ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১০ মে ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

রবিবার। একদিনে দুটি বর্ণিল ইভেন্ট। রবিবার রবিকবির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী। আবার এই দিন ছিল মা দিবসও। রবিবার সন্ধেবেলা রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোন অনুষ্ঠানে যাবÑ রবীন্দ্রময় শহরে ছিল সত্যিই ভাবনার বিষয়। একটাতেই যাওয়া সম্ভব। ফলে অন্যগুলো নির্ঘাৎ মিস হবে। শাহবাগে পাঁচদিনব্যাপী আয়োজন চলছে, প্রথম দিন গিয়েছিলাম; ধানমন্ডিতে ছায়ানটের আয়োজনের আলাদা আকর্ষণ আছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানই বেছে নিলাম। গিয়ে ঠকিনি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমবেত নৃত্য উপভোগ করা গেল। রোকাইয়া হাসিনা, জলি রহমানের গান অনেককাল পরে শুনলাম। বেশ লাগল। কোন পাঠক হয়তো মনে করিয়ে দেবেন, রবিবার তো দিনে-রাতে হরতাল ডেকেছিল রাজাকারের দল। তা ডেকেছিল বৈকি। একাত্তরে লাখো মায়ের বুক খালি করেছিল যে কুলাঙ্গারেরা, তাদের কমান্ডারের ফাঁসির রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর মা দিবসেই তারা হরতাল ডাকল। কিন্তু রাজধানীতে যে এই হরতালের বিন্দুমাত্রও প্রভাব পড়েনি, রীতিমতো যানজট ছিল সপ্তাহের এই প্রথম কর্মদিবসে। দেশের উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা। আচ্ছা, কী সাংঘাতিক কথা! এ ব্যাপারে আদালতের কি কিছুই করণীয় নেই? দুই নগরপিতার ১ বছর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুটি ভাগে ভাগ করার পর মেয়র নির্বাচন হয়েছে। আমরা পেলাম জোড়া মেয়র। উভয়ে এক বছরও পূর্ণ করে ফেললেন। তাদের নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হলো গত শুক্রবার, ৬ মে। বেশ একটা চমক দেখিয়েই তারা পার করলেন এক বছর। কাজের কাজ যে কিছুই হয়নিÑ এমন কথা নিন্দুকেরাও বলবেন না। আবার কাজের চেয়ে কথাও একটু বেশিই বলেছেন, এমন কথাও অস্বীকার করবেন না তাদের অনুরাগীরাÑ এটুকু সাধারণ নাগরিকরা প্রত্যাশা করতেই পারেন। রাজধানী শহরের সমস্যা আকাশ সমান। জনসংখ্যার উৎকট চাপ, নগর ব্যবস্থাপনার মারাত্মক দুর্বলতা, ট্রাফিক ব্যবস্থায় প্রায় নৈরাজ্য, পানি-বিদ্যুতের আকাল, মশা-মাছি-আবর্জনা, ছিনতাই, জলাবদ্ধতা সবকিছু নিয়ে ঢাকা একরকম দুঃস্বপ্নের নগরই বলা চলে। তবে এর ভেতর মেয়রদ্বয় কিছু সুসংবাদ এনে দিয়েছেন বটে। কাউন্সিলরদের যে বড় অংশ দলীয় লোক, তারা আগের মতো টেন্ডারের কাজ না পেয়ে ক্ষুব্ধ। কারণ ই-টেন্ডার চালু করায় এখন টেন্ডারের বাক্স দখল ও ঠিকাদারদের বাধা দেয়া যাচ্ছে না। অনলাইনে দরপত্র জমা হচ্ছে এবং পেশাদার ঠিকাদাররা ঘরে বসেই বিল পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি, উভয় মেয়রই যথেষ্ট আন্তরিক। সত্যি তারা মহানগরীর সমস্যাগুলোর সমাধান চান। তবে এজন্য তাদের আরও তৎপর দেখতে চায় নগরবাসী। ধুলোর রাজত্ব থেকে শহরকে কিভাবে তারা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবেনÑ সে ব্যাপারে তাদের কোন উদ্যোগই চোখে পড়েনি। রাস্তায় রাস্তায় ছোট ছোট ঝুলন্ত বিন দেখা যাচ্ছে মেয়রদ্বয়ের বর্ষপূর্তির উপহার বলেই মনে হচ্ছে এসব। