ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২৫০ বছরের পুরাকীর্তি

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য- নতুন রূপে রাধা কালাচাঁদ মন্দির

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১০ মে ২০১৬

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য- নতুন রূপে রাধা কালাচাঁদ মন্দির

নিরঞ্জন পাল ------------- অন্তত আড়াই শ’ বছরের প্রাচীন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এতকাল পরও মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। শুধু যেটুকু লক্ষণীয় বিষয়, তা হলো দীর্ঘ সময়ের বিবর্তনে এবং প্রয়োজনীয় যতœ-আত্তি ও পরিচর্যার অভাবে জীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিল এই পুরাকীর্তিটি। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এখানে আসত অসংখ্য হিন্দু নারী-পুরুষ। কারণ এটি তাদের কাছে প্রাণের চেয়ে প্রিয় ধর্মীয় উপাসনালয়। স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের পুজো-অর্চনার একমাত্র পীঠস্থান এই মন্দিরটি। নাম রাধা কালাচাঁদ মন্দির। এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এটি সংস্কারের। টাঙ্গাইল জেলার পাকুল্যার আলোচ্য রাধা কালাচাঁদ মন্দিরটি এখন সংস্কার করে নতুন রূপে নতুন সাজে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। নিপুণ কারুকাজসমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মন্দিরটি এলাকার মানুষের কাছে এখন বাংলার স্বর্ণ মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্থাপত্যশৈলীতে ভরপুর মন্দিরটির নির্মাণ কাজও অবশেষে সমাপ্ত হয়েছে। আর তাই সোমবার বিকেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা মন্দিরটি উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বক্তৃতা করেন ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. অর্ধেন্দু শেখর রায়, কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পরিচালক ভাষা সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক ও মন্দির কমিটির উপদেষ্টা ডাঃ দুলাল চন্দ্র পোদ্দার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাসুম আহমেদ ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস প্রমুখ। এই শ্রী শ্রী রাধা কালাচাঁদ মন্দির উদ্বোধনের পরপরই এখানে ভিড় জমে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর। জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের পাকুল্যা গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী রাম মোহন সাহা ও গৌর মোহন সাহা ১১৯৫ বঙ্গাব্দে শ্রী শ্রী রাধা কালাচাঁদ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে গীতাপাঠ, মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা ও ঝুলনযাত্রাসহ সারা বছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এর আগে একতলা পাকা মন্দিরটি দুই বার সংস্কার করা হয়। সম্প্রতি এলাকার সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিরা মন্দিরটিকে বাংলাদেশসহ দেশ-বিদেশে অন্যতম কারুকার্যসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেন। চার বছর পূর্বে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মন্দিরটি নতুন রূপে নির্মাণ কাজ শুরু করেন তারা। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতসহ বেশকিছু দেশের মন্দির পরিদর্শন করে মন্দিরটির নক্সা তৈরি করা হয়। মন্দিরটি নির্মাণে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে কারুশিল্পী আনা হয়। এছাড়া ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিল্পীরা ছাড়াও দেশের নামকরা কারুশিল্পীদের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে এটি নির্মাণে। মন্দিরটির মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিকৃতি নিপুণভাবে তৈরি করা হয়েছে। পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য মন্দিরটিতে সোনালি রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছে। দূর থেকে মনে হয় এটি একটি স্বর্ণ খচিত মন্দির। অনেকে এই মন্দিরটিকে বাংলার ‘স্বর্ণ মন্দির’ হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন। মন্দিরটি নির্মাণ করতে এক কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে জানান এর অন্যতম উদ্যোক্তা সুরঞ্জন শেঠ তাপস। লেখক ও কবি পাকুল্যা গ্রামের বাসিন্দা গোপাল চন্দ্র কর্মকার বলেন, নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন ও স্থাপত্যশৈলীতে পরিপূর্ণ মন্দিরটি শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হবে না। আলোকিত ও বিকশিত জীবন ব্যবস্থা সম্পন্ন মানুষও সৃষ্টি হবে এখান থেকে। বিশিষ্ট ওষুধ ব্যবসায়ী তপন কুমার শেঠ বলেন, নবনির্মিত মন্দিরটিতে সোনালি রঙের প্রলেপ দেয়ায় মন্দিরটি বাংলার স্বর্ণ হিসেবে আমাদের কাছে মনে হয়। যেভাবে মন্দিরে যাবেন ॥ যানবাহনযোগে মন্দিরটিতে যেতে হলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্যা বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে পাকুল্যা বাজার হয়ে ঐতিহাসিক মতিবিবির মসজিদের কাছ দিয়ে জমিদার বাড়ির পেছন হয়ে হেঁটে পৌনে এক কিলোমিটার পশ্চিমে মন্দির প্রাঙ্গণে যাওয়া যায়। এছাড়া রিক্সাযোগেও মন্দিরে যাওয়া যায়। সমস্যা ॥ ঐতিহাসিক শ্রী শ্রী রাধা কালাচাঁদ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করে দৃষ্টিনন্দন করা হলেও মন্দিরটি ঘিরে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মন্দিরে যাতায়াতের রাস্তার সমস্যা। মন্দিরে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি মাত্র সরু কাঁচা রাস্তা। এছাড়া মন্দিরের সামনে নাট মন্দির, ভক্তদের থাকার ঘর, ভোগঘর এবং পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। মন্দির কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দেব চন্দ্র সাহা ও সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সাহা বলেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তদের আসার সুব্যবস্থার জন্য মন্দিরের পূর্বপাশ দিয়ে পুকুরের পাড় ঘেঁষে একটি রাস্তা নির্মাণ করা জরুরী। এছাড়া মন্দিরের সামনে নাটমন্দির নির্মাণসহ অনেক উন্নয়ন কাজ করা প্রয়োজন। এতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তারা উল্লেখ করেন। এ এলাকার বাসিন্দা মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ দুলাল চন্দ্র পোদ্দার বলেন, মন্দিরটি এলাকাবাসীর নিজের প্রচেষ্টায় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
×