ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এভাবেই মাঠে থাকুক খেলা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১১ মে ২০১৬

এভাবেই মাঠে  থাকুক  খেলা

বাবা আবদুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া) বড় প্লেয়ার ছিলেন। পরে দেশের সেরা কোচদের একজন। দেশসেরা স্টাইকার রাসেল মাহমুদ জিমির হকির সঙ্গে সম্পর্ক তাই জ্ঞান হওয়ারও আগে থেকে। তার ওপর বেড়ে ওঠা দেশের হকির সুতিকাগার পুরান ঢাকার আরমানিটোলার মতো এলাকায়। মনে হকির বীজ বুনতে আর কি লাগে! রাসেল মাহমুদ জিমি তাই নিজেও ভালভাবে মনে করতে পারেন না কখন কিভাবে মজে গিয়েছিলেন হকির প্রেমে। শুধু সেই দিনগুলো চোখে ভাসে, যখন হকি স্টেডিয়ামে এসে উত্তেজনার রেণু ছড়ানো কোন ম্যাচ উপভোগ করতেন। খেলা দেখতেন আর মনে মনে চাইতেন একদিন তিনিও স্টিক হাতে মাতাবেন হকির মাঠ, ‘ছোট বেলায় যখন খেলা দেখতাম তখন নিজের কাছে খুব ভাল লাগত। আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমার খেলাও কেউ একদিন আগ্রহ নিয়ে দেখবে।’ জিমির সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে অনেক আগেই। লীগ হোক বা টুর্নামেন্ট কিংবা আন্তর্জাতিক কোন ম্যাচ, হকির মাঠে প্রধান আকর্ষণ তিনিই। বাবার মতোই সেন্ট্রাল-ফরোয়ার্ড লাইনে খেলেন। মাঠের মধ্যখান থেকে খেলা তৈরি করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সকে চূর্ণ করে দেয়ার যে দক্ষতা এই ২৯ বছর বয়সীর, তা কেবল হকিপ্রেমীদের মনে মুগ্ধতাই ছড়ায়। কিন্তু একটা আক্ষেপও কুড়ে কুড়ে খায় অনেককে। এই জিমিদের প্রজন্মই দেশর হকির সবচেয়ে হতভাগা প্রজন্ম বলে! এত এত হকি প্রতিভার ছড়াছড়ি দেশে, অথচ তারা জনপ্রিয় এই খেলাকে এগিয়ে নেবেন কি, নিয়মিত খেলাই তো থাকে না মাঠে। ক্লাব এবং ফেডারেশন দ্বন্দ্বে তিন বছর লীগ মাঠে ছিল না। সদ্য শেষ হওয়া ক্লাব কাপ হকিও মাঠে গড়িয়েছিল দুই বছর পর। প্রধান চার ক্লাবের জোট বদ্ধ আন্দলনে ঘরোয়া হকি প্রায় মরতেই বসেছিল। সেই চার ক্লাবের দাবি পূরণ হওয়া তারা খেলায় ফিরেছে। প্রাণ ফিরেছে মৃত হকির শরীরেও। ক্লাব কাপ হকির ম্যাচকে উদ্দেশ করে জিমি তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতে পারলেন, ‘খেলা মাঠে ফিরছে এর মতো আনন্দের কিছু হয় না। দুটি সেমিফাইনাল এবং ফইনালে (ক্লাবকাপ হকি) প্রচুর দর্শক হয়েছে। সবাই যে হকিটাকে ভালবাসে এটা এ থেকেই প্রমাণিত। আজকে যদি প্রত্যেক বছরেই খেলাটা মাঠে থাকে, এমন উত্তেজনা থাকে তবে সবাই খেলাটা দেখতে আসবে। হকির পথও মসৃণ হবে। আমরা চাই প্রত্যেক বছরই এভাবে খেলাগুলো হোক।’ ‘খেলা মাঠে থাক’- একজন খেলোয়াড়ের এটাই সবচেয়ে বড় চাওয়া। বাংলাদেশের হকি খেলোয়াড়দের জন্য তো তা পরম আরাধ্য। ‘এই রোদ, এই বৃষ্টি’Ñএটাই যে এদেশের হকির প্রতিশব্দ। তার পরও খেলা মাঠে গড়ানোয় আশাবাদী হতে চান জিমি, ‘এখন সামনের দিকে তাকানো উচিত। তবে সবকিছু ফেডারেশনের ওপর নির্ভর করছে। এ বছর লীগটা হচ্ছে। খুব দ্রুতই তা মাঠে গড়াবে। এখন সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকা জরুরী। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব হলে হকি অবশ্যই এগিয়ে যাবে।’ আর তা না হয়ে ফের হোঁচট খেলে এর মতো হতাশার কিছু থাকবে না প্লেয়ারদের জন্য, ‘একজন প্লেয়ারের জন্য খুবই কষ্টের হলো খেলা মাঠে না থাকা। খেলা বন্ধ থাকলে প্লেয়ারদের ফিটনেস চলে যায়। তখন পুনরায় ফিটনেস লেভেল উপরের দিকে নিয়ে আসাটা কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই খেলা ছেড়ে দিয়ে জীবিকার জন্য অন্য কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের প্লেয়ারদের জন্য খারাপ এবং ভবিষ্যতে যে প্লেয়াররা তৃণমূল থেকে উঠে আসবে ওরাও এটা দেখে আগ্রহ হারাবে।’ অথচ এ দেশের হকিতে প্রতিভা এবং সম্ভাবনার কোন কমতি দেখেন না বিখ্যাত বাবার বিখ্যাত ছেলে জিমি, ‘হকি কিন্তু খারাপ কোন খেলা না। যদি তাই হতো তাহলে বিশে^র এতগুলো দেশ হকি খেলত না। আসলে আমাদের ম্যানেজমেন্টের কারণে আমরা সেই ভাবে খেলতে পারছি না। প্রচারও করতে পারছি না খেলাটাকে। অথচ এদেশে প্রতিভার কোন কমতি নেই। হকি দিয়েও ভাবিষ্যত গড়া সম্ভব। কিন্তু সেই দিকটাতে আমাদের উন্নতি করতে হবে।’ বলতে বলতে জিমি ফিরে যান তাঁর শুরুর সময়ে, ‘২০০৩ সালে যখন খেলা শুরু করি, তখন অনেক খেলা হতো। আমরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্ট খেলতাম। এখন সেই টুর্নামেন্টগুলোর সবই বন্ধ। ক্লাব ও ফেডারেশন সবাই মিলে সেই পরিবেশ আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। যখন এটা তৈরি হবে তখন হকির প্রতি সবাই আগ্রহী হবে। ক্লাব থেকে শুরু করে জেলা এবং স্কুল পর্যায়ে টুর্নামেন্ট করতে হবে ফেডারেশনকে। তা না হলে হকি টা আবারও পেছনের দিকেই যাবে। জিমির মুখে বার বার হকিকে পেছন থেকে আলোয় ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ আসছে। তার মানে হকি শুধু পিছিয়েছেই এতদিন। তার পরও মাঝে মধ্যেই আলোকবর্তিকার দেখা মিলত হকিতে। যা কখনও ধরে রাখা যায়নি। যায়নি বলেই আক্ষেপ আর হতাশা মিলেমিশে একাকার জিমির কণ্ঠে, ‘আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভাল পারফর্ম করে ২০১২ এবং ২০১৩ সালে আমরা যেভাবে হকিকে এগিয়ে নিয়েছিলাম, এখন আবার কিন্তু আমরা সেখান থেকে একেবারে নিচে নেমে এসেছি। অথচ উচিত ছিল আমাদের আরও ওপরে যাওয়া। আমরা তা পারিনি।’ কেন যেতে পারেননি তা সবার জানা। কিন্তু এখন যেহেতু নতুন করে শুরুর স্বপ্ন দেখছেন সবাই তাই জিমিও থাকতে চান সামনে। আর তাই বিশেষ দিকগুলোতে নজর দিতে বলেন বেশি করে, ‘এখন একজন ভাল কোচের অধীনে যদি প্লেয়ারদের তৈরি করা হয় এবং জাতীয় দলের ব্যাকআপ টিম হিসেবে অনুর্ধ-২১ দলকে প্রস্তুত রাখা যায় তবে আবার সেই দিন ফিরে পাওয়া সম্ভব। অনুর্ধ-২১ পর্যায়ে এখন অনেক প্লেয়ার। এখন যদি এরা খেলতে না পারে, তাহলে দিন দিন ওদের পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যাবে।’ ক্লাব কাপ হকি শেষে এবার লীগ শুরুর পালা। নীল টার্ফে প্রথম লীগ হতে যাচ্ছে এবার। মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে এই নীল টার্ফ বসেছিল এক বছরেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু বাংলাদেশ হকির জন্য এই টার্ফ হয়েছিল শুধুই বিশাদের রং হয়ে। তবে বিশাদ কিংবা কালো মেঘ আবার সরে যেতে শুরু করেছে। ক্লাব কাপ হকির প্রতিদ্বন্দ্বিতা আভাস দিয়েছে জমজমাট একটা লীগের। আবাহনী, মোহামেডান, ঊষা, মেরিনার্স যেমন দল গড়েছে তাতে কার ঘরে শিরোপা যাবে তা হিসাব করা কঠিন। দলগুলোতে বিদেশীদেরও ছড়াছড়ি। ঘরোয়া হকির ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ বিদেশী খেলছে এবার। ফেডারেশন প্রতি দলে ৫ জন বিদেশী নিবন্ধন করে ৫ জনকেই খেলানোর অনুমতি দিয়েছে। যা নিয়ে জিমির কণ্ঠে হতাশা, ‘এটা আত্মঘাতী একটা সিদ্ধান্ত। বিদেশী কম হওয়া উচিত ছিল। একটা টিমে যদি পাঁচজন বিদেশী খেলোয়াড় খেলে তবে দেখা যায় জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বসে আছে। এখানে বিদেশীদের কোটা কম হলে দেশী খেলোয়াড়ের ডিমান্ট অনেকে ভাল থাকত। আমি এই ব্যাপারটায় একটু নজর দিতে ফেডারেশনকে অনুরোধ করব, যেন বিদেশী