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে খোলা ডাস্টবিনের বাস্তবতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। রাস্তার মাঝখানে কিংবা পাশে বিশাল কন্টেনার হয়ে উঠেছে খোলা ভাগাড়। আর তার কাছাকাছি পুতুলের মতো শোভা পাচ্ছে ময়লা ফেলার ছোট্ট পাত্র। একে প্রহসন বা ঠাট্টা হিসেবে দেখছেন অনেকেই। আর ঠাট্টা যদি নাও বলি, শোপিস নিশ্চয়ই বলা যাবে। যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় বর্জ্য উপচেপড়া কন্টেনার নেই, সে শহরের সড়কে সড়কে ২০০ মিটার পরপর ময়লা ফেলার বিন নিশ্চয়ই সমালোচনার বিষয় হবে না। মেঘবৃষ্টির লুকোচুরি ঢাকা বা অন্য কোন শহরে নয়, চমৎকারভাবে বৃষ্টি উপভোগ করা যায় শুধু গ্রামেই। অবশ্য গ্রাম আর নেই সেই আগের গ্রাম, বাঁধানো ছবির মতো অপরূপ। তবু এখনও গ্রামে আছে সবুজ প্রান্তর, ধানক্ষেত, গাছগাছালির সমাবেশ, এমনকি ভাগ্যবতী অনেক গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতিরে নদী। প্রায় রুদ্ধস্রোতের, কিংবা বিগতযৌবনাÑ যাই হোক না কেন, তবু তো নদী। তাই বলে কি রাজধানীর বৃষ্টি একেবারেই উপভোগ্য নয়! অবশ্য এটা নির্ভর করে ব্যক্তির অবস্থানের ওপর। ঘরে না বাইরে, রাজপথে নাকি রিকশা বা কোন যানবাহনের ভেতর আপনার অবস্থান। এতসব কথা বলতে হচ্ছে গত সপ্তাহের একাধিক দিনে ও রাতে বৈশাখী বৃষ্টির ছটায় শরীর-মন জুড়িয়ে যাওয়ার কারণে। সেদিন বিকেলের দিকে চারদিক অন্ধকার করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসায়। আষাঢ়ের প্রথম দিন হলে না হয় বিষয়টা মানিয়ে যেত। কাব্যও করা যেত। মোটরসাইকেলের হর্ন এবং আবাসনযজ্ঞ পরিবেশ অধিদফতরের একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আকারে। শব্দদূষণ কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করলে কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়Ñ এটা লক্ষ্য করার মতো! আসলেই রাজধানীর শব্দদূষণ সহ্যক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে বহুকাল আগেই। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গাড়ির চালককে অপ্রয়োজনে হর্ন না বাজানোর জন্য আরোহীদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। অথচ সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ করছে মোটরসাইকেল। এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে কোন নির্দেশনা না থাকাটা আশ্চর্যজনকই বটে। শব্দদূষণের অপরাধ সংঘটিত হলে প্রথমবারের জন্য দোষী ব্যক্তির এক মাস কারাদ- কিংবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। শব্দদূষণ রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের কথা ভাবতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। শুধু অনুরোধ ও পরামর্শে যখন কোন কাজ হচ্ছে না, তখন আইন প্রয়োগ ছাড়া আর উপায় কী? শব্দদূষণের ফলে শিশুদের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমরা জেনেও চুপটি করে থাকছি। শব্দদূষণ শুধু কানের ওপরেই আঘাত হানছে না, এটি রক্তচাপের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। হৃদযন্ত্রের কম্পনও বাড়িয়ে দেয়। আবাসিক এলাকায় আরও এক ধরনের শব্দদূষণ চলে যা আমরা মুখ বুজেই সহ্য করে যাই। সেটি হলো নতুন বহুতল ভবন ওঠার সময় বালু-সিমেন্ট ও ইটের টুকরোর মিশ্রণ তৈরি প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে ঝালাই মেশিন থেকে উৎপন্ন শব্দও তীব্রভাবে শব্দদূষণ করে থাকে। ভবন নির্মাণকালে এইসব অসহনীয় শব্দদূষণ থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথই কি খোলা নেই? মা দিবসে প্রতিক্রিয়া ফেসবুকে বিশেষ বিশেষ দিবস হয়ে ওঠে ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’। যেমন মা দিবসে মায়ের প্রতি ভালবাসায় ভরে উঠেছিল ফেসবুক প্রাঙ্গণ। আবার একটি বিশেষ দিবসকে উপলক্ষ করে মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনকে ‘আদিখ্যেতা’ হিসেবে দেখার লোকেরও অভাব নেই। এখানে একজন মা ও একজন বাবার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরছি। মা-টি বছর দুয়েক হলো মা হয়েছেন। দ্বিতীয় লেখাটির লেখক একজন শিশুসাহিত্যিক। ক. মা হয়েছি ভাল কথা। এসব আদর্শ স্ট্যান্ডার্ডের মা না হলেই হলো। পানি দূষিত করে পানি দিবস, বায়ু দূষিত করে বায়ু দিবস, নদী দূষিত করে নদী দিবস- এই রকম মায়েদের নিচে নামিয়ে মা দিবস উদ্যাপন দেখে মনে হয় যারা মা হয় নাই তারাই ভাল আছেন। মায়েরা বড়ই অসহায়। আজকালকার ধন্যবাদে তারা আরও অসহায় হন। খ. মায়ের জন্য শুধু যে একটি মাত্র দিন থাকবে তা আমি মানি না। কিন্তু ওয়াসিফ-এ-খোদার জন্য দিনটি উদ্যাপন চাকরিসূত্রে বাধ্যতামূলক বলে মাকে নিয়ে যে কারও একটি লেখা তার দরকার। সেজন্যে সে আমাকে লিখতে বলেছে। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম মাকে নিয়ে লেখা প্রায় অসম্ভব। কারণ মা তো আমার সঙ্গে সবসময় আছেন। জীবনমরণের সীমানা পেরিয়ে গিয়েও তিনি আমার কাছছাড়া হন না। তাঁর অভাব না হলে কী করে বেদনার ঘায়ে নীল হব। বেদনা ছাড়া যে শিল্পের জন্ম হয় না! ওয়াসিফ যখন একটি ছড়া বা কবিতা লিখতে বলল তখন আমি মাকে বললাম, ‘আম্মা আপনাকে নিয়ে কী করে লিখব? আপনি আমাকে ছেড়ে চলে না গেলে ওয়াসিফকে কীভাবে সামাল দেব?’ আম্মা একটু হাসলেন। বললেন, ‘থাক, আমাকে নিয়ে তোর লেখার কোন দরকার নেই, তুই আমার কোলেই থাক।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি আসছি! তবে তার আগে ওয়াসিফকে সেই কথাটাই জানিয়ে দিই!’ এখন মায়ের কোলে যেতে যেটুকু সময় প্রয়োজন সেটুকুই অপেক্ষা। বেপরোয়া ছিনতাই চলছেই কয়েক সপ্তাহ আগে একবার লিখেছি এ নিয়ে। সেটি ছিল রাতের বেলার ঘটনা। কিছুটা নির্জন হয়ে এসেছিল ওই পথ। কিন্তু এবারকার ঘটনাটি দিনেদুপুরের, ব্যস্ত সড়কের। রিক্সার সওয়ার এক ভদ্রমহিলার দুই হাতে ধরে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ কেড়ে নিয়েছে হাত দুখানি সরিয়ে মোটরসাইকেলঅলা ছিনতাইকারী। তারপর সহযোগী ছিনতাইকারী চালক লোকটি জোরে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে জোর গলায় হাঁক পাড়তে লাগলÑ ওই ধর ধর, বেটা চোর পালাচ্ছে...। রাজধানীর ছিনতাইকারীরা কত টেকনিকই না জানে! বৃক্ষহত্যার মহোৎসব রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় এখন চলছে বৃক্ষ হত্যার মহোৎসব। পয়ঃনিষ্কাশন লাইন বসানোই শুধু নয়, আজগুবি সব দোহাই দিয়ে গাছ কাটা চলছে। এমনিতেই ঢাকায় গত দুই দশকে গাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। তার ওপর এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটা চললে শহর তার সবুজাভা হারাবে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সঙ্কটের কথা না হয় থাক, কিন্তু শান্তিময় ছায়া আর তাপহরাবান্ধব যে কমে যাবে, সেকথা আর বলে কী হবে! বৃক্ষহন্তারকদের আমরা থামাব কিভাবে? হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ভেতরের শত গাছ কাটার অজুহাত কী শুনবেন? গাছের জন্য হাসপাতালের দেয়াল দেখা যায় না, তাই হঠাও গাছ। কেউ শুনেছে কোথাও এমন আজগুবি কথা! ভাবছিলাম ওখানকার হীরক রাজাটি কে? ৮ মে ২০১৬ [email protected]
×