ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস আজ

দেশে বছরে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে এ রোগ নিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ মে ২০১৬

দেশে বছরে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে এ রোগ নিয়ে

নিখিল মানখিন ॥ পঞ্চম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র রূপক আহম্মেদ রাজন (১১) দুরারোগ্য ব্যাধি থ্যালাসেমিয়ায় (ব্লাড ক্যান্সার) আক্রান্ত। বর্তমানে সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ জন্য প্রয়োজন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু শিশুটির মাতা-পিতার পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাজনের বাবা রাজু আহম্মেদ বাসে বাসে ফেরি করে খাতা, কলম ও মানিব্যাগ বিক্রি করে সংসার চালান। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। শিশুটির মূল চিকিৎসা শুরু করতে পারছেন না তার অসহায় মাতা-পিতা। এভাবে রাজনের মতো হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে না পেরে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ের চিকিৎসা হচ্ছে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন। গত কয়েক বছর ধরে সীমিত পরিসরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চলছে। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন চালু হলেও তা দেশের রোগীর তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। তাছাড়া এই কার্যক্রম এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। সাত বছরের শিশু ইয়ামিন মারণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। শুধু বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করালেই বাঁচানো যাবে ইয়ামিনকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ড. এবিএম ইউনূস ইয়ামিনের বাবা নূরুল আজিজকে বলেছেন- তাকে যতদ্রুত সম্ভব বোন মেরো ট্রান্সপ্লান্টই করাতে হবে। তবে বেঁচে যাবে সে। এতে খরচও পড়বে অনেক! ভারতেই এ চিকিৎসা করালে লাগবে ৫০ লাখ টাকা। বর্তমানে এ হাসপাতালেই ডি ব্লকের ১৫তলার হেমাটোলজি বিভাগে আছে ইয়ামিন। সিদ্ধিরগঞ্জ, নয়াআটি এলাকার একটি স্কুলের দ্বিতীয় শেণীতে পড়ত ইয়ামিন। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুল থেকে বাড়িতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নারায়ণগঞ্জ মেডিপ্লাস মেডিক্যালে পরীক্ষা করা পর ডাক্তার ইয়ারি মাহাবুব তাকে রেফার করেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ এবিএম ইউনূসের কাছে। গ্রীন রোডের গ্রীন ভিউ ক্লিনিকে চিকিৎসারত অবস্থায় মার্চ মাসে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার। এতদিন ক্যামোথেরাপি চলছিল। কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় তাকে নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নূরুল আজিজ চৌধুরী এবং গৃহিণী মা সর্বস্ব দিয়ে চিকিৎসা খরচ চালিয়ে এখন নিঃস্ব। টাকার অভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিশু ইয়ামিনের চিকিৎসা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রক্তরোগবিদ্যা (হেমাটোলজি) বিভাগের প্রধান ও হাসপাতালটির বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটের প্রধান এম এ খান জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিটের মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, লিম্ফোমা, সিভিয়ার এ্যাপ্লাস্টি এ্যানিমিয়াসহ জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। সফলভাবে কর্মসূচীটি অব্যাহত রাখা গেলে রোগীরা অল্প খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা পাবেন। তাঁদের আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অনেক রোগী অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করানোর ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকা মেডিক্যালে স্থাপিত বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ইউনিটের মাধ্যমে বর্তমানে সীমিত সংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক এম এ খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। বংশগত এই রোগ নিয়ে প্রতি বছর দেশে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লীহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মোঃ আবদুর রহিম বলেন, দেশে রক্তশূন্যতাজনিত রোগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কোন পরিবারে একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করাতে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের রক্ত পরীক্ষা, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিয়ে না করা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সচেতনতার অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং এ রোগ প্রতিরোধে বাস্তবমুখী কার্যক্রমের অভাবে থ্যালাসেমিয়া দেশের স্বাস্থ্যসেবার হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, থ্যালাসেমিয়া কোন সংক্রামক রোগ নয়। আক্রান্ত শিশুদের প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পর পর নতুন রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসা পেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী-দুটি এক জিনিস নয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা এ রোগে আক্রান্ত নন। থ্যালাসেমিয়ার দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে কিংবা তাদের মধ্যে মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর বাহ্যিক কোন লক্ষণ নেই। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লীহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে যতদিন বাঁচবেন, ততদিন নিয়মিত নতুন রক্ত গ্রহণ করতে হবে কিংবা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই সবারই উচিত, রক্তে থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, তা পরীক্ষা করা। রোগ প্রতিরোধে থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা দরকার।
×