কোটা কমানো হয়। মৌসুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ক্লাব কাপ হকি ছিল মূলত লীগের প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট। যাতে ঊষা ক্রীড়া চক্রকে হারিয়ে আট বছর পর শিরোপা জিতেছে আবাহনী। জিমির দল মোহামেডান সেমিফাইনালে কাটা পড়ে ঊষার কাছে। তবে লীগে নিজেদের সেরাটা প্রমাণ তরতে চান তিনি, ‘যেহেতু তিন বছর পর লীগ খেলছি। চেষ্টা করব আমার সর্বোচ্চটা দেয়ার। আমি মোহামেডানের হয়ে খেলছি, তাই সেভাবে নিজেকে তৈরি করব যেন দলকে শিরোপা এনে দিতে পারি।’ তার আগে এই তারকার বড় চাওয়া লীগটা যেন ভালমতো শেষ হয়, ‘ভাল একটা লীগ হবে এটা সবাই চায়। প্রধান চাওয়াটা হলো যেন কোন ঝামেলা না হয়। আমরাও আশা করি ভাল কিছু হবে। প্রত্যেকবারই যদি নেগেটিভ কিছু হয় তবে সবাই হকির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।’ আমার এবার সবকিছু ভালভাবে হবে।’ হকির এতসব হতাশার মাঝে জিমির হতাশা একটু বেশিই ছিল। কারণ নিজে বহিষ্কার হয়েছিলেন হকি থেকে। খারাপ সময় পেছনে ফেলে পুনরায় মাঠে নামতে পেরে খুশি তিনি, ‘এটা আমার জন্য অনেক খারাপ সময় ছিল। সবাই খেলছে আর আমি খেলতে পারতাম না। আল্লাহর রহমতে ব্যাক করতে পেরেছি এটাই হচ্ছে বড় কথা। সেই সময়টায় তো আমি হকি দেখা সম্পূর্ণ বাদই দিয়েছিলাম। কারন খুব খারাপ লাগত তখন। সবাই খেলছে আর আমি খেলতে পারছি না, খেলোয়াড় হিসেবে এর মতো কষ্টের কিছু হয় না। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তখন।’ সেখান থেকে জিমি ফিরে এসেছেন। গত এসএ গেমসেই খেলেছেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে। এখন খেলছেন ঘরোয়া হকিতে। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফায় কিছু খেলোয়াড় যোগ দিয়েছেন সার্ভিসেস টিম নৌবাহিনীতে। যার মধ্যে জিমিও একজন। এর পক্ষ এবং বিপক্ষ দুই দিকেই মত আছে অনেকের। তবে জিমি এর ইতিবাচক দিকই দেখেন, ‘এর ভালটাই বেশি। নৌবাহিনীর মতো একটি টিম আমাদের অফার দিয়ে, জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে নিচ্ছে। এতে করে আমাদের কিন্তু অন্য কিছু চিন্তা করতে হয় না। এ রকম প্রাইভেট কোম্পানিগুলোও যদি প্লেয়ারদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে খেলোয়াড়রা কিন্তু অন্য কিছু চিন্তা করবে না। তখন খেলাটা তাদের আরও ভাল হবে। অনেকে ভাবছে লীগ হচ্ছে না বলে হয়ত আমরা অন্যদিকে চিন্তা করছি। এটা আসলে ঠিক নয়। এখন তো বাহিনীর খেলোয়াড়রাও লীগ খেলতে পারছে। অনেকেই হয়ত খারাপ চোখে দেখছে। এখন খেলা না হলে আমাদের বিপল্প তো ভাবতে হবেই।’ তবে ক্লাবগুলোও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন বলে মনে করেন জিমি, ‘মোহামেডান বলেন আর আবাহনী বলেন, এই ক্লাবগুলোর কিন্তু বড় বড় ডোনার আছে। ওনারা যদি বাহিনীর মতো প্লেয়ারদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তখন খেলোয়াড়রা অন্য কিছু ভাবার চিন্তা করবে না। তখন তারা ক্লাবগুলোর হয়ে দীর্ঘ সময় পারফর্ম করে যেতে পারবে।’ সেটা হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে একটা ক্ষেত্রে কোন প্রশ্ন থাকা উচিত নয় বলে মনে করেন জিমি। নীল টার্ফের পর এবার ফ্লাড লাইটটা খুব প্রয়োজনটা দ্রুত মেটানো উচিত বলে মনে করেন জিমি, ‘বিশে^র কোথাও এখন দিনের বেলায় খেলা হয় না। গরমের সময় দিনের বেলায় খেলা হলে খেলোয়াড়রা নিজের পারফরমেন্সটাও শো করতে পারে না। ফ্লাডলাইট হলে আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের পথও তৈরি হবে।’ সেই পথ সুগম করার দিকে কি হাঁটবে ফেডারেশন?
×