতো একটি অখ্যাত ক্লাবের হয়ে যে সেই অসাধ্য সাধন করতে পারবেন, তা নিজেও ভাবতে পারেননি এই ইতালিয়ান কোচ। এভারটনের বিরুদ্ধে ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, আমি জানতাম যে কখনও না কখনও শিরোপা জিততে পারব। কিন্তু এটা যে এভাবে আসবে, তা ভাবতে পারিনি। এভারটনকে হারানো ম্যাচের পর লিচেস্টার সিটির হাতে ইপিএলের ট্রফি তুলে দেয়া হয়। ক্লাবের ১৩২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সাক্ষী হতে গ্যালারি ছিল সমর্থকে ঠাসা। মুকুট জয়ের প্রতিক্রিয়ায় রানিয়েরি বলেন, শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু অবশ্যই আমি ভেতরে ভেতরে দারুণ খুশি। এটা অবিশ্বাস্য অনুভূতি। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য দারুণ মুহূর্ত। কেননা, আমি নতুন নই এবং সামনে আরও একটা পরীক্ষা (চ্যাম্পিয়ন্স লীগ) আছে। প্রিমিয়ার লীগে আমরা চ্যাম্পিয়ন, এটা (আমার জন্য) বিশেষ কিছু। স্পেন ও ইতালিতে আমি কিছু ট্রফি জিতেছি কিন্তু এখানে জেতাটা চমৎকার। গর্বিত কোচ আরও বলেন, ক্যারিয়ারে আমি সবসময় ভেবেছি, আগে হোক, পরে হোক শিরোপা জিতব। কিন্তু শুরুতে আমিও ভাবিনি, এটা সেই জায়গা হবে।
×