ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনী সহিংসতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১০ মে ২০১৬

নির্বাচনী সহিংসতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

শাহীন রহমান ॥ ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার মূলে রয়েছে মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া থেকেই এ দ্বন্দ্বের শুরু। যার পরিণতিতে নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ইসির পক্ষ থেকে বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত একেবারে সহিংসতামুক্ত পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দাবিÑ প্রথম দিককার নির্বাচনের চেয়ে সহিংসতার তীব্রতা কমে আসছে। তাদের মতে, দলীয় কোন্দলই ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার বড় কারণ হিসেবে দেখা গেছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে তা মূলত রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, পাশাপাশি রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এছাড়া বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পর্যবেক্ষক সংস্থারও দায়িত্ব রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাসহ সবারই দায় আছে নির্বাচন সুষ্ঠু করার। নির্বাচনে যে সহিংসতা ঘটছে তা মূলত সামষ্টিক ব্যর্থতা। কেন এবং কোন প্রেক্ষিতে এসব হচ্ছে তা বের করতে হবে। তিনি বলেন, সহিংসতা ধাপে ধাপে বেড়েই চলেছে। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ভোটের নামে চলমান প্রাণ সংহারের দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। এবার অনেক স্থানেই চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা গেছে। তাদের মধ্যে সংঘাতেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রথম থেকেই ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় জড়িত রয়েছে সরকার দলীয় প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এ কারণে চার দফা নির্বাচনে সহিংসতার যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা মূলত সবাই সরকারী দলের সমর্থক নেতা ও কর্মী। ব্রতীর পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রথম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে সরকারী দলের স্থানীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ মূলত দলীয় কোন্দল। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে চার দফায় ইউপি নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৭০ জনের বেশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সহিংসতাই ঘটেছে তা মূলত সরকারী দলের মধ্যে। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিবদমান গ্রুপের মধ্যে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনার বেশিরভাগ ঘটেছে আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ঘটেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে সহিংতার জন্য একা কোন সংস্থা দায়ী নয়। তাদের মতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারী দলের দায়িত্ব রয়েছে অনেক বেশি। যদিও দুই দফায় নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ইসিতে বার্তা দিয়ে বলা হয়েছিল, ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা হোক প্রধানমন্ত্রী তা চান না। সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও ইসির প্রতি আহ্বান জানায় তারা। যদিও তখন ইসির পক্ষ থেকে ক্ষমতসীন দলসহ এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় দফায় এ বিষয়ে কাক্সিক্ষত সহযোগিতা না পেয়ে ইসির পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সব পক্ষের দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যেমন দায়িত্ব রয়েছে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়ে ইসিকে সহযোগিত করা। কিন্তু চার দফায় নির্বাচন শেষে দেখা গেছে যে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘঠছে তার দায়দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না। এমনকি বিভিন্ন পক্ষ থেকে নির্বাচনে সহিংসতার জন্য সরাসরি ইসিকে দোষারোপ করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে সহিংসতার দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থান নিতে পারেনি যা উদাহরণ হিসেবে দেখা হতে পারে। ইউপি নির্বাচনের রক্তপাতের জন্য বিএনপি প্রথম থেকেই সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেই দোষ দিয়ে আসছেন। যদিও এর পাশাপাশি তারা ক্ষমতসীনদের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতি কেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনছেন। তবে ভোট সুষ্ঠু ন করার ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত ইসির ওপর চাপাচ্ছে দলটি। এদিকে সাংবিধানিক ক্ষমতার দোহাই দিয়ে নির্বাচন সংঘাতমুক্ত রাখার দায়িত্ব ইসির উপরই চাপাচ্ছে ক্ষমতাসী দল আওয়ামী লীগ। আবার ইসির পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তৃত্ব করতে না পেরে সহিংসতার জন্য সরকারের দিকে অভিযোগ করছে নির্বাচন কমিশন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেছে। এদিকে প্রতিবার নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিই এর প্রমাণ দেয়। চার দফায় নির্বাচন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম দফায় সহিংসতার ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। এতে প্রথম দফায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৯ জনের। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের দিনও ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার পেক্ষিতে কমিশন নির্বাচন নির্বিঘœ করতে পুনরায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসে। বৈঠকে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষায় কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী প্রদান করা হয়। ইসির এ কঠোর অবস্থানের কারণে তৃতীয় দফায় নির্বাচন চলাকালে কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে চতুর্থ দফায় এসে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও আগে দু’দফার চেয়ে সহিংসতা ছিল কম। চতুর্থ দফায় নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল এমন একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর পর্যক্ষেণ বলছে, এ দফায় নির্বাচনে জাল ভোট, ব্যালট ছিনতাই, প্রকাশ্যে সিল দেয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা প্রথম ধাপগুলোর তুলনায় অনেক কম ঘটেছে। বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সংঘর্ষে ৩ জনের মৃত্যু ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকসহ প্রায় ১২০ জন আহত হয়েছে। এ দফায় নির্বাচনে যারা জাল ভোট দেয় এবং অনিয়মের অভিযোগে জড়িতÑ তাদের আটক ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্বে থাকা ওসি এসপি তলব করাসহ হুইপ ও সাংসদদের নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের নোটিস দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন চতুর্থ দফায় ভোটের একদিন আগে রাজশাহীর বাগমারায় ১৬টি ইউপির নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে মূলত ওই এলাকার একজন সাংসদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার কারণে। এমনকি সংশ্লিষ্ট ওই সাংসদকেও শোকজের নোটিন দেয়া হয়। তবে ওই এলাকায় ১৬ ইউপিতে নির্বাচন স্থগিতের ঘটনা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ২ জনের মৃত্যু হলেও চতুর্থ দফায় নির্বাচনের সঙ্গে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। ব্রতীর পর্যবেক্ষণ বলছে, চতুর্থ দফায় নির্বাচনের বেশ কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। এ দফায় নির্বাচনের সহিংসতা ছিল আগের দফাগুলোর চেয়ে নিম্নগামী। কেন্দ্র দখল ও বহিরাগতদের নির্বাচনী কেন্দ্রে উপস্থিতি ছিল কম। সরকারী দলের সংসদ সদস্যসহ যারা নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করেছেন অথবা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় একই কারণে নির্বাচন স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশন তৎপর থেকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এমনকি নির্বাচন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। নারী ও সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ছিল ভাল। তাদের পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন দিনের পরিবেশের অনেক উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে চতুর্থ দফা নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় থেকে নিয়ম প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট দেখা গেছে। তারপর কাক্সিক্ষত মানদ-ে পৌঁছাতে পারেনি এ দফা নির্বাচন। সংস্থটির মতে, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সহিংসতামুক্ত পরিবেশের আয়োজন করতে পারেনি। চতুর্থ দফায় তাদের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। তারা বলছেন, নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা কমে এলেও অনিয়মমুক্ত নির্বাচন অর্জন করা যায়নি। অনেক এলাকায় প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচন কর্মকর্তাদের সামনে জালভোট দিতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তার ভূমিকা নিয়েছে। নারী-পুরুষ ভোটার উপস্থিতি ভাল হলেও নবীন ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। সরকারী দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে মনোনীত প্রার্থীর সংঘর্ষ এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। তাদের তুলনামূলক বিচারে বলা হয়েছে, পূর্বের তিন ধাপের চেয়ে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
×