ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকবির জন্মোৎসব

রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য পতিসরে সাজ সাজ রব ব্যাপক আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৮ মে ২০১৬

রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য পতিসরে সাজ সাজ রব ব্যাপক আয়োজন

বিশ্বজিৎ মনি ॥ “ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে। সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক- এলো মহাজন্মের লগ্ন”। “চির নতুনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ”। “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”- বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের এসব কবিতা ও মুখ নিঃসৃত বাণীগুলো যেমন দম্ভহীন, তেমই অহংকারমুক্ত। যা মানুষ-মানুষের মাঝে শ্রদ্ধা আর ভালবাসার বন্ধনকে মজবুত করে। হিংসা-নিন্দাকে দূরে সরিয়ে দেয়। সেই অহংকারমুক্ত বিশ্বের জনমানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী আজ রবিবার। বাঙালীর জীবনে একটি স্মরণীয় দিন এই রবিবার। তাই পুরনো দিনের সকল জরা-জীর্ণকে পিছনে ফেলে নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে বিশ্বকবির জন্মকে নতুন চিত্তে ভাবার জন্য ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত করা হয়েছে কবির পতিসরের এই কাচারি বাড়িকে। সাজানো হয়েছে অপরূপ বর্ণিল সাজে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও এখানে আসবেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি, উর্ধতন কর্মকর্তাসহ দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র ভক্তরা। নাচ, গান আর কবির রচিত কবিতা আবৃত্তি করে উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বকবির জন্মোৎসব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিন উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারী তাঁর স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে নানা উৎসবের। প্রতিবছরই এইদিনে পতিসরে নামে রবীন্দ্রভক্তের ঢল। পরিণত হয় মানুষের মহামিলনমেলায়। সরকারীভাবে ১ দিনের কর্মসূচী নিলেও এ মিলন মেলা চলে প্রায় সপ্তাহ জুড়ে । দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতিচারণে লিপ্ত হন কবিভক্তরা। কবি গুরুর ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য কবির নিজস্ব জমিদারী নওগাঁর পতিসর যেন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কাচারি বাড়িতেই কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পতিসরে নাগর নদের পাড়কে মনমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও পতিসরের তেমন উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন না হলেও স্থানীয় এমপি মোঃ ইসরাফিল আলমের আন্তরিক প্রচষ্টায় এবার যেন হাঁটি হাঁটি পা-পা করে উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারী এলাকা কালিগ্রাম পরগনার সদর দফতর এই পতিসর। আর এই পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মাধুর্যঘেরা কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর আজও সাহিত্যের অঙ্গণে স্বাড়ম্বরে বিরাজিত। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখন তিনি বিরাজ করেছেন এই পতিসরে। প্রতিবছর কবির এই জন্মদিনে দূর-দূরান্ত থেকে কবি ভক্তরা ছুটে আসেন। তাদের প্রিয় কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে যেন কবিভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৩৬ কিলোমিটার ও আত্রাই উপজেলা সদর হয়ে ৫৫ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীতে, কবিগুরুর কাচারি বাড়ি জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের পতিসর গ্রামে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক হোক আর নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীই হোক, তাতে কি আসে যায় ! তিনি যে আমাদের প্রাণের কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নওগাঁ এবং আত্রাই থেকে মাইক্রোবাস, বাস, সিএনজি, টেম্পু, চার্জার, ভটভটিসহ বিভিন্ন যানবাহন যোগে পতিসরে যাওয়া যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতি বছরই এখানে বসে মানুষের মিলনমেলা। সপ্তাহ খানেক জুড়ে চলে সেখানে রবীন্দ্র মেলা। এ সময় স্থানীয় ও এলাকাবাসীর বাড়িতে ভিড় জমায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা কবি ভক্ত, আত্মীয়-স্বজন, অতিথিবৃন্দ। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতি চারণে লিপ্ত হয়, ফেলে আসা পুরনো দিনের কথায়। গ্রামের মানুষ মেয়ে-জামাইকে নাইওরে আনে এই উৎসবে। ঘরে ঘরে পড়ে যায় পিঠা-পায়েসসহ উন্নত মানের খাবার তৈরির ধুম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত পতিসরে এবার কবির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ইতোমধ্যে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রস্তুতি সভায় এখানে সরকারীভাবে ১ দিন ব্যাপী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পতিসরে ১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার মধ্যে রয়েছে, সকাল ১০টায় রবীন্দ্র কাচারি বাড়ির দেবেন্দ্র মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সকাল সাড়ে ১০টায় ‘একুশ শতকে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের প্রাসঙ্গিতা’ শীর্ষক স্মারক আলোচনা অনুষ্ঠান, বিকেল ৩টায় রয়েছে, নাটক, আবৃত্তি, নাচ-গানসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন নওগাঁসহ দেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা। দেশী ও বিদেশী পর্যটক ও রবীন্দ্র গবেষকদের নিরাপদে রাতযাপন ও গবেষণার স্বার্থে পতিসরে ৫ কক্ষবিশিষ্ট অত্যাধুনিক “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি নীড়” নামে দ্বি-তল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৩৭ সালে ২৭ জুলাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাজার হাজার প্রজাকে কাঁদিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে পতিসর তথা বাংলাদেশ থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রজাদের উদ্দেশে বলেছেন, “সংসার থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা ছিল, তা আজ পূর্ণ হলো। তোমরা এগিয়ে চল-জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা-এডুকেশন ফাস্ট, সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও। ইচ্ছা ছিল মানসম্মান-সম্ভ্রম সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতোই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব, কিন্তু আমার আর এ বয়সে তা হবার নয়, এই নিয়ে দুঃখ করে কী করব? আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে, তোমরা নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখো। আমি তোমাদেরকে বড় ভালবাসি। তোমাদের দেখলে আমার আনন্দ হয়। তোমাদের কাছে আমি অনেক কিছু পেয়েছি; কিন্তু কিছুই দিতে পারিনি-আশির্বাদ করি তোমরা সুখী হও। তোমাদের সবার উন্নতি হোক-এ কামনা নিয়ে পরলোকে চলে যাব।” আবার একই দিনে কালিগ্রাম রথীন্দ্র নাথ ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছেন, “রথীন্দ্র নাথের নাম চিহ্নিত কালিগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয় এই আমাদের উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম- এ কথা সর্বদা মনে রাখা উচিত। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মান হানিজনক। সাধারনত আমাদের দেশে অল্প বয়স্ক বালকগন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ হইয়া থাকে- একথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই সতর্ক করিয়া দিলাম।” শেষ বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কবির ৭৬ বছর বয়সের একটি উন্মুক্ত ভাষ্কর্য স্থাপন করা হয়েছে পতিসরে। স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। এই কাচারি বাড়িতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নওগাঁর আত্রাইয়ের এই পতিসরে এসে তাঁর কাচারি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’। যদিও বর্তমানে নাগর নদের তলদেশ জলশূন্য। এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত কবিতা “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে”, “দুই বিঘা জমি”, “সন্ধ্যা”সহ অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন এই পতিসরের কাচারি বাড়িতে বসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার পুরস্কারের অর্থ তিনি এই পরগনার প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার জন্য ৭৫ হাজার টাকা তৎকালীন সময়ে এখানে স্থাপিত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার প্রজাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার লক্ষে কবি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পতিসরে এসে তার পুত্র রথীন্দ্রনাথের নামে কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন স্থাপন করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের নামে ২শ’ বিঘা জমি দান করেন। তথ্য অনুসন্ধানে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মহান ও উদার মনের মানুষ। এই পরগনাসহ দেশের জাতি-ধমর্- বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। কুঠিবাড়ীতে তিনদিন অনুষ্ঠান ॥ শাহজাদপুর থেকে সংবাদদাতা জানান, ঐ নতুনের কেতন উড়ে কাল বৈশাখী ঝড়.....। রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে শাহজাদপুর রবীন্দ্র সাহিত্য তীর্থ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে ৩দিন ব্যাপি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মজয়ন্তীর ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। আজ থেকে ৩দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বিল্øাল হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী আলহাজ মোঃ নাসিম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন, সংসদ সদস্য তানভির ইমাম, গাজী আমজাদ হোসেন মিলন, হাবিবে মিল্লাতমুন্না এমপি। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। তৃতীয় দিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই অনুষ্ঠানে ৩দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানসূচীতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও নানামুখী কর্মধারা নিয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক পরিবেশন করা হবে। এছাড়াও শিশু শিল্পীদের আবৃতি প্রতিযোগিতা। ৩দিন ব্যাপী জন্মজয়ন্তীর প্রধান আকর্ষণ ছিল রবীন্দ্র মেলা। শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দূরদূরন্ত থেকে বিভিন্ন দেশীয় পণ্যের স্টল মালিকরা এসেছে স্টল করার জন্য। কিন্তুু অভ্যান্তরীণ সমস্যার কারণে মেলা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ায় স্টল করতে আসা ব্যবসায়ীরা চরম হাতাশায় পড়েছে।